২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নোনা গুজবের কথকতা

-

নুনবিষয়ক অনেক কথার প্রচলন রয়েছে আমাদের সমাজে। যেমন- নুন আনতে পান্তা ফুরায়; নুন খাই যার, গুণ গাই তার; নুন খেয়ে নিমকহারামি ইত্যাদি। নুন বড় স্পর্শকাতর বস্তু। কেউ কারো বাড়ি গিয়ে পানীয় আহার্য দিয়ে উদরপূর্তি করে অকৃতজ্ঞের মতো যদি আচরণ করে, তাতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু কেউ কারো নিমক বা নুন খেয়ে ভুলে গেলে বা অস্বীকার করলে কপালে খারাবি আছে! লোকে তাকে ‘দুয়ো’ দেবে। বলবে ‘নিমকহারাম’। সামান্য একটু নুন, তা নিয়ে এত বড়ো খোঁটা! বিজ্ঞানীদের মতে, সারা দিন একজন মানুষের জন্য ৫ গ্রাম নুনই যথেষ্ট। এই ৫ গ্রাম নুনের জন্য ‘৫ টন অপবাদ’! তাহলে বুঝুন, বাঙালি জীবনে তিন আঙুলের এক চিমটি নুনের কী মহিমা।

খ্রিষ্টের জন্মের অন্তত ছয় হাজার বছর আগে চীনারা মাটি খুঁড়ে লবণ বা নুনের উত্তোলন শিখেছিলেন। তখন থেকেই তারা নুন ব্যবহার করতেন। তবে নুন নিছক খাদ্যসহায়ক উপাদান হিসেবেই হাজার হাজার বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে না। এর বহুমাত্রিক ব্যবহার বিস্ময়কর। প্রাচীন অরণ্যচারী মানুষ গোশত সংরক্ষণে নুন ব্যবহার করতেন। মিসরীয়রা মমি তৈরিতে নুন ব্যবহার করেছিলেন। নুনের সাথে কৃতজ্ঞতা ও অকৃতজ্ঞতার সম্পর্ক সম্ভবত মিসরীয়রাই তৈরি করে দিয়েছিলেন। তারা দুই দলের মধ্যে সন্ধি করার আগে একে অপরকে নুন খাইয়ে দিতেন। মানে, তুমি যদি এখন কথা না রাখো, তাহলে নিমকহারামি হবে।

নুন মূলত সোডিয়াম ক্লোরাইড। এতে ৪০ ভাগ সোডিয়াম ও ৬০ ভাগ ক্লোরাইড থাকে। ক্লোরাইড আমাদের দাঁতের জন্য উপকারী। আবার ক্লোরাইডের মূল উপাদান ক্লোরিন জীবাণুনাশক। সোডিয়াম মানবদেহের খুবই প্রয়োজনীয় উপাদান। সোডিয়াম আমাদের স্নায়ুর কার্যক্রম সচল রাখে এবং মাংসপেশির সঙ্কোচন-প্রসারণে ভূমিকা রাখে। সোডিয়াম শরীরের জন্য দরকারি ‘ইলেকট্রোলাইট’। প্রতিদিন আমাদের শরীরে এক থেকে আড়াই হাজার মিলিগ্রাম সোডিয়ামের প্রয়োজন। জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সব ইলেকট্রোলাইট, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও ক্যালসিয়াম লবণে পাওয়া যায়। শরীরে নুন বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়া- দু’টিই বিপজ্জনক। তবে বাংলাদেশের মানুষের নুনপ্রীতি নিয়ে চিকিৎসকেরা খুবই আতঙ্কিত। যেখানে একজন মানুষের দৈনিক ৫ গ্রাম নুন খাওয়া উচিত, সেখানে বাংলাদেশের মানুষ ৬-১০ গ্রাম লবণ খাচ্ছে। ফলে বেড়ে যাচ্ছে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ঝুঁকি।

ব্রিটিশ ভূতাত্ত্বিক জরিপের (বিজিএস) প্রদত্ত তথ্যমতে, বাংলাদেশ নুন উৎপাদনে ২৭তম। পৃথিবীর ০.৫২ শতাংশ নুন বা লবণ বাংলাদেশ উৎপাদন করে। প্রাচীনকাল থেকে বাংলায় সমুদ্রের পানি শুকিয়ে নুন উৎপাদন হয়ে আসছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের মুলঙ্গী নামের একটি সম্প্রদায় কক্সবাজার থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত বিস্তীর্ণ উপকূলাঞ্চলে এ প্রক্রিয়ায় নুন উৎপাদন করে আসছিল। বর্তমানে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খুলনা, সাতক্ষীরা অঞ্চলে সমুদ্রের পানি শুকিয়ে ডিসেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত নুন উৎপাদন করা হয়। নুন একান্তই আমাদের খাদ্যপদ। পান্তা ভাতের সাথে একটু নুন পেয়ে গেলে আমরা যেন কোনো প্রকারে বর্তে যাই। সাধারণ মানুষের লড়াই শিউলি ফুলের মতো সাদা ভাতের পাশে মতিচূর্ণের মতো সাদা একটু খানি নুনের সংস্থাপন করা। কিন্তু বিধিবাম। এই নুনও নির্ভেজাল পাওয়ার অধিকার যেন আর নেই। এতে ভেজাল দেয়া অবশ্য আজকালকার ব্যাপার নয়। মধ্যযুগে নুনের খাদ্যমান বাড়ানোর জন্য পর্তুগিজরা সামুদ্রিক কড মাছের তেল এতে মিশিয়ে দিত। এখন মেশানো হয় আয়োডিন। মানুষের শরীরে আয়োডিনের অভাব পূরণে নুন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সে সময় নুনে বাড়তি জিনিসের মিশ্রণ ছিল সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে। কিন্তু বাংলাদেশে অসৎ ব্যবসায়ীরা নুনে ভেজাল মিশিয়ে জাতির সাথে করছেন চরম নিমকহারামি। বিদেশ থেকে কম দামে আনা সোডিয়াম সালফেট (‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল সল্ট’) সাধারণ নুনের সাথে মিশিয়ে প্যাকেটজাত করে বিক্রি করা হচ্ছে। ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত পরিমাণের চেয়ে কম আয়োডিন দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তাই নুন খেয়ে আমরা নিশ্চিত থাকতে পারছি না। বলতে পারছি না- ‘বাজারের বিশুদ্ধ নিমকে চিরদিন কৃতজ্ঞতা দেখিয়ে যাবো।’

নুন নিয়ে সপ্তাহখানেক আগে গুজব রটে ছিল। দেশে নুনের সঙ্কট চলছে। আর যায় কোথায়? মুঠোফোন ও ফেসবুকে মুহূর্তে চাউর হয়ে যায় সেই রটনা। ফলে নুনের দর হু হু করে যায় বেড়ে। কারণ ছাড়া হঠাৎ করে দাম এত বেড়ে যাওয়ার খবর শুনে সবার চোখ চড়কগাছ। এমনিতে পেঁয়াজের দাম ‘আকাশে ওঠা’য় নাভিশ্বাস। তার ওপর নুনের এমন বাজারদর। খবরে সবাই দিশেহারা হয়ে ছোটেন নুন কিনতে। হুমড়ি খেয়ে ভিড় জমালেন মুদি দোকানে। একসাথে এত নুনের চাহিদার জোগান দিতে কোনো কোনো ছোট দোকানিকে হিমশিম খেতে হলো। আবার অনেকেই বেশি মুনাফার আশায় অপকৌশলের আশ্রয় নিতে থাকেন। হঠাৎ এমন কাণ্ডে হুলস্থুল পড়ে যায়। নুন নিয়ে সৃষ্টি হয় দেশজুড়ে অস্থিরতা। স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশে নুনের সঙ্কট দেখা দিয়েছিল। ওই বছরের প্রথম দিকে বাংলাদেশে নুনের ‘দুর্ভিক্ষ’ দেখা দেয়। প্রতি সের নুনের দর লাফিয়ে লাফিয়ে ওপরে উঠে একেবারে আকাশছোঁয়া হয়েছিল। অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে হয়তো গুজবে কান দিয়ে নুন কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন সাধারণ মানুষ। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং বিসিকের পক্ষ থেকে বলা হয়, দেশে পর্যাপ্ত নুন মজুদ রয়েছে। গুজবে কান না দিয়ে ‘প্রয়োজনের বেশি না কেনা’র আহ্বান জানানো হয়।

বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে উৎপাদিত লবণে বৃহৎ নুনশিল্প গড়ে উঠেছে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে সমুদ্রের লোনাপানি দিয়ে লবণ উৎপাদিত হয়ে আসছে। খুলনা ও সাতক্ষীরা অঞ্চলেও এখন নুন উৎপাদন হয়। আগে মানুষ সমুদ্রের পানি চুলায় জ্বাল দিয়ে বা রোদে শুকিয়ে (সৌরপদ্ধতিতে) নুন উৎপাদন করত। ২০০০-২০০১ সাল থেকে পলিথিন পদ্ধতিতে নুন উৎপাদন শুরু হয়। সনাতন পদ্ধতিতে একরপ্রতি লবণের উৎপাদন ছিল ১৭ দশমিক ২৫ টন এবং নতুন পদ্ধতিতে প্রতি একরে ২১ টন। এ পদ্ধতিতে সনাতন পদ্ধতির চেয়ে ৩৫ শতাংশ বেশি এবং আন্তর্জাতিক মানের নুন উৎপাদিত হচ্ছে, যা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি করার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

সত্যের সাথে মিথ্যার মিশ্রণে গুজবের জন্ম। সত্যের ছিটেফোঁটা থাকলে গুজবের ডালপালা গজিয়ে মহীরুহ হয়ে ওঠে। গুজব সত্যের ওপর বসে নিজেই ‘সত্যের’ রূপ ধারণ করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে থাকে। গড্ডলিকা বা ভেড়ার সাথে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক মিল আছে। সামনের গড্ডলাটি যেদিকে যায়, পেছনের সবগুলো এর পিছু নেয়। গুজবের প্রভাবেও মানুষের দল কিভাবে ভেড়ার পালের মতো অন্ধ আচরণ করতে পারে, তা নুনের দোকানে লাইন পড়ায় ফের বোঝা গেল এবার। পেঁয়াজের ঝাঁজে যে ক্ষত হয়েছে, তার ব্যথা আজো সারেনি। পেঁয়াজের সঙ্কট যেহেতু সত্য, সেহেতু সেই সত্যের ওপর নুনের গুজব সহজেই ভর করতে পেরেছে। অতিরিক্ত চাহিদা তৈরি হওয়ায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাড়তি দামে নুন বিক্রি হয়েছে। সর্বোচ্চ ৩৫ টাকা কেজি দরের নুন ৫০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। কপাল ভালো, নুনের গুজব দ্রুত সামাল দেয়া গেছে। তবে নুন নিয়ে গুজব বেশি ছড়াতে পারেনি বলে আত্মপ্রসাদের কিছু নেই। এরই মধ্যে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে সিন্ডিকেট নামের অদৃশ্য শক্তিটি পেঁয়াজ বিক্রি করে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে নিলো, তার ক্ষতি পূরণ হবে কিভাবে? সত্য-মিথ্যার বিভেদ ধরতে পারে না সে সমাজ, সেটি গুজবের জন্য আদর্শ আঁতুড়ঘর। এদেশে কোনো কথাকে ‘সত্য’ হয়ে উঠতে শুধু হাজার কয়েক মেসেজ শেয়ার করাই যথেষ্ট। মানুষ যেহেতু ভয় পেতে ভালোবাসে, তাই ভীতিকর খবর অবিশ্বাস করার মনের জোর তার কমই থাকে। যারা গুজব রটায়, তারা মনুষ্য মনস্তত্ত্বের এই দিকটিই ব্যবহার করে। তার জন্য অবশ্য সত্যের কিছুটা পুঁজি লাগে। সরকার যতই কঠোর হওয়ার হুমকি দিক, তাতে গুজবের প্রাবল্য কমবে কি না, নতুন গুজব ছড়ানো বন্ধ হবে কি না; তা বলা মুশকিল। গুজব জন্ম নিতে যতটুকু সত্য ঘটনার দরকার, তা যাতে না ঘটে, সেদিকে সর্বাদাই তীক্ষè নজর রাখা সরকারের পক্ষ থেকে অতীব জরুরি।

camirhamza@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement