২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মেঘনা নদীর পাড়ে

-

শিলা, আল্লাহ যদি আমার কপালে তোমাকে রাখতেন! আবেগ মাখা সুরে আসিফ বলল।
তো? শিলার নিরুত্তাপ প্রশ্ন।
আমি রাত-দিন তোমাকে বুকের মাঝে আগলে রাখতাম! আর পুতুলের মতো সাজিয়ে রাখতাম।
এ রকম সবাই বলে! শিলা যেন মুচকি হাসি দিলো।
আচ্ছা বাদ দাও, যা হয়নি তা নিয়ে আর কথা বাড়াতে চাই না। তোমাকে জীবনের নায়িকা করা তো এখন সম্ভব নয়। তোমাকে আমার উপন্যাসের নায়িকা করতে চাই!
ঠিক আছে। তাই হোক। তবে অবশ্যই দূরত্ব বজায় রেখে।
আচ্ছা। এখন থেকে তুমি আমার বন্ধু হবে। আমার লেখার অনুপ্রেরণা হবে ।
হুম।
আশ্চর্য আমার সব কিছুতেই তুমি হ্যাঁ করছ কেন?
আমাদের মেয়েদের ‘না’ করার ক্ষমতা আছে নাকি? তা ছাড়া আমি আপনাকে বিশ্বাস করি।
এত অল্প সময়ে বিশ্বাস করে ফেললে? আমি খারাপও তো হতে পারি?
বিশ্বাস করেছি এটা জানি। ভালো আর খারাপ এতে কিছু আসবে যাবে না। আমার যা ক্ষতি হওয়ার তা আগেই হয়ে গেছে। আপনি আর কিই বা ক্ষতি করবেন?
আচ্ছা। একটা কথা বলা হয়নি। আমি কিন্তু বিবাহিত!
ও আচ্ছা!
বিরক্ত হচ্ছো?
কেন? আমি খুব সহজে বিরক্ত হই না।
আসলে আমিও আজ বাসায় একা। কাল আমার বউ চলে আসবে। আর এতক্ষণ কথা বলা হবে না। আমি আমার বউকে খুব ভালোবাসি। সে আমার জন্য অনেক কষ্ট সয়েছে। তবে অফিস টাইমে আমাদের কথা হতে পারে।
আচ্ছা, বুঝেছি। আপনি কি আমার খুব ভালো বন্ধু হতে চলেছেন!
না। আমি তোমার খুব খারাপ বন্ধু হতে চাই। যাকে তুমি কখনো মন থেকে মুছতে পারবে না।
শিলা। তুমি কখনো সমুদ্রের কাছে গিয়েছিলে?
না। তবে আমাদের এখানে নদী আছে। মেঘনা নদী। আজো আপুদের সাথে গিয়েছিলাম। আমার খুব ভালো লাগে। আপনি আমাদের বাড়িতে এলে তখন আপনাকে নিয়ে যাবো।
কিন্তু আমি তোমাদের বাড়িতে কী পরিচয়ে আসব? তারচেয়ে তুমি চলে আসো। তোমাকে নিয়ে সমুদ্রে যেতে চাই।
একদিন ঠিকই চলে আসব!
শিলা আমি তোমাকে আবার বিয়ে দিতে চাই। এমন কারো সাথে যে তোমাকে ভালোবাসবে, তোমার খেয়াল রাখবে।
তোমার একটা ছবি পাঠাবে? তোমাকে দেখতে ভীষণ মন চাইছে।
আচ্ছা দিচ্ছি বলে শিলা সাথে সাথে ইনবক্সে দুটো ছবি পাঠাল।
ছবি দেখে আমার মাথা ঘুরছে। সেই পাঁচ বছর আগে তোমাকে দেখেছিলাম। তখন অনেক ছোট ছিলে। মানুষ এত সুন্দর হতে পারে বিশ্বাসই হতে চায় না।
তাই বুঝি ?
শিলা আমি তোমাকে আমার কাছের কারো জন্য নিয়ে আসব যাতে আমি তোমাকে দেখতে পাই। ভাবছ আমার কী লাভ?
হুম।
আচ্ছা আমি তোমার বিয়ের জন্য যদি চেষ্টা করি তোমার আপত্তি নেই তো?
না। তবে আপনাকে আমার আম্মু আর বড় বোনের সাথে কথা বলতে হবে।
বলব, কিন্তু তোমার সহযোগিতা লাগবে। ভাবছি মাত্র সাত দিনের পরিচয় অথচ আমার সব কিছুতেই তুমি সায় দিচ্ছ। অবাক হওয়ার মতো কথা!
ওই যে বললাম, আমি আপনাকে বিশ্বাস করি।
ধন্যবাদ। জীবনে এই প্রথম কাউকে খুঁজে পেলাম যে কি না, আমার সব কথায় হ্যাঁ বলে আর আমাকে বিশ্বাস করে। আচ্ছা এখন বিদায় নিচ্ছি। শুভ রাত্রি।
শিলা বাবাকে হারিয়েছে সেই ছোটবেলায়। মা, তিন বোনকে আগলে রেখে অনেক কষ্টে বড় করেছেন। বোনদের মধ্যে শিলা ছোট। তাই খুব আদরের। আর এমন রূপবতীকে আদর করতে সবারই মন চায়। সমস্যা হলো, অনেক বয়স্ক মানুষও শিলার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। এতে সে খুব বিব্রত হয়। বড় বোনের বিয়ে হয়েছিল সামাজিকভাবে। পাড়াপড়শি সহযোগিতা করে বিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু মেঝ বোন বিয়ে করেছে প্রেম করে । বড় বোনের স্বামী মধ্যবিত্ত হলেও মেঝ বোনের স্বামী বেশ পয়সাওয়ালা। ব্যবসায়ী মানুষ। এক বিয়েতে দু’জনের দেখা হওয়ার পরই প্রেম। এরপর বিয়ে। কারো পরিবারের অমত ছিল না। শিলার দু’বোনই সংসার জীবনে খুব সুখে আছে। মেঝ বোনের যখন বিয়ে হয়েছিল শিলা তখন সবে ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী।
শিলা যখন অষ্টম শ্রেণী পাস করে নবম শ্রেণীতে উঠে, ঠিক তখনই তার জীবনে এক দমকা ঝড় আসে। সেই ঝড়ে সব কিছু এলোমেলো হয়ে যায়। শিলাকে বড় দুলাভাই জোর করে তার এক বন্ধুর সাথে বিয়ে দেয়। কিন্তু বিয়ের পর শিলা দেখে তার স্বামী অনেক বয়স্ক। সে কিছুতেই তার স্বামীকে মেনে নিতে পারেনি। সেই প্রথম দিন থেকেই বয়স্ক মানুষটিকে তার শুধু অপরিচিতই মনে হতে লাগল। শিলার বয়স অল্প থাকাতে তার স্বামীও সময় দিয়েছিল। কোনো বিরক্ত করেনি। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে এই আশায়। শিলা স্বামীর বাড়ির অনেককেই আপন করে নিয়েছিল। কিন্তু স্বামীকে আপন করতে পারেনি। দিন দিন তাদের দূরত্ব বেড়ে গেল। এভাবে চার বছর কেটে যাওয়ার পর শিলার স্বামী শিলাকে ডিভোর্স দিয়ে আরেকটি বিয়ে করেছে।
ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পর শিলা নতুন উদ্যমে আবার লেখাপড়া শুরু করে। বিষণœতা কাটাতে মাঝে মধ্যে ফেসবুকে সময় কাটায় সে। একদিন ফেসবুকে এক আইডির প্রোফাইল ছবি দেখে শিলার চোখ স্থির হয়ে গেল। ছেলেটিকে তার খুব পরিচিত মনে হলো। অনেকক্ষণ পরে মনে পড়ে ছেলেটাকে। একসময় শিলার আশেপাশে ঘুর ঘুর করত ছেলেটা। আর সুযোগ পেলেই দূর থেকে শুধু শিলার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকত। ছেলেটার নাম আসিফ। শিলার ডিভোর্স দেয়া স্বামীর দূরসম্পর্কের আত্মীয়। নিজের অজান্তেই শিলা তাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দিয়েছিল। পরদিন রিকোয়েস্ট রিসিভ করে শিলাকে ম্যাসেজ দিয়েছিল আসিফ। সেই থেকে শুরু সামাজিক মাধ্যমে কথাবার্তা।
মাসখানেক পর আসিফ ম্যাসেঞ্জারে জানতে চায় ‘শিলা আমাদের কি দেখা হতে পারে?’
কেন? দেখা করে কী করবেন?
বিবাহিত লোক কি বন্ধুর সাথে দেখা করতে পারে না?
‘না, পারে। তবে আমি কারো সংসারের ক্ষতির কারণ হতে চাই না।’
‘তুমি না আমাকে বিশ্বাস করো! কোনো ক্ষতি হবে না কথা দিচ্ছি।’ আসিফের কণ্ঠে আবেগ ঝরে পড়ল।
মেঘনার পাড়ে আসিফ পৌঁছে দেখে শিলা আগে থেকেই দাঁড়িয়ে আছে। আসিফ সামনে গিয়ে দাঁড়ালে শিলা দেখা করার কারণ জানতে চায়। উত্তরে আসিফ শিলার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল, ‘শিলা আমি তোমাকে আবার বিয়ে দিতে চাই। এমন কারো সাথে বিয়ে দেবো যে কি না তোমার খুব যতœ নেবে, তোমাকে বুকে ধরে রাখবে।’
‘কে সে’? শিলা প্রশ্ন করল।
‘সে তোমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে’।
‘অসম্ভব! আমি কারো সংসার ভাঙতে পারব না। তা ছাড়া দ্বিতীয় স্ত্রী হওয়ার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই। সবকিছু কি আপনাদের মর্জি? মেয়েদের মন বলে কি কিছুই নেই?’ শিলা খুব রেগে গেল।
আসিফ শিলাকে আরো কাছে টেনে নিয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, ‘এই যে আমি বিবাহিত, আমার বউ আছে এসব হচ্ছে আমার উপন্যাসের কাল্পনিক চরিত্র। আর তুমি আমার উপন্যাসের বাস্তব নায়িকা। তুমি কি বুঝতে পারনি? আমি কেন তখন তোমার আশপাশে ঘুর ঘুর করতাম?’
আসিফের কথা শুনে শিলার দু’চোখ স্থির হয়ে গেল। নিজের অজান্তেই শিলা মাথাটা এলিয়ে দিলো আসিফের বুকে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরল দু’জন দু’জনকে। মেঘনা নদীর ওপরের বিশাল আকাশে যেন কোনো নতুন স্বপ্নেরা ডানা মেলেছে। আর বিস্তৃত সেই আকাশের নিচে খেলা করছে শান্ত জলরাশি। বাতাস কান পেতে শিলা আর আসিফের কথা শুনছে। কিছু দিন আগেও শিলা ওই নদীর পাড়ে এসে নীরবে কষ্টের অশ্রু ঝরাত। এখনো সেই অশ্রু ঝরছে তবে তা কষ্টের নয় আনন্দের।
প্রিয়জন-১৬২৪


আরো সংবাদ



premium cement