২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আমাদের আবুল ভাই

-


আমাদের পাড়ার আবুল ভাই আমাদের থেকে পাঁচ বছরের বড়। তবে বয়সে বড় হলে হবে কি, বুদ্ধিজ্ঞানে আজো ছোট্ট শিশুর মতো। এ কারণে আজ অবধি আবুল ভাইয়ের বিয়ের ফুল ফুটল না। মৃত্যুর আগে ফুটবে বলেও মনে হয় না। আবুল ভাইয়ের বুদ্ধিজ্ঞান কম বলে তার সমবয়সী কোনো ছেলের সাথে তার বন্ধুত্ব নেই।
আবুল ভাই পড়ালেখায় কেমন ছিল, সঠিক জানি না। তবে লোকমুখে শুনছি, অবুল ভাই সাত ক্লাস বাদে এসএসসি পাস।
প্রতি ক্লাসে নাকি তিন-তিনবার করে বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে তবেই ওপরের ক্লাসে উঠছে।
আবুল ভাইয়ের বুদ্ধিজ্ঞান কম থাকায় অবশ্য আমাদের, মানে ছোট্টদের লাভই হয়েছে। কারণ, আবুল ভাই সব সময় আমাদের সাথে চলত। আমাদের দলের হয়ে ক্রিকেট আর ফুটবল খেলত। যদিও বলারের বল ব্যাটে আসার আগে আবুল ভাই ব্যাট ছেড়ে এক হাতে নাক চেপে ধরত। তার কারণ একবার নাকি কোথায় খেলতে গিয়ে, বল তার নাকে এসে লাগছে। আর সেদিনের পর থেকে এমন করে এক হাতে ব্যাট আর এক হাতে নাক চেপে ধরেই খেলতে নামত আবুল ভাই। ফুটবল খেলায় অবশ্য আবুল ভাই হলো আলরাউন্ডার। পুরো মাঠ ঘুরে বেড়ায়। কখনো দৌড়ে আবার কখনো বলের সামনে গড়াগড়ি দিয়ে।
তবে দেখার মতো বিষয় হলো, পুরো মাঠে দৌড়ালেও বলের দেখা পায় না আবুল ভাই। কারণ, বল সব সময় আবুল ভাইয়ের সামনে দৌড়ায়।
আবুল ভাই মাঝে মাঝে আমাদের কিছু জ্ঞান দিত। আমরা শুনি আর না শুনি, সে তার মতো বক বক করেই চলত। সেদিন রাতে হঠাৎ রাকিবের মাথায় ঢুকল একটা কুবুদ্ধি। আমাদের পাশের বাড়ির আরিফ মিয়ার পুকুরপাড়ে আছে সারি সারি খেজুর গাছ। শীতের মওসুম বলে কথা। খেজুর গাছে বাঁধা থাকে সারি সারি হাঁড়ি।
রাকিব মিয়া পরিকল্পনা করল যেমন করেই হোক আজ রাতে খেজুরের রস চুরি করে খাওয়া চাই।
যেই ভাবা সেই কাজ। আমাদের পরিকল্পনা শুনে আবুল ভাই এক পায়ের ওপর রাজি হয়ে গেল। সমস্যা বাধল খেজুর গাছে ওঠা নিয়ে। কে উঠবে খেজুর গাছে? আমার জন্মে তো আমি গাছে উঠিনি। উঠলেও মই বেয়ে।
রাকিব উঠতে পারে, তবে খেজুর গাছে কখনই ও ওঠেনি। রাফি উঠতে পারলেও উঠবে না। কারণ একে তো রাত তার ওপর চুরি করে উঠতে হবে। আগে থেকে ভীতুর ডিম বলে পরিচিতি পাওয়া রাফিকে বাদ দেয়া হলো।
আমাদের অবস্থা দেখে আবুল ভাই রাগে গজ গজ করতে লাগল।
শেষে নিজে থেকে বলে উঠল, আমি নিজেই গাছে উঠব। আর আমার হাতে থাকবে লম্বা রশি। আমি যখন গাছ বেয়ে ওপরে উঠব তখন নিচে দাঁড়িয়ে থাকবে রাফি। তার থেকে একটু দূরে রাকিব। আমি গাছে উঠে হাঁড়ির গলায় রশি বেঁধে দিয়ে আস্তে আস্তে নিচে ছেড়ে দেবো। রাফি তখন ওই হাঁড়ির গলা থেকে রশি খুলে রাকিবের কাছে দেবে। আর রাকিব তোকে (মানে আমাকে)।
পরিকল্পনা মতো রাত একটু গভীর হতেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আরিফ মিয়ার পুকুর পাড়ে এসে পরিকল্পনামতো খুবই সাবধানে গাছে উঠল আবুল ভাই। আমরা যে যার পজিশনে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ করে ঘটল বড় রকমের একটা বিপত্তি।
পুকুর পাড়ের উত্তর দিক থেকে কে যেন টর্চ লাইট জ্বালিয়ে বলে উঠলÑ কে রে ওখানে?
লাইটের আলো আর লোকের কথা শুনে আমরা যে যার মতো ভোঁ-দৌড়। ওদিকে আবুল ভাই তাড়াতাড়ি করে নামতে গিয়ে ধপাস করে খেজুর গাছের ওপর থেকে পড়ে যায় পুকুরে। এর মাঝে পুকুরের মালিক মানে আরিফ মিয়া এসে উপস্থিত হয় ওই জায়গায়।
শীতের রাত। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। তার ওপর আবুল ভাই তেমন একটা সাঁতার জানে না। আবুল ভাইয়ের গায়ে ছিল তিন-চারটা মোটা জামা। সব কিছু মিলিয়ে আবুল ভাইয়ের পক্ষে সাঁতার কেটে পাড়ে ওঠা অসম্ভব। আবুল ভাইয়ের পানিতে পড়ার শব্দ শুনে আরিফ মিয়াও চাওয়া-চিন্তা না করেই দিলেন পানিতে লাফ। তার একটাই কথা যে করেই হোক আজ এই চোরকে ধরতে হবে। অথচ আরিফ ভাই যে একটুও সাঁতার জানে না, এ কথা তার ওই মুহূর্তে একটুও মাথায় ছিল না।
আমরা একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ করে ওদের দুইজনের আত্মফাটা চিৎকার শুনে আমরা সাহস করে ওদের কাছে চলে এলাম। এসে দেখি দুইজনে মিলে পানিতে এলাহি কাণ্ড শুরু করছে।
একজন আর একজনকে জড়িয়ে ধরছে আর সমানে পানির নিচে ডুবছে আর ভাসছে।
ওদের কাণ্ড দেখে আমাদের একটুও বুঝতে বাকি রইল না, এই মুহূর্তে কী হচ্ছে। তাই একটুও বিলম্ব না করে পানিতে লাফ দিয়ে ওদের দুইজনকে ধরাধরি করে পাড়ে তুলে আনলাম।
সেই দিনের পর থেকে আবুল ভাই আর আমাদের দলে ভেড়ে না। আমরাও আর কখনোই কিছু চুরি করতে যাই না।

 


আরো সংবাদ



premium cement