২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মেঘ কেটে যায়

-


রাইজিং সান অ্যাকাডেমি একটি কিন্ডার গার্টেন স্কুল। এই স্কুলে শিক্ষকতার করেন ইমাদ। উচ্চশিক্ষা শেষ করা এক যুবক ইমাদ। বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তির মানসে স্কুলে পাঠদানের পাশাপাশি ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত টিউশনি করে বেড়ায়। তারই স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে ফারিহা। ফারিহাকে সে দেড় বছর যাবৎ প্রাইভেট পড়াচ্ছে। সেই সূত্রে ফারিহার বড় বোন ফাহিমার সাথেও মাঝে মধ্যে দেখা হয়। তারপর টুকটাক কথা বলা।
একদিন সন্ধ্যার পর দুইতলার কলবেল বাজায় ইমাদ। না, কেউ আসছে না। সে মনে মনে ভাবলোÑ হয়তো কেউ বাসায় নেই। আবার কলবেল চাপল। কেউ আসছে না। আনমনে কী যেন ভাবছে ইমাদ। হঠাৎ রেলিং খুলে ভেতর থেকে ডাক আসে ‘স্যার, ভেতরে আসেন।’ পেছন দিকে ঘুরে ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে ইমাদ। ফাহিমাকে সে আরো অনেকবার দেখেছে কিন্তু আজ যেন এ আরেক ফাহিমাকে দেখছে সে। বিদ্যুতের স্বচ্ছ আলো ফাহিমার ওড়নার চুমকিতে প্রতিফলিত হয়ে তার বিচ্ছুরণ গিয়ে পড়ল ইমাদের চোখে। সেকেন্ডের জন্য চোখ বন্ধ করল সে। আবার তাকাল। এবার তার ব্যাকুল দৃষ্টি ফাহিমার মুখাবয়বে নিবিষ্ট হলো। যতই দেখছে ততই যেন বিমোহিত হচ্ছে সে। এ যেন এক অপ্সরী। তালা খুলে রেলিংটা একটু ফাঁক করেছিল ফাহিমা। এরপর হাত দুটো এক সাথে মুষ্টিবদ্ধ করে নতজানু হয়ে ভেতরে দাঁড়িয়ে সে। আর বাইরে দাঁড়িয়ে এক নির্বাক পুরুষ। ইমাদ কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। সে নিজেকে খুঁজে ফিরছে।
স্যার, দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে আসুন।’
ঠিক সেই সময় থেকে সেকেন্ডের ব্যবধানে ইমাদ ফাহিমার প্রেমে পড়ে গেল। এ যেন জেনে শুনেই অগ্নিগর্ভে নিজেকে শপে দেয়া। সময়ের ব্যবধানে ফাহিমাও একসময় ইমাদের প্রেমে পড়ে যায়। এ যেন আগুনের কাছে এসে শক্ত মোমের আত্মগলন। ফারিহাকে পড়ানোর সময় বিভিন্ন অজুহাতে ফাহিমা পড়ার টেবিলে এসে বসে থাকে। গল্প করে। চোখের ভাষায় চলে প্রেম বিনিময়। যদিও তাদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ মুখের বাণী হয়ে ফুটেনি তখনো। ইমাদ যেখানে বেতনের আশায় পড়ানো শুরু করেছিল, আজ সে ফাহিমার এতটুকু দর্শনের আশায় সারাদিন মুখিয়ে থাকে। ফাহিমার দর্শনের কাছে বিনিময় যেন তার কাছে একেবারেই তুচ্ছ। যে দর্শনে তার হৃদয়ে ভালোবাসার জল সঞ্চালন হবে। কিন্তু হঠাৎ করেই একদিন ফাহিমা তার সামনে এলো না। অন্য রুমে ঘাপটি মেরে শুয়ে রইল। এক ঘণ্টার স্থলে দেড় ঘণ্টা পেরিয়ে গেল, তবুও দর্শন হলো না ভালোবাসার জল প্রপাতের। শূন্য হৃদয়ে ফিরে এলো ইমাদ। দ্বিতীয় দিনও একই ঘটনা। তৃতীয় দিনও। এদিন কোনো প্রবোধ বাণীই যেন ইমাদের মনকে শান্ত করতে পারল না। তার শূন্য হৃদয় থেকে খসে পড়া বিন্দু বিন্দু পানি চোখের মাধ্যমে গড়িয়ে পড়ল চৈত্র্যের তপ্ত পিচ ঢাকা পথে। যেখানে প্রাণের সঞ্চালন নেই, সেখানে বিনিময় যেন একেবারেই তুচ্ছ।
চতুর্থ দিন ফারিহাকে পড়াতে যায়নি ইমাদ। পঞ্চম দিনও না। যদিও ফাহিমা তাকে অনেক কল দিয়েছে। কিন্তু সে রিসিভ করেনি। এক পাথর কঠিন জিদ তাকে পেয়ে বসেছে। ষষ্ঠ দিন নির্দিষ্ট সময়ে সে পার্কে গিয়ে নির্জন স্থানে বসে রইল। হঠাৎ ইমাদের ফোন বেজে উঠল। মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে উঠল ফাহিমার নাম। সে রিসিভ করেনি, দু’চোখ বন্ধ করে বসে রইল। লাগাতার সাইলেন্ট মোডে কল বেজেই চলেছে; এ দিকে সাইলেন্ট মোডে কেঁদে চলেছে ইমাদের হৃদয়। নিরানব্বইটা কল হয়ে গেছে। আবারো কল বেজে উঠল। এবার আর পারল না, সে আস্তে আস্তে মোবাইলটি কানের কাছে ধরল। ওপাশ থেকে ফাহিমার প্রশ্ন, ‘স্যার, আসছেন না কেন?’
ইমাদের কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে অভিমানি পাল্টা প্রশ্ন, ‘কেন আসব?’ ফাহিমার হৃদয় হয়তো এই ‘কেন’-এর উত্তর বলে দিয়েছে চুপি চুপি। ওপাশ থেকে কোমল কণ্ঠে ভেসে এলো ‘সরি স্যার, আপনি এখনই আমাদের বাসায় আসুন। প্লিজ স্যার।’ এই একটি মাত্র ‘সরি’ ইমাদের হৃদয় উপচেপড়া পাথর সরে গেলো। সমস্তটা আকাশে জমে থাকা কালো মেঘবলয় বিলীন হয়ে গেলো। ইমাদ বাম হাতের উল্টো দিকটায় দু’চোখ মুছে বলল, আসছি।
প্রিয়জন-১৬৩৮

 


আরো সংবাদ



premium cement