২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সভ্যতার সঙ্ঘাত ও নিউজিল্যান্ড ট্র্যাজেডি

-

নিউজিল্যান্ড ট্র্যাজেডি সাম্প্রতিক বিশ্বরাজনীতি ও ভাবনা-চিন্তায় এক নতুন মাত্রা তৈরি করেছে বলে মনে হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ায় জন্মগ্রহণকারী ব্রেন্টন ট্যারান্ট গত ১৫ মার্চ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে জুমার নামাজের সময় দু’টি মসজিদে একযোগে আক্রমণ করেন। বিভিন্ন ঐতিহাসিক পরিচয় ও যুদ্ধের নাম আঁকা পাঁচটি বন্দুক ব্যবহার করে সেখানে ৫০ জনকে হত্যা করেছেন তিনি। প্রথমবারের মতো এক সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদীকে এভাবে সন্ত্রাসী হত্যাযজ্ঞ ঘটাতে দেখা গেল। হামলাকারী ইতিহাসের বিভিন্ন পর্ব থেকে যে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন, তা ভারত-রাশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধৃত।

‘শান্তির দেশ’ হিসেবে পরিচিত নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দু’টি মসজিদে ৫০ জনের এই নির্মমভাবে প্রাণ হারানোর ঘটনার ব্যাপারে নিউজিল্যান্ডের জাস্টিন সরকারের পদক্ষেপ ছিল বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ও মানবিক। এই ঘটনা নিছক বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী ঘটনা হলে এর একধরনের তাৎপর্য থাকত। কিন্তু এই ঘটনা যিনি ঘটিয়েছেন, সেই লোকটি সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদের বর্ণবিদ্বেষী আদর্শের ধারক। তার এই কর্মকাণ্ডের আদর্শিক ভিত্তি হিসেবে ৭৪ পৃষ্ঠার এক ইশতেহার অনলাইনে প্রকাশ করেছেন। সে নির্মম হামলার ভিডিও নিজে রেকর্ড করে তা অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়ার স্পর্ধা দেখিয়েছেন। হামলার আগে ট্যারান্ট তার ইশতেহার অনেকের কাছে পাঠান, যাদের মধ্যে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীও ছিলেন। ট্যারান্ট তার আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য তুরস্ক ও পাকিস্তানে অনেক সময় কাটিয়েছেন। এসব বিষয়ে রাখঢাক না করেই তিনি তার বক্তব্য প্রকাশ করেছেন ইশতেহারে এবং টুইটার-ফেসবুক ওয়ালে।

ট্যারান্টের অস্ত্রের ওপর লেখা এবং তার ৭৪ পৃষ্ঠার অনলাইন ম্যানিফেস্টোতে হান্টিংটনের বহুলালোচিত ‘সভ্যতার সংঘর্ষ’ তত্ত্বে¡র বর্ণনাও রয়েছে। এতে খ্রিষ্টানজগৎ এবং ইসলামের মধ্যকার ক্রুসেডের বর্ণনাও রয়েছে। তুর্কি খেলাফতের সাথে রাশিয়া এবং বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশের যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়, এর খ্রিষ্টান অধিপতিদের নায়ক হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি। তার অসুস্থ মনের মধ্যে এই দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে বলে মনে হয় যে, ট্যারান্ট নিজেই তার কল্পিত মুসলিম ‘আগ্রাসন’কে থামানোর মিশন বা মহাযুদ্ধের একজন ক্রুসেডার।

সমস্যাটি হলো ঐতিহাসিক চিত্র ও ঘটনাগুলোকে তিনি অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখেছেন এবং বিশ্বাস করেছেন যে, খ্রিষ্টান ও ইসলামী বিশ্বের মধ্যে স্পষ্ট এক টেকটোনিক ফল্ট লাইন রয়েছে। আর তারা একে অপরের সাথে ক্রমাগতভাবে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতে লিপ্ত। বাস্তবতা কিন্তু সে রকম নয়। তুর্কি খেলাফত এবং রুশ সাম্রাজ্যের মধ্যে বহু বছর ধরে বিভিন্ন সময় অনেক যুদ্ধ হয়েছে। এসব যুদ্ধ রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের বা জাতির সাথে জাতির স্বার্থগত কারণে ঘটেছে। এ ধরনের যুদ্ধ একাধিক খ্রিষ্টান বা মুসলিম দেশের মধ্যে আগেও হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। এগুলোকে কোনো পক্ষ ‘ধর্মযুদ্ধ’ হিসেবে নেয়নি। কিভাবে ট্যারান্ট ইতিহাসকে ভুলভাবে গ্রহণ করেছেন, তার একটি উদাহরণ নিচে রয়েছে। এ রকম ঘটনা আরো অনেক।

১৯১২ সালের প্রথম বলকান যুদ্ধে একযোগে অটোমান বা তুর্কি সাম্রাজ্যকে পরাজিত করার (তার একটি রেফারেন্স যা ট্যারান্ট বন্দুকের ওপরও লিখেছিলেন) পরের বছর গ্রিস ও সার্বিয়া রোমানিয়াসহ তাদের সহযোগী বুলগেরিয়াকে লক্ষ্যবস্তুতেপরিণত করে কয়েকটি অঞ্চল দখলে নেয়। এর মাত্র দুই বছর পরে, বুলগেরিয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সংযুক্ত শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সাবেক মুসলিম ‘মাস্টার’ তুরস্কের সাথে যোগ দিয়েছিল।

ধর্ম ও সভ্যতার চেয়ে রাজনৈতিক বিবেচনা, আত্মবিশ্বাস ও লোভের মতো আরো অনেক কারণ আছে; যা যুদ্ধ ও সংঘর্ষের সৃষ্টি করে থাকে। ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে শত শত বছর ধরে যুদ্ধ-সঙ্ঘাত চলেছে; অথচ ধর্মবিশ্বাসে দু’টি দেশ একই। হান্টিংটন দু’টিকে ‘একই সভ্যতার দেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এ রকম আরো অনেক উপাদান ট্যারান্টের উল্লেখ করা বিষয়ের মধ্যে রয়েছে, যা প্রকৃতপক্ষে ধর্মীয় সভ্যতা বা বিশ্বাসের সঙ্ঘাতের সাথে মেলে না।

আদর্শতাড়িত একটি গোষ্ঠী যখন কোনো পরিকল্পিত সন্ত্রাসের সাথে যুক্ত হয়, তখন এর গুরুত্ব বা তাৎপর্য ভিন্নমাত্রা লাভ করে। আর সে আদর্শের বিকাশকেন্দ্র যদি খোদ যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদেশগুলো হয়, তাহলে বিপদের আশঙ্কা আরো বেড়ে যায়; ট্যারান্টের ঘটনার সাথে আলোচিত অনেক ধারণার সংশ্লিষ্টতা চলে আসে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি আলোচিত তত্ত্বটি হলো হান্টিংটনের ‘সভ্যতার সঙ্ঘাত’ তত্ত্ব।

সভ্যতার সঙ্ঘাত তত্ত্ব এমন একটি ধারণা, যাতে বলা হয় স্নায়ুযুদ্ধের পর ভবিষ্যতের যুদ্ধ এক বা একাধিক দেশের মধ্যে হবে না, লড়াই হবে সংস্কৃতি বা সভ্যতার মধ্যে। জনগণের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিচিতি সংঘর্ষের প্রাথমিক উৎস হতে পারে। আমেরিকার রাজনীতিবিজ্ঞানী স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন এই তত্ত্ব¡ দিয়েছেন। তিনি আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটে ১৯৯২ সালে এক বক্তৃতায় বিষয়টি তুলে ধরেন। তার প্রাক্তন ছাত্র ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার লেখা ১৯৯২ সালের ‘ইতিহাসের সমাপ্তি এবং শেষ মানুষ’ শীর্ষক এক বইয়ের প্রতিক্রিয়ায় ১৯৯৩ সালে লেখা পররাষ্ট্র নীতিবিষয়ক নিবন্ধ ‘দ্য ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশনস’ শিরোনামে হান্টিংটনের তত্ত্বটি প্রকাশিত হয়। হান্টিংটন ১৯৯৬ সালে তার বই ‘দ্য ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশনস অ্যান্ড দি রিমার্কিং অব ওয়ার্ল্ড অর্ডার’-এ তার থিসিসকে আরো প্রসারিত করেন।

হান্টিংটন বিশ্বকে মোটা দাগে ৯টি সভ্যতায় ভাগ করেন। বিভাজনটি এ রকম : প্রথমটি হলো পশ্চিমা সভ্যতা, যার মধ্যে তিনি রেখেছেন যুক্তরাষ্ট্র কানাডা অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ড ও পশ্চিম ইউরোপকে। দ্বিতীয়টি হলো অর্থোডক্স রাশিয়া এবং এর প্রভাবিত অঞ্চল, এর পর তিন নাম্বারে রেখেছেন ইসলামী সভ্যতা, যার মধ্যে তিনি পুরো মুসলিমবিশ্বকে স্থান দিয়েছেন, এরপর বৌদ্ধ সভ্যতা যেখানে তিনি মঙ্গোলিয়া তিব্বত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ও শ্রীলঙ্কাকে রেখেছেন। এর পরের সভ্যতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন হিন্দু বলয়কে, যার মধ্যে রয়েছে ভারত ও নেপাল। এরপর আফ্রিকার অমুসলিম কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত দেশগুলো এবং ল্যাটিন আমেরিকার কয়েকটি কৃষ্ণাঙ্গ দেশকে চিহ্নিত করেছেন ‘আফ্রিকান সভ্যতা’ হিসেবে। তার পরে মেক্সিকো ও দক্ষিণ আমেরিকার অকৃষ্ণাঙ্গ বাকি দেশগুলোকে ল্যাটিন আমেরিকান সভ্যতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এর বাইরে ম্যান্ডারিন ভাষাভাষী চীনকে চৈনিক সভ্যতা এবং জাপানকে পৃথকভাবে জাপানি সভ্যতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

সভ্যতার যে বিভাজন হান্টিংটন করেছেন তার মধ্যে অনেক বাস্তব উপকরণ যেমন রয়েছে, তেমনি বিশ্বকে বিভাজন করার এই ব্যবস্থার একটি রাজনৈতিক লক্ষ্যও রয়েছে বলে মনে হয়। একসময় বিশ্বকে প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিশ্ব হিসেবে বিভাজিত করা হতো প্রধানত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও শাসনপ্রক্রিয়াকে সামনে রেখে। স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে এই বিভাজন বেশি ব্যবহার হতো। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের পর স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে নতুন বিভাজনের প্রয়োজন দেখা দেয়। হান্টিংটন সেই বিভাজনেই সাড়া দিয়েছেন বলে মনে হয়।

এই বিভাজনের সুনির্দিষ্টভাবে অ্যাকাডেমিক অঙ্গন থেকে প্রথম প্রতিবাদ করেন যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এডওয়ার্ড সাঈদ। হান্টিংটনের এই তত্ত্বের প্রভাব যে অনেক সুদূরপ্রসারী, সেটি তার মতো অনেকেই তখন বুঝতে পেরেছিলেন। কারণ, শুধু যে সভ্যতার দ্বন্দ্ব আগামী বিশ্বের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়াবে- এমনটি বলে হান্টিংটন ক্ষান্ত হননি, একই সাথে সভ্যতার একটি শ্রেণীকরণও করে গেছেন। এই শ্রেণীকরণে যেখানে সুবিধা সেখানে ধর্মকে সভ্যতার ভিত্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আবার কোথাও সভ্যতাকে চিহ্নিত করেছেন ধর্মের বাইরের মূল্যবোধকে ভিত্তি করে। এডওয়ার্ড সাঈদ তার ২০০১ সালে ‘অজ্ঞানতার সংঘাত’ নামে এক লেখায় হান্টিংটনের থিসিসের পাল্টা বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, হান্টিংটন বিশ্বের স্থির ‘সভ্যতার’ শ্রেণীকরণের সময় আন্তঃনির্ভরতা এবং সংস্কৃতির মিথস্ক্রিয়ার গতিশীলতাকে বাদ দিয়েছেন। হান্টিংটনীয় আদর্শের দীর্ঘ সময়ের সমালোচক এবং আরব বিষয় নিয়ে স্পষ্ট বক্তব্য প্রকাশকারী এডওয়ার্ড সাঈদ (২০০৪) এ যুক্তিও দেন যে, সভ্যতার সঙ্ঘাত তত্ত্ব¡ হলো ‘বিশুদ্ধতম উগ্র জাতিবাদ, আরব এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিটলারি বিজ্ঞানের একধরনের প্যারোডি বা অনুসৃতি।’

নোয়াম চমস্কিও হান্টিংটনের সভ্যতার সঙ্ঘাতের ধারণার সমালোচনা করেছেন। তিনি এটাকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ‘নতুন কোনো নিপীড়ন চালিয়ে যাওয়ার বাহন’ হিসেবে দেখেছেন। ‘স্লায়ুযুদ্ধের অবসানের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের হুমকির কার্যকর অস্তিত্ব না থাকায় নতুন একটি হুমকি সামনে আনার প্রয়োজন ছিল বলে এই তত্ত্ব¡টি হাজির করা হয়’ মর্মে মত দেন উদারপন্থী এই ইহুদি ভাষাতাত্ত্বিক অধ্যাপক।

চমস্কি যে বিষয়টির উল্লেখ করে হান্টিংটনের তত্ত্বের সমালোচনা করেছিলেন; গত দুই দশকে বৈশ্বিক ঘটনাবলির প্রতি দৃষ্টি দেয়া হলে তার সাথে অদ্ভুত মিল খুঁজে পাওয়া যায়। কারো কারো ধারণা, এই সভ্যতার দ্বন্দ্বতত্ত্ব¡ পরবর্তীকালে আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করেছে। আবার কারো কারো ধারণা (চমস্কিও এটাই বলেছেন) অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রের বিতর্কিত আধিপত্যমূলক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখতে হান্টিংটনকে দিয়ে এই তত্ত্ব¡টি প্রদান করা হয়েছে। যেটিই সত্যি হোক না কেন, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জুনিয়র বুশের সময় যুক্তরাষ্ট্রের সূচিত সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের মূল ভিত্তি বলা হয় হান্টিংটনের সভ্যতার সঙ্ঘাত তত্ত্বকে। এরপরে ওবামার আমলে এই লড়াই কিছুটা গতি হারালেও ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর তা প্রবলভাবে প্রভাব ফেলে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে। অধিকন্তু সাদাদের শ্রেষ্ঠত্ববাদের যে তত্ত্ব¡ নিউজিল্যান্ডের কিলার ট্যারান্ট তার ইশতেহারে এবার প্রকাশ করেছেন, সেটি আমেরিকান জাতীয়তাবাদের মোড়কে প্রথম প্রকাশ্যে এনেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সম্ভবত এ কারণে নিউজিল্যান্ডে ক্রাইস্টচার্চের দুই মসজিদে নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটার পর এর নিন্দা জানাতে ট্রাম্পের ১০ ঘণ্টা সময়ের প্রয়োজন হয়েছে।

হান্টিংটনের সভ্যতার দ্বন্দ্ব যে বৈশ্বিক পর্যায়ে বড় ধরনের সঙ্ঘাতের সূচনা ঘটাতে যাচ্ছে, তা সমকালীন নেতাদের অনেকে উপলব্ধি করতে পেরেছেন বলে এডওয়ার্ড সাঈদ এবং নোয়াম চমস্কি হান্টিংটনের তত্ত্বের তাত্ত্বিক ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। অন্য দিকে, বিশ্ব নেতৃবৃন্দের অনেকে ‘সভ্যতার মধ্যে সংলাপ’ তত্ত্ব¡কে সঙ্ঘাতহীনভাবে বিশ্বকে এগিয়ে নেয়ার জন্য সামনে এনেছেন। সভ্যতাগুলোর মধ্যে সংলাপের এ তত্ত্ব¡ হান্টিংটনের তত্ত্ব দেয়ারও বেশ আগের। অস্ট্রিয়ান দার্শনিক হ্যান্স কোসলার ১৯৭২ সালে এই তত্ত্ব¡ দিয়েছেন। তিনি এ সময় সংস্কৃতির পরিচয়ের ওপর এক নিবন্ধ লেখেন। তিনি ইউনেস্কোর কাছে লেখা এক চিঠিতে বিভিন্ন সভ্যতার মধ্যে সংলাপের আয়োজন করার জন্য বিশ্বসংস্থাকে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান। ২০০১ সালে তদানীন্তন ইরানি প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ ইস্যুটি নিয়ে আসেন। তার প্রস্তাবেই জাতিসঙ্ঘ ২০০১ সালকে সভ্যতাগুলোর মধ্যে সংলাপ বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। ২০০৫ সালে স্পেনের প্রধানমন্ত্রী হোসে লুইস রড্রিগোয়ে জাপাতেরো এবং তুর্কি প্রধানমন্ত্রী রজব তাইয়েব এরদোগান জাতিসঙ্ঘের ৫৯তম অধিবেশনে অ্যালায়েন্স অব সিভিলাইজেশন উদ্যোগের প্রস্তাব করেন।

স্পেন ও তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী যখন সভ্যতাগুলোর মধ্যে সংলাপের উদ্যোগ এগিয়ে নেয়ার প্রস্তাব দেন, তখনো জর্জ বুশের ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ পুরোপুরি চলমান ছিল। এর আওতায় আফগানিস্তানে তালেবান শাসনের অবসানের পর সাদ্দামের ইরাকের বিরুদ্ধে অভিযান শেষ করে আনা হয়। এর পর আরো এক যুগ পেরিয়ে গেছে, কিন্তু ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ এখনো চলমান রয়েছে। কথিত সন্ত্রাসে যে পরিমাণ লোকক্ষয় ঘটেছে, সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা তার শত গুণ ছাড়িয়ে গেছে। এ ফাঁকে ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যে নিজের প্রভাব বলয়কে সুসংহত করে নিয়েছে।

এখন বিশ্বকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সংলাপ, সহযোগিতা ও সমন্বয়ের পথে বিশ্বব্যবস্থাকে এগিয়ে নেয়া হবে, নাকি সভ্যতাগুলোর মধ্যে সঙ্ঘাতের তত্ত্ব¡ নিয়ে বিশ্বের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াইকে গুরুত্ব দেয়া হবে। প্রথমটি চান সম্ভবত বিশ্বের বেশির ভাগ নেতা। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী এরই প্রতিনিধিত্ব করেছেন, যিনি মানবিকতাকে সবার ওপরে স্থান দিয়েছেন। তিনি ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে তার দেশের মুসলিম নাগরিকদের আলাদাভাবে দেখেননি। তার মতো ইউরোপের বেশির ভাগ নেতা বিশ্বে যে ব্রেটন ব্যবস্থা বা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চলমান ব্যবস্থাকে চলতে দিতে চান, তারা চান বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াকে সামনে এগিয়ে নিতে আর বিশ্ব পরিবেশকে ধনী-গরিব সবার জন্য সুরক্ষা করতে আনুপাতিক দায় গ্রহণ করতে; মুক্ত অভিবাসনকে উৎসাহিত করতে। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যান্ডের মতো অভিবাসীদের দেশে বসবাসের অধিকার ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা নির্বিশেষে সবার জন্য নিশ্চিত করতে, ইংরেজ অভিবাসীরা যেভাবে এসব দেশে আবাস গড়ে তুলেছেন, সেভাবে অন্যদের জন্যও দ্বার খোলা রাখতে। ট্যারান্টরা সেটি চান না বলেই সহিষ্ণু ধারার বিপরীতে উত্থান ঘটছে চরমপন্থার।

এই চরমপন্থা আইএস অথবা শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদ অথবা জায়নিজম বা হিন্দুত্ব চরমবাদ যেটিই হোক না কেন, তারা বিশ্বকে সঙ্ঘাতের দিকে নিতে চান। যুদ্ধ ব্যবসায়ী কিছু রাষ্ট্র বা ধনপতি ছাড়া আর কেউ শেষ পর্যন্ত এ ব্যবস্থা থেকে লাভবান হবে না। বিশ্বসভ্যতাকে এগিয়ে নিতে হলে সভ্যতাগুলোর মধ্যে সংলাপের কোনো বিকল্প নেই। সংলাপ ও সহযোগিতার মাধ্যমে বিশ্বকে একটি নিয়মনীতি ও ভারসাম্যপূর্ণ এবং সবার অধিকারের প্রতি সম্মানের পথে নিয়ে যেতে হবে।
mrkmmb@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement