২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আমার খালাতো ভাই

-

বাজারে যাচ্ছি। বিশেষ কোনো কাজে নয়। বন্ধুদের সাথে টুকটাক আড্ডা আর কফি শপে গিয়ে চা অথবা কফির মগে চুমুক দেয়াটা আজকাল নেশার দিকে চলে যাচ্ছে। যদিও নেশাটা আমি ভালোভাবে আমলে নিয়েছি।
খান বাড়ির সামনে আসতেই রাস্তার বাম পাশে অনেক লোকের ভিড় চোখে পড়ল। কে যেন এখানে অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। যে অ্যাক্সিডেন্ট করেছে, সে নাকি সাথে সাথেই নিহত। মালবাহী ট্রাক মেরেছে। ট্রাকওয়ালাকে ধরা যায়নি। পালিয়েছে।
অ্যাক্সিডেন্টের কথা শুনে মনটাই খারাপ হলো। আহারে, না জানি কার মায়ের বুক খালি হয়েছে। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই, যে মারা গেছে, তার বয়স কত? কিভাবে ঘটনা ঘটল?’
লোকটা আমার কথাকে পাত্তাই দিলো না। উৎসুক জনতার ভিড়ের মধ্যখানে লাশ পড়ে আছে। লোকারণ্যের জন্য দেখা যাচ্ছে না। খুব ইচ্ছে হলো একবার লাশটা দেখি। কিন্তু ভেতরে ঢুকতে পারব বলে মনে হচ্ছে না, এত ভিড়।
শোক ভারী হতে থাকল। কেউ কেউ বলছে, ‘আহারে জায়গাতেই মারা গেল। হারামজাদা চালককে ধরতে পারলে জেলে দেবো। ইশ, এত রক্ত।’
লোকের মুখে যতই এসব বক্তব্য শুনছি, ততই লাশটা দেখার আগ্রহ বাড়ছে। কিন্তু বেপরোয়া জনতার এই ভিড় ভেদ করে ভেতরে ঢুকতে পারাটা এখন মনে হচ্ছে সম্ভব নয়।
সাধারণত নিহতদের লাশ দেখতে আমি ভয় পাই। কিন্তু আজ কেন জানি ভয় লাগছে না। বরং লাশটা দেখার উপযুক্ত সাহসও বুকে জমে আছে। কিন্তু জনতার ভিড় ক্রমেই বাড়তে থাকে। এক বুড়ো গর্জে উঠে বলল, ‘ভিড় কমান। সরে যান। দেখেন তো এখনো বেঁচে আছে কিনা!’
কিন্তু বুড়োর কথাকে কেউ গুরুত্ব দিচ্ছে না। সবাই লাশটা এক নজর দেখার আশায় ভিড় শুধু বাড়াচ্ছেই।
বুঝতে পারলাম এভাবে হ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে থাকলে আমার চলবে না। একটা উপায় খুঁজে ভিড়ের ঠিক ভেতরে গিয়ে লাশটা দেখতে হবে। কিন্তু সহজে ভেতরে ঢুকতে পারব না ভেবে জোরগলায় বললাম, ‘সরে দাঁড়ান সবাই। যে অ্যাক্সিডেন্ট করেছে, আমি তার খালাতো ভাই। আমাকে ওর লাশের কাছে যেতে দিন।’
ভেবেছি এই কথায় লোকজন আমাকে সহজে আগলে ভেতরে নিয়ে যাবে, কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া কারো মাঝে দেখা তো যাচ্ছে না, বরং সবাই রাজ্যের বিস্ময়তা নিয়ে আমার দিকে তাকাল। তাতে কী! সফলতার জন্য মানুষকে মাঝে মধ্যে মিথ্যেও বলতে হয়। তাই মিথ্যে বলে লাশকে আমার খালাতো ভাই বানালাম, যা শুনে সবাই সহজে আমাকে লাশের কাছে যাওয়ার পথ খুলে দেবে।
আবারো মিথ্যে করে বললাম, ‘প্লিজ সবাই সরেন। আমাকে আমার খালাতো ভাইয়ের লাশের কাছে যেতে দিন। আপনাদের জন্য তো ওখানে যাওয়াই যাচ্ছে না।’
এবারো কেউ আমার কথার গুরুত্ব দিলো না। তানভীর নামে ইয়ং একটা ছেলে আমার কথা শুনে অট্টহাসি দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। আশ্চর্য, এই ছেলে হাসছে কেন! এমন পরিস্থিতিতে কেউ হাসে! বেয়াদব একটা।
এবার কণ্ঠে একটু কান্নার ভাব এনে জোরসে বললাম, ‘দোহাই আপনাদের, সরেন। আমার ভাইটার লাশের কাছে আমাকে একটু যেতে দিন। আহারে ভাই আমার, এভাবে মারা গেলি!’
আমার কথা শুনে অনেকে হাঁ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। অবশেষে অনেক কষ্টের পর ভিড়ের ঠেলা অতিক্রম করে কাক্সিক্ষত লাশের একেবারে কাছে পৌঁছলাম। কিন্তু লাশ হিসেবে যাকে দেখছি, সে কোনো মানবজাতি নয়। আস্ত একটা পাটনাই ছাগল। খুব বড় সাইজের পাটনাই ছাগলটি অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে বলে সবার মধ্যে একটু কৌতূহল। তাই এত ভিড়।
আমি বোকা হলাম। ভিড় ঠেলে লাশ দেখতে যাওয়ার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে খালাতো ভাইয়ের নাম করে লক্ষ্যে গিয়ে দেখি সে খালাতো ভাই নয়, পাটনাই ছাগল।
লজ্জা পেয়ে ফিরে আসার সময় তানভীর নামে সেই ছেলেটি বলল, ‘দেখলেন আপনার খালাতো ভাইকে?’
ছেলেটির কথা শুনে আমার লজ্জা ক্রমেই বাড়তে লাগল।

 


আরো সংবাদ



premium cement