২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ধর্ষণ যেখানে ছেলেখেলা

ধর্ষণের প্রতিকী ছবি। - ছবি: সংগৃহীত

#'মি টু' আন্দোলনে বিশ্বের অনেক রথী-মহারথীর কুকীর্তি জনসম্মুক্ষে প্রকাশ পেয়েছে। এতে অনেকেই আশ্চর্য হচ্ছেন। প্রতিবেশি দেশে এ নিয়ে রীতিমত তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে।

ভারতে ১২ বছরের কম বয়সী শিশু ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। এ সম্পর্কিত এক অর্ডিন্যান্সে দেশটির রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর দেয়ার পর দক্ষিণী জনপ্রিয় অভিনেতা কমল হাসান প্রশ্ন তুলেছেন, ১৩ থেকে ১৬ বছর বয়সীদের কেন নতুন আইনে শিশু হিসেবে গণ্য করা হলো না? এ প্রসঙ্গে সিপিএমের কেন্দ্রীয় নেত্রী বন্দা কারাত বলেছেন, ‘সিপিএম নীতিগতভাবে মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী।

সমস্যা হলো, সরকারের লোকজনই ধর্ষকদের সমর্থন করছে। যারা ধর্ষকদের রা করছে, তাদেরও সাজা হওয়া উচিত। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সন্তোষ গাংওয়ার বলেছেন, ভারতের মতো বড় দেশে দুই-একটা ধর্ষণ হতেই পারে। তা নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করার কিছু নেই। ধর্ষণের ঘটনা দুর্ভাগ্যজনক। কখনো কখনো থামানো যায় না। এটা নিয়ে এত হইচইয়ের কী আছে? অবস্থা বেগতিক দেখে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলতে বাধ্য হলেন, ক্যামেরা দেখলেই মুখ খোলা বন্ধ করুন।

দুঃখজনকভাবে সামাজিক সমস্যা থেকে ধর্ষণ মহামারি আকারে রূপান্তরিত হওয়ার পরও তা মোকাবেলার পরিবর্তে দেশটিতে ক্ষমতা ও আধিপত্যকেই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। যার এক ধরনের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে ধর্ষণের মধ্য দিয়ে।

গবেষকেরা অন্তত আড়াই লাখ ধর্ষণ ঘটনা নিয়ে গবেষণায় বলেছেন, ১৫ বছরের একটি মেয়ের ধর্ষণ হওয়ার শঙ্কা ৩৫ বছরের একটি নারীর চেয়ে ৯ গুণ বেশি। কিন্তু জম্মু-কাশ্মিরের কাঠুয়ায় আট বছরের আসিফাকে মন্দিরে আটকে রেখে টানা ধর্ষণের পর জানা যায়, যাযাবর বাকারওয়াল মুসলিম সম্প্রদায়কে এলাকা ছাড়া করার জন্যই এ ঘটনা ঘটানো হয়। কিনিক্যাল ফিজিওলজিস্ট নিকোলাস গ্রোথের মতে, ধর্ষণ চার কারণে হতে পারে। বিকৃতমনা, হিংসা চরিতার্থ করা, শক্তিমত্তা প্রকাশ, প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে এ ধরনের অপরাধ করা। নির্ভয়া ঘটনার পর জাস্টিস ভার্মা কমিটি ধর্ষণের সামাজিক ভিত্তিকে অকার্যকর সমাধান হিসেবে উল্লেখ করে। গোয়ার মিসরির গবেষণা প্রতিষ্ঠান রেসকিউয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, ৪০ শতাংশ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে পর্নোগ্রাফিজনিত কারণে। তাই ধর্ষণের ক্ষেত্রে কোনো বিচার সংস্কারমূলক বা প্রতারণামূলক হতে পারে না। কারণ শিকারটি জীবনের জন্য ক্ষতিকারক। মোদির বেটি বাঁচাও কিংবা ‘জাস্টিস টু আরো ডটারস’ এমন প্রতিজ্ঞা রক্ষাই এখন জরুরি।

ধর্ষণের বিরুদ্ধে ভারতে অনেক বিক্ষোভ হয়েছে, প্রতিবাদ কর্মসচি পালিত হয়েছে, আইন সংস্কারও হয়েছে। কিন্তু হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ধর্ষিতাদের প্রতি অপমানজনক দৃষ্টিভঙ্গি এখনো এ অপরাধের বিরুদ্ধে সমর্থন ও ন্যায়বিচার উভয়ের জন্য বড় বাধা হয়ে রয়েছে। থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনের জরিপে ভারতের দিল্লি এখন ধর্ষণের রাজধানী হিসেবে বিবেচিত। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের আরেকটি জরিপ বলছে, ভারতে ধর্ষণের বিরুদ্ধে আইন শক্তিশালী হতে শুরু করলে পুলিশের কাছে ধর্ষণের অভিযোগ ৩৯ ভাগ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ধর্ষকের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগে এখন বিস্তর ফারাক রয়ে গেছে। ধর্ষণ মামলাগুলো এতই দুর্বল হাতে পরিচালিত হচ্ছে যে, ধর্ষকরা শেষ পর্যন্ত পার পেয়ে যাচ্ছে।

ওয়াশিংটন পোস্টের একটি প্রতিবেদন বলছে, চারটি ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে একটির সুরাহা হয় মাত্র। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তে ধীরগতি ও সময়মতো সঠিক পদক্ষেপ না নেয়া।

ভারতের মধুমিতা পাণ্ডে তার গবেষণা প্রতিবেদন তৈরির সময় অন্তত ১০০ ধর্ষকের ইন্টারভিউ নেয়ার সময় দেখেছেন, বেশির ভাগই সাধারণ মানুষের মতো। যা তারা ঘটান তা উচ্ছৃঙ্খল আচরণ ও চিন্তার বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই। অনেক ধর্ষক মনেই করেন না ধর্ষণ একটি ঘৃণ্য অপরাধ। স্বামী পরিত্যক্তা অনেক নারী প্রতিবেশীদের গালমন্দ শুনতে শুনতে কিভাবে যে ধর্ষকদের টোপের শিকার হন তা তিনি টেরও পান না।

২০১৫ সালে ভারতে সরকারের হিসাবেই ৩৪ হাজার ধর্ষণের ঘটনার কথা বলা হয়েছে। অনেক ধর্ষণের ঘটনা চাপা পড়ে যায়। ধর্ষিতা বিচার পাওয়ার পাশাপাশি সামাজিকভাবে পুনর্বাসনের সুযোগ না পাওয়া পর্যন্ত এ ধরনের অপরাধ কমার কোনো কারণ নেই। ২০১৬ সালে ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো শুধু শিশু ধর্ষণের মামলা রেকর্ড করে ১৯ হাজার ৭৬৫টি, যা আগের বছরের তুলনায় ৮২ শতাংশ বেশি। মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও উত্তর প্রদেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে সবচেয়ে বেশি। এসব ঘটনা প্রমাণ করে, হাজার হাজার ভারতীয় নারী এখনো নিরাপত্তাহীনতায় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

ভারত ও চীনে পুরুষের সংখ্যাধিক্য থাকলেও প্রতিবেশী দেশটি কিছুতেই ধর্ষণের মতো অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। বরং ধর্ষণের পর ধর্ষিতাকে মেরে ফেলার ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। প্রতি ১৫ মিনিটে ভারতে একজন নারীকে ধর্ষণ করা হচ্ছে এবং এ সময়ের ব্যবধান হ্রাস পাচ্ছে। প্রতি দুই মিনিটে একজন নারী দেশটিতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। নারীর প্রতি চলমান এই সহিংসতা প্রশ্ন তুলেছে, ভারত সত্যিই বিশ্বের সম্মুখ সারিতে আসন পেতে পারে কি না।

একই সাথে ভারতে দীর্ঘ দিন কন্যাসন্তানের ভ্রণ হত্যার ঘটনা সমাজে নারীর অবস্থান সম্পর্কে এমন এক নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে রেখেছে, যাতে ধর্ষণ কিংবা নির্যাতনও যেন এক ধরনের পরিণতি। কিন্তু নারীদের এ ধরনের পরিণতি সামাজিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তাকে চরমভাবে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। নারীর চেয়ে পুরুষের সংখ্যা বেশি হওয়ার পরও চীনে এমন এক সহনশীল ও সহমর্মী সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছে, যার কারণে ভারতের মতো ধর্ষণ সঙ্কট সৃষ্টি হয়নি। উপরন্তু ভারতে বর্ণপ্রথা নারীকে পুরুষের চেয়ে কম মর্যাদা দিয়েছে। ভারতে একটি মেয়েকে বড় করে তোলা যেন প্রতিবেশীর গাছে পানি দেয়ার সমান। রয়েছে ধর্মগ্রন্থেও নারীদের জন্য অসম্মানজনক মন্তব্য।

মহাভারতে উল্লেখ আছে, নারীর চেয়ে বড় পাপপুণ্য সৃষ্টি আর নেই। নারী বিষ, সে সাপের মতো। এমনো বলা আছে, নারী হচ্ছে জীবন্ত মিথ্যা। ফলে নারী সম্পর্কে অশোভন আচরণ কোনো ধরনের অনুশোচনা ছাড়াই তা সহিংসতার পর্যায়ে অনায়াসে পৌঁছে যাচ্ছে। দুর্ভাগ্যবশত পৌরাণিক কাহিনীগুলোতে ধর্ষণকে গৌরবময় এক যৌনতা হিসেবে বলা হয়েছে।

ভারতে একটি সঙ্কীর্ণ সংজ্ঞায়িত, অতিমানববাদী, জঙ্গি হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শের পুনর্জাগরণ দেখছে এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এর রূপকার। পালন দেবতা বিষ্ণু, তুলসী বা বৃন্দার লীলা কাহিনী কমবেশি সবারই জানা। ভারতীয়রা বিশ্বাস করে, তুলসীর স্বামী শঙ্কসুধা ততক্ষণ যুদ্ধে জয়লাভ করবে না, যতক্ষণ না তুলসীর পবিত্রতা বিনষ্ট হবে। জলান্ধরকে হারাতেই তুলসীকে ধর্ষণ প্রয়োজন হয়ে পড়ে বিষ্ণুর এবং বিষ্ণু ধর্ষণ করেও রীতিমতো মহানায়ক। মাৎস্য পুরাণে (৪৯.১৭-২৮) বর্ণিত আছে, সব ভারতীয় দেবতার গুরু হচ্ছে গ্রহ দেবতা বৃহস্পতি। বৃহস্পতি একদিন তার ছোট ভাই উসিজার গর্ভবতী স্ত্রী মমতাকে দেখে মৌজের প্রস্তাব দেন। কাপড় খুলে আসার কথা বললে মমতা তার গর্ভে পরিপক্ব ভ্রণের কথা বলার পর বেদবাক্য পড়েও রেহাই পাননি। বৃহস্পতি নৈতিকতার ধার ধারেন না বলে জবাব দেন এবং মমতাকে ধর্ষণ করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একাধিক যৌন সম্পর্কের কাহিনী এখন প্রকাশ পাচ্ছে ধারাবাহিকভাবে। তার আগে প্রখ্যাত কৌতুক অভিনেতা বিল কসবির বিরুদ্ধে একের পর এক ধর্ষণের অভিযোগ তুলতে থাকেন নির্যাতিতারা। একটি স্বাভাবিক সমাজে মানুষ এ ধরনের ধর্ষক ও কামলীলায় ওস্তাদদের চেনেন এবং সময়মতো তাদের বিরুদ্ধে বিচার দাবি করেন। কিন্তু ধর্ষণের মতো হতাশাজনক বিষয়ে কোনো ধর্ষক দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত ধর্ষিতা নির্দোষ প্রমাণিত হন না। দেবতা বৃহস্পতির মতো অনেক ধর্ষকই ভারতে। তাই এখনো দেবতার আসনেই আসীন রয়েছেন। ভারতে এ ধরনের দেবতাদের পদত্যাগের প্রয়োজন বা বিচারের মুখোমুখি না হওয়া পর্যন্ত পরিস্থিতির খুব একটা হেরফের হবে না। ভারতে ধর্ষণ তাই শিশুখেলা। খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়।

ভারতের পৌরাণিক কাহিনী ধর্ষণ সম্পর্কে দেশটির মানুষের মধ্যে কোনো ভাবান্তর সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় না। বরং ভারতে ধর্ষণ শুধু ধর্ষণ নয়, এক ধরনের বলপূর্বক যৌনতা, যা আধুনিক পশ্চিমা বিশ্বে বিবেচনা করা হয় ‘স্নেহপূর্ণ’ হিসেবে এবং প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে তা গৌরাবান্বিত ও স্বাভাবিক। ভারতে এখন অভিভাবকের হাতে কন্যা ধর্ষিত হচ্ছে, মৃত ব্যক্তিরাও রেহাই পাচ্ছেন না। পশুও নয়। অস্কার মনোনীত চলচ্চিত্র ‘দি রেভিন্যান্টে’ দেখা যায়, ভাল্লুককে লিওনার্দো ডি-ক্যাপ্রিওকে একা ছেড়ে চলে যেতে। কিন্তু ভারতীয় পৌরাণিকে দেখা যায়, দেবতা ব্রাহ্মর সাথে ভাল্লুকের যৌনতার পর শিশু জাম্বু বন্ধনকে জন্ম দিতে।

ভারতীয় সমাজে মনে করা হয় ধর্ষণের কোনো ফলাফল নেই। যেখানে নারীর প্রতি সহিংস যৌনতা প্রতিনিয়ত ভারসাম্য বিনষ্ট করছে, নারীর সাংস্কৃতিক সম্মানকে লঙ্ঘিত করছে এবং বছরে ৩৭ হাজার নারীকে ধর্ষণের মতো ঘটনা আশ্চর্যজনক নয় বরং বিস্ময়কর। ভারতীয়রা এতে অভ্যস্ত। ভারতে নারীদের বিরুদ্ধে এই নিপীড়ন, অত্যাচার কখনো ভালো ফল বয়ে আনতে পারে না। যতক্ষণ না এর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ বা ঘণা না জন্মাচ্ছে, ততক্ষণ বরং এ ধরনের ধর্ষণ অপসংস্কৃতি ভারতের

আশপাশের দেশেও মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ভারতে এলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার সাথে সাক্ষাতের সময় জেমস বন্ড কায়দায় কেতাদুরস্ত হয়েই সাক্ষাৎ করেছিলেন। কারণ মোদি চেয়েছিলেন বিশ্ব মানচিত্রে এক সম্মানজনক বৈধতা। কিন্তু তার এ বৈধতাকে হিন্দুত্ববাদী দর্শন পেছনে ধরে টানছে এবং তা অবশ্যই ভারতে ধর্ষণের আতঙ্কে থাকা অসংখ্য নারীর কারণেই। একই কারণে বিশ্বের উচিত মোদিকে অন্তত নারীর নিরাপত্তার জন্য জবাবদিহিতে বাধ্য করা। সম্ভবত এ ধরনের আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতাই ভারতে ধর্ষণ রুখতে সাহায্য করতে পারে।

দেখুন:

আরো সংবাদ



premium cement