২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অধিকারহারা মানবাধিকার

- প্রতীকী ছবি

মানবাধিকার প্রতিটি মানুষের এক ধরনের অধিকার; যা জন্মগত ও অবিচ্ছেদ্য। এটি সার্বজনীন, সহজাত, অহস্তান্তরযোগ্য এবং অলঙ্ঘনীয়। স্থানীয়, জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক আইনের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো মানুষের এসব অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা। আর তা নিশ্চিত করার জন্য জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার সনদও রয়েছে। কিন্তু তারপর পুরো বিশে^ই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে তা আরো ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

আমাদের দেশে সরকার ও সরকার সংশ্লিষ্টরা সুশাসন নিয়ে জনগণকে প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা করলেও বাস্তবতার সাথে তার তেমন মিল নেই। দেশে লাগামহীন দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, মত প্রকাশে বাধা-প্রতিবন্ধকতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বিষয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো নেতিবাচক মন্তব্য করলেও সরকার বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে। এমনকি তারা এসব অভিযোগ ‘বিরোধী দল প্রভাবিত’ বলে দায়মুক্ত থাকার চেষ্টা করে আসছে।

দেশে সুশাসন নিয়ে প্রশ্ন দীর্ঘদিনের। সম্প্রতি সে প্রশ্নের পরিসর আরো বেড়েছে। বিষয়টি নিয়ে নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ বরাবরই আমাদেরকে সতর্ক করেছে। আন্তর্জাতিক এই সংস্থাটির প্রতিবেদনে বিশে^র ৯০টিরও বেশি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে তৈরি করা প্রতিবেদনের ‘বাংলাদেশ’ অধ্যায়ে বলেছে, ‘২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশ স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের দিকে এগিয়ে গেছে। দেশটিতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর প্রচণ্ড আঘাত এসেছে এবং এ অবস্থার কোনো দৃশ্যমান উন্নতি হয়নি। গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের কর্মীদের ওপর সরকার দমন-পীড়ন চালিয়েছে। আদালত অবমাননার অভিযোগ বা অস্পষ্ট আইনের আওতায় তাদের বিচারের মুখোমুখি করেছে। নিরাপত্তাবাহিনী ‘গুম’ (ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স), যথেচ্ছ গ্রেফতারসহ (আরবিট্র্যারি অ্যারেস্ট) মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন করেছে। যারা এসবের জন্য দায়ী, তাদের ব্যাপারে তদন্ত বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে খুব কম ক্ষেত্রেই। নিরাপত্তাবাহিনী মানবাধিকার লঙ্ঘন করে বিচারের ঊর্ধ্বে থাকার বা ‘ইমপিউনিটি’ ভোগ করার সুযোগ পাচ্ছে’।

‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’এর এই অভিযোগগুলো নিঃসন্দেহে মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন। এসব গুরুতর অভিযোগের বোঝা মাথায় নিয়ে কোনো জাতি উন্নয়ন ও অগ্রগতির মহাসড়কে উঠতে পারে না। কিন্তু সরকার কখনোই এসব অভিযোগ আমলে নেয়নি, বরং এসবকে তারা অহেতুক সরকারবিরোধী উটকো উপদ্রপ হিসেবেই বিবেচনা করেছে। অথচ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে আমাদের দেশে প্রতিনিয়তই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। ফলে ব্যাহত হচ্ছে সুশাসনও। দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি দেখভাল করার জন্য মানবাধিকার কমিশন নামে একটা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে এ ধরনের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান প্রতি বছরের শুরুতেই বিদায়ী বছরের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য-উপাত্তসহ বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রকাশিত প্রতিবেদনে তথ্য-উপাত্তের পাশাপাশি কমিশন নিজস্ব পর্যবেক্ষণ, আলোচনা-পর্যালোচনা, সমালোচনা, পরামর্শ, সুপারিশমালাও প্রণয়ন করে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ওয়েবসাইটে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দায়সারা গোছের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদন দেখা গেলেও তা মোটেই যথেষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ নয়। এমনকি সেই প্রতিবেদনে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুম সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ তথ্য-উপাত্তের বিষয়টি উপেক্ষিত হওয়ার অভিযোগ বেশ জোরালো।

ফলে সে প্রতিবেদনের গ্রহণযোগ্যতাও প্রশ্নবিদ্ধই রয়ে গেছে। ফলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন যে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার ষোলোকলা পূর্ণ করেছে তা খুবই স্পষ্ট। মূলত কোনো দেশের সরকার যখন অবাধ তথ্যপ্রবাহ ও তথ্য-উপাত্তের সহজলভ্যতা নিশ্চিত ব্যর্থ হয়, তখন অনেকটা বাধ্য হয়েই সংশ্লিষ্টদের বিকল্প উৎসের আশ্রয় জরুরি হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে আমাদের ‘আইন ও সালিস কেন্দ্র’ এবং ‘অধিকার’এর মতো বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থার সূত্রের ওপরই নির্ভর করতে হয়। সংস্থা দু’টি তাদের সীমিত জনবল ও আর্থিক সীমাবদ্ধতার মধ্যেই দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং বছর শেষে একটি বার্ষিক প্রতিবেদনও প্রকাশ করে আসছে দীর্ঘদিন থেকেই।

সংস্থাটির এসব তথ্য-উপাত্ত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোও আমলে নেয়ার রেওয়াজ রয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’কে আইন ও সালিস কেন্দ্র এবং অধিকারের তথ্য অনুসরণ করতে দেখা যায়। মূলত প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো বাংলাদেশের বিগত বছরগুলোর মানবাধিকার পরিস্থিতির যে চিত্র ফুটে উঠেছে, তা আন্তর্জাতিক ওই সংস্থাটির মনগড়া ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কোনো চিত্র নয়, বরং আমাদের দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য-উপাত্তের বাস্তবতারই প্রতিচ্ছবি বলেই মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল। আর সরকারও এসব অভিযোগ খণ্ডনের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। তাই মৌনতাকে স্বীকারোক্তি বলেই মনে করা হচ্ছে।

আমাদের দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হচ্ছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের হাতে নাগরিকদের প্রাণহানি। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের বিষয়ে সরকারের স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি থাকলেও বাস্তবে তার তেমন প্রতিফলন নেই। বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ প্রাণহানির সংখ্যা প্রতি বছরই গাণিতিক হারে বেড়েছে। আইন ও সালিস কেন্দ্রের হিসাব মতে, ২০১৩ সালে র‌্যাব সদস্যদের হাতে ‘ক্রসফায়ারে’ প্রাণহানির সংখ্যা ছিল ২৪, আর পুলিশ সদস্যদের হাতে ছিল ১৭। ২০১৪ সালে র‌্যাব ৩৬, আর পুলিশ ৬৮! ২০১৫ সালে র‌্যাব ৪১, পুলিশ ৬৪। ক্রসফায়ারে মোট প্রাণহানির সংখ্যাও প্রতি বছর বেড়েছে: ২০১৩ সালে ৪২, ২০১৪ সালে ১২৭, ২০১৫ সালে ১২৮। পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সদস্যদের হাতে ‘ক্রসফায়ারে’ প্রাণহানির কথা আগে জানা যায়নি।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে ডিবি পুলিশের সদস্যদের হাতেও ‘ক্রসফায়ারে’ মানুষ মারা যাচ্ছে। ২০১৪ সালে ডিবির ক্রসফায়ারে মারা গেছে ৯ জন; ২০১৫ সালে ১৩ জন। বিচারবহির্ভূত এসব হত্যাকাণ্ড বাড়তে বাড়তে ২০১৯ সালের ১১ মাসে ৩৬২তে এসে দাঁড়িয়েছে। আর সার্বিক পরিস্থিতির এতই অবনতি হয়েছে যে, ‘ক্রসফায়ার’ ছাড়াও নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু, গ্রেফতারের আগে গুলি করে হত্যা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পরিচয়ে কাউকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর তার আর কোনো খোঁজ না পাওয়া এবং খুবই কম ক্ষেত্রে মৃতদেহ উদ্ধারের মতো ঘটনাও বেড়েছে। যা সত্যিই উদ্বেগজনক।

বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ। আমাদের একটি সংবিধান আছে। অপরাধ দমন ও সংঘটিত অপরাধের বিচার করার জন্য অনেক কঠোর আইন, সক্রিয় আদালত ও বেশ কিছু দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আছে। আছে বিশেষ আদালত ও চৌকস আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এতসব অনুষঙ্গ ক্রিয়াশীল থাকার পরও দেশে এখন পর্যন্ত মানবাধিকার পরিস্থিতি উদ্বেগজনকই রয়ে গেছে। যা কোনো স্বাধীন ও সভ্য সমাজের জন্য কোনোভাবেই ইতিবাচক নয়।

আমাদের দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি যে কত ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে তা দেশীয় মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিস কেন্দ্রের (আসক) সাম্প্রতিক প্রতিবেদন থেকে উপলব্ধি করা যায়। সংস্থাটি সম্প্রতি জানিয়েছে, বাংলাদেশে গত বছরের ১১ মাসে গড়ে প্রতিদিন একজন ব্যক্তি ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও হেফাজতে মৃত্যুর শিকার হয়েছেন। মানবাধিকার সংগঠনটির হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ মালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও হেফাজতে মৃত্যুর শিকার হয়েছেন ৩৬২ জন। এদের মধ্যে ১৭৯ জনই নিহত হয়েছেন পুলিশের গুলিতে বা তাদের হেফাজতে থাকা অবস্থায়। এর বাইরে ৯৭ জন র‌্যাবের হাতে, ৩১ জন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) হাতে এবং ৫৩ জন বিজিবির সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন।

রাজনৈতিক নেতা, মাদরাসা শিক্ষক, সাবেক সেনাসদস্যসহ বিদায়ী বছরে গুম হয়েছেন ১৩ জন। গুম হওয়ার পর ফিরে এসেছেন চারজন। পরে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে একজনকে। বাকি আটজন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। ফিরে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে সবশেষ ব্যক্তি সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান। আসকসহ দেশী-বিদেশী মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হিসাবে, গত এক দশকে দেশে গুমের সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়েছে।

আসকের হিসাব মতে, ২০১৯ সিলে যৌন হয়রানি ও সহিংসতা এবং ধর্ষণের শিকার নারীর সংখ্যাও অনেক। নারী নির্যাতনকারী হিসেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নামও এসেছে। এ ছাড়া সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। মতপ্রকাশে বাধার অভিযোগ ছিল বছরজুড়ে, অব্যাহত ছিল সীমান্ত হত্যা। সভা-সমাবেশে পুলিশি বাধার ঘটনা রাজধানীসহ সারা দেশেই ঘটেছে বছরজুড়ে। মূলত ২০১৯ সালটি শুরুই হয়েছে একটি বড় মানবাধিকার লঙ্ঘনের মধ্য দিয়ে। কিভাবে গণমানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে তা তারা সরাসরি প্রত্যক্ষও করেছে, যা গণতান্ত্রিক অভূতপূর্ব ও নজিরবিহীন।

মূলত দেশে গণতন্ত্রের বিচ্যুতি ও সরকারের জবাবদিহিতা না থাকায় বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর, ন্যায্য দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর এমনকি সভা-সমাবেশ করা বা ভিন্নমত প্রকাশের দায়ে নাগরিকদের ওপরও নির্যাতন-নিপীড়ন মাত্রা যেভাবে বেড়েছে তা কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্য নয়, বরং ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসনেরই পদধ্বনি। বিষয়টি বহির্বিশ্বে আমাদের মর্যাদাহানি করলেও সরকার বিষয়টি নিয়ে একেবারেই ভাবলেশহীন।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা শুধু আমাদের দেশে ঘটছে এমন নয়, বরং বিশে^র বিভিন্ন দেশেই কম-বেশি তা ঘটছে। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে তা একেবারে প্রান্তিকতায় নেমে এসেছে। যা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মানবাধিকার প্রতিবেদনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অবস্থাদৃষ্টে মানবাধিকারই এখন অধিকার হারিয়ে বসেছে। ভোটাররা হারিয়েছেন ভোট দেয়ার অধিকার। এর চেয়ে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন আর কী হতে পারে ?

smmjoy@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement