২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কাঠগড়ায় প্রেসিডেন্টের মৃত্যু ও রোহিঙ্গা ইস্যু

- ফাইল ছবি

জনগণের ভোটে নির্বাচিত মিসরের প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুরসি গত ১৭ জুন বিচারকের উপস্থিতিতে আদালতে শুনানি চলাকালে কাচঘেরা বুলেট প্রুফ বন্দিখাঁচায় মৃত্যুবরণ করেছেন। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েম করার কারণে সেনাপ্রধান আবদুল ফাত্তাহ সিসি ক্ষমতার লোভে ড. মুহাম্মদ মুরসিকে হামাসের সাথে গোপন আঁতাতের অজুহাতে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করান। প্রচলিত নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে সাময়িক জান্তা মুরসিকে কারাগারে মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে তিলে তিলে জীবননাশের দিকে নিয়েছিল। মুরসির মৃত্যুকে কেউ বলেছেন একটি সিংহের মৃত্যু, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরগোদান বলেছেন মুরসি শাহাদতবরণ করেছেন, কাতারের আমির শায়খ তামিম বিন হামদ আস সানি, মালয়েশিয়া, ইরান মুরসির মৃত্যুতে শোক জানালেও মুসলিম অন্যান্য রাষ্ট্র প্রকাশ্যে শোক বা নিন্দা কোনো কিছুই জানায়নি। অথচ ৫৭টি মুসলিম রাষ্ট্র পৃথিবীতে রয়েছে। একটি রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ যে কখনো কখনো নির্যাতনের হাতিয়ার বা রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহার হতে পারে, মুরসির মৃত্যুই এর স্পষ্ট প্রমাণ।

পাক-ভারত উপমহাদেশে নিকট অতীতের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী তিনজন নেতা ভূমিকা ও সিদ্ধান্তে নির্ধারিত হয়েছে জনগণের ভাগ্য। সে তিনজনের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বাপর ঘটনার যারা ছিলেন কেন্দ্রবিন্দু, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও ইন্দিরা গান্ধী নিহত হয়েছেন নিরাপত্তাবাহিনীর লোকজনের হাতে এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর মৃত্যু হয়েছিল আইনের গ্যাঁড়াকলে। বাংলাদেশে ক্ষমতায় থেকে ক্ষমতার স্বাদ নেয়া এমন কোনো ব্যক্তি নেই যারা কারাগারের অতিথিশালায় ‘অতিথি’ হননি, সেখানে ৩০ টাকার ইফতারি সবার জন্যই জুটেছে। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণকারী শীর্ষস্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা খোন্দকার মোশতাক জেল খেটেছেন এবং একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী এখনো খাটছেন, যার মুক্তির ব্যাপারে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর প্রচণ্ড অনাগ্রহ। দুই নারী প্রধানমন্ত্রী (সাবেক ও বর্তমান) একই সাথে জেল খেটেছেন। তবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সাজা হওয়ার রায় কী নির্মম, সে কঠিন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হননি। প্রতাপশালী এরশাদ জেলের স্বাদ পুরোটাই গ্রহণ করেছেন, যিনি এখন ভিন জগতের পথযাত্রী। আল্লাহপাক তাকে হায়াত দারাজ করুন। জেলখানার অতিথিশালায় যেতে হয়নি সেসব রাষ্ট্রপতিকে, যাদের ‘কামড় দেয়ার মতো নখ বা দাঁত’ ছিল না এবং যাদের কাজই ছিল শুধু জি স্যার বলা।

বিচারপতি সাহাবুদ্দীন, আহমদ একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে যথেষ্ট প্রতাপ খাটিয়েছেন। তিনিও বলেছিলেন যে, মিলাদ মাহফিলে অংশগ্রহণ এবং মাজার জিয়ারত করা ছাড়া বাংলাদেশের সংবিধান মোতাবেক রাষ্ট্রপতির অন্য কোনো কাজ নেই। কিছু রাষ্ট্রপতি ছিলেন যারা সুনাম-দুর্নাম কিছুই কামাতে পারেননি। তবে বিএনপি দলের প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব ডা: বি চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে বিদায় নিতে হয়েছে বাধ্যতামূলক পদত্যাগের মাধ্যমে। কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়ে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছেন ‘১/১১’ সময়ের রাষ্ট্রপতি পদ-পদবির বদনাম, সুবোধ বালক ইয়াজউদ্দিন। স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে মাঠে ময়দানে দৌড়ে বেরিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে যিনি মেজর র‌্যাংকের একজন সেনা কর্মকর্তা হয়েও বিরাট রাজনৈতিক বার্তা দিয়েছিলেন। তিনিও হত্যার শিকার হয়েছেন তার সহকর্মী একটি সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনীর কিছু লোকের দ্বারা, যারা ছিল রাষ্ট্রপতি জিয়ার নিরাপত্তার দায়িত্বে। রাষ্ট্রনায়ক বা রাষ্ট্রপতি হলে হত্যার শিকার হতে হবে, জেল খাটতে হবে বা নির্মম পরিণতির জন্য অপেক্ষা করতে হবেÑ এটা আজকের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু নয়, বিষয়বস্তু অন্য।

দীর্ঘকাল ধরে শোনা যাচ্ছে, বিচার বিভাগ স্বাধীন। কিন্তু বাস্তবতা পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা যেন একটি লজ্জাবতী গাছের মতো, একটু স্পর্শ করলেই নুয়ে পড়ে, যা ভুক্তভোগী জনগণ মোটেই কামনা করে না। সরকার যে আইন করবে বা সরকার মামলাটি যেভাবে সাজিয়ে দেবে সে সাজানো পুতুলের গায়ে রং-তুলি মাখানো বিচার বিভাগের দায়িত্ব নয়। বরং রাজনৈতিক মামলায় আদালত থেকে মানবিক আচরণ যদি পেতে হয়, তা পাওয়ার একমাত্র হকদার অভিযুক্ত ব্যক্তি, যাদের ক্ষমতাসীনরা কারামুক্ত রাখতে পছন্দ করে না।

মিসরের প্রধান বিচারপতি যদি মুহাম্মদ মুরসির প্রতি নির্মম না হতেন, যদি তাকে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করার সুযোগ না দেয়া হতো, তবে হয়তো বিচারকের সামনেই দেহ থেকে তার রূহ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত না। সম্প্রতি ২৮ বছর আগে সংঘটিত একটি ঘটনায় অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীকে (শেখ হাসিনা) হত্যার উদ্দেশ্যে ট্রেন হামলার অভিযোগে, ৯ জনকে ফাঁসি এবং অনেকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। কোনো মানুষকে হত্যার জন্য বোমা-গুলি বা আক্রমণ করাকে সমর্থন করি না, বরং নিন্দা করি। তার পরও এ ঘটনায় ৯ জনের ফাঁসি দৃষ্টিকটু বৈকি, যদিও তা বলা যাবে না, কারণ আদালতের সমালোচনা করা মানা। কথায় বলে, আদালতই মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল।

ক্ষমতায় থাকলে কারো কোনো অপরাধ ধর্তব্য নয়, রাষ্ট্রের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সবই ক্ষমতাসীনদের মনোরঞ্জনে নিজেকে বিলিয়ে দিতে হয়। ক্ষমতাচ্যুত হলেই রাষ্ট্রীয়যন্ত্র ক্ষমতা দখলকারীকে তুষ্ট রাখার জন্য ক্ষমতাচ্যুতদের বিচার শুরু করে। তবে প্রতীয়মান হয়, উদ্দেশ্য থাকে ন্যায়বিচার নয় বরং ক্ষমতাসীনদের খুশি করা। এ অবস্থা সমগ্র পৃথিবীতে; তাই মানবতা বা নৈতিকতার অবস্থান রয়েছে শুধু মুখে মুখে।

আমরা মধ্যযুগীয় বর্বরতা, প্রাক-ইসলামী যুগ তথা আইয়ামে জাহেলিয়াতের বর্বরতার কথা শুনেছি। মানুষ যখন আগুনের ব্যবহার শেখেনি, মানুষ যখন কাঁচা মাংস ভক্ষণ করত, সে সময়ের বর্বরতার কথা শুনেছি। এখনো শুনছি পৈশাচিক, অমানবিক ও বর্বরতার কাহিনী। তবে পৃথিবীতে এখন যে বর্বরতা চলছে, তা অতীতে যেকোনো বর্বরতাকে হার মানিয়েছে। রাষ্ট্রীয় নির্দেশে মানুষ হত্যা, আগেও ছিল এখনো চলছে কোটারি স্বার্থের কারণে এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতায়। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন যেকোনো নির্মম ঘটনার চেয়ে কম নারকীয় নয়। জাতিসঙ্ঘ চিৎকার করে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের কথা বললেও মনে করা যায়, রোহিঙ্গারা শুধু মুসলমান হওয়ার কারণে তাদের সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। অন্য দিকে, পৃথিবীর বৃহৎ শক্তিগুলো কার্যত মুসলমানদের বিপক্ষে। এ ছাড়া গণতন্ত্র যাতে রাজতন্ত্রের সিংহাসন দখল করতে না পারে এ জন্য মুসলিম রাষ্ট্রের মুসলমান রাজা বা সুলতানরা অমুসলিম রাষ্ট্র তথা ব্রিটেন, আমেরিকা, চীন, ফ্রান্স প্রভৃতি রাষ্ট্রের কর্ণধারদের ভোগ বা সেবাদানে ব্যস্ত। এ কারণে মুরসির মৃত্যুতে যে পরিমাণ প্রতিবাদ মুসলিম বিশ্ব থেকে হওয়া উচিত ছিল, তা মোটেই হয়নি।

রোহিঙ্গা পুনর্বাসনে সৌদি বাদশাহসহ ইসলামী বিশ্ব বা ওআইসি যে ভূমিকা রাখার কথা ছিল, তা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে নতুন করে ষড়যন্ত্রের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তা হলো, রাখাইন অঞ্চল বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত করা। প্রস্তাবটি ভারতের পক্ষ থেকে উঠেছে। সংবিধান মোতাবেক ভারত একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। কিন্তু বাস্তবে এটি চরম হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র এবং দুঃখজনক হলেও সত্য, সে ভারতের বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকেই কথিত অসাম্প্রদায়িকতার বাণী শুনতে হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছে, তাদের পুনর্বাসনের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রে প্রধানমন্ত্রী নিজেও যাচ্ছেন। অবশ্য বিষয়টি সমাধানের জন্য বিএনপিসহ সর্বদলীয় সভা ডেকে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের তিনি উদ্যোগ নিতে পারতেন। তিনি একাই সমাধানের কৃতিত্ব পাওয়ার জন্য হয়তো তা করা হয়নি।

কিন্তু তা শুধু একক ক্রেডিট বা বাহাবা নেয়ার বিষয় নয়, বরং জাতীয়ভাবে প্রাধান্য দেয়া বাঞ্ছনীয়, যা পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রে হয়ে থাকে। এ দিকে চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াং প্রদেশে মুসলিম শিশুদের পরিবার থেকে চীন সরকার আলাদা করে দিয়েছে। তাদের আচরণ, ধর্ম বিশ্বাস ও ভাষা বদলে দিতেই সরকার এহেন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে গবেষকরা মনে করেন। ভারতে ‘জয় শ্রীরাম’ না বলায় ১১ বছর বয়সী মাদরাসার ছাত্রকে মারধর করা হয়েছে। নোবেল বিজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘জয় শ্রীরাম’ মানুষ পেটানোর সেøাগানে পরিণত হয়েছে। চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের ১০ লাখ মুসলিমকে বন্দিশিবিরে আটকে রাখা হয়েছে। শ্রীলঙ্কায় মুসলিমবিদ্বেষ ক্রমেই বেড়ে চলেছে, কিন্তু এর প্রতিবাদে বিশ্ব মুসলিম নেতৃত্বের এরদোগান ছাড়া প্রায় সবাই রয়েছেন নীরব দর্শকের ভূমিকায়।

ভারতের হিন্দুত্ববাদী মনোভাব বাংলাদেশের অনেক সমস্যার সমাধান না হওয়ার মূল কারণ। সব সমীক্ষা আলোচনা-পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল। তাহলে প্রায় সব আন্তর্জাতিক বিষয়ে বিশেষ করে পানি বণ্টনের ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার জন্য চাতক পাখির মতো বাংলাদেশকে ভারতের দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো না। অন্য দিকে স্বাধীনতার জন্য একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের প্রয়োজন হতো না, বাংলাদেশ স্বাভাবিকভাবেই শক্তিশালী থাকত। রাজনীতির গ্যাঁড়াকলে এ দেশকে বারবার অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। যদি কোনো কারণে রাখাইনকে বাংলাদেশের অংশ করে দেয়া হয়, তবে এটা হবে আমাদের জন্য একটি বিষফোঁড়া। রাষ্ট্রীয়ভাবে কিছু দিন পরপর বিভিন্ন অজুহাতে রোহিঙ্গাদের ওপর নানাভাবে নির্যাতন চালানো হচ্ছে।

রাষ্ট্র তাদের ভোটাধিকারসহ নাগরিকত্ব হরণ করেছে, ফলে রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমারের প্রতি বিশ্বাস বা আস্থা রাখার যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ নেই। রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজন আলাদা ভূখণ্ড। জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে রাখাইন ভূখণ্ডে যদি স্বায়ত্তশাসনসহ জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা বাহিনীর তত্ত্বাবধানে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করা যায়, তাই হবে তাদের জন্য নিরাপদ স্থান। অন্যথায় সময়ে সময়ে ‘অহিংস’ বৌদ্ধদের হিংসার শিকারে মুসলিম রোহিঙ্গারা হবে ক্ষতবিক্ষত। পর মাস, অন্য দিকে গেরুয়া পোশাকি বৌদ্ধদের লালসা মেটানোর জন্য হয়তো রিজার্ভ থাকতে হবে অসহায় রোহিঙ্গা নারীদের। প্রতিকারের জন্য জাতিসঙ্ঘ উদ্যোগ জানাবে, বাস্তবে কিছুই হবে না, যেমনটি হয়নি এর আগে কখনো।

লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবী
চেয়ারম্যান, ‘গণতন্ত্র ও বেগম খালেদা জিয়া মুক্তি আইনজীবী অন্দোলন’
taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement