সোহানের বাবা
- শওকত নূর
- ২০ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০
সবুজ ধানক্ষেত পেরিয়ে তারা উঁচু জায়গায় উঠে এলো। সামনেই একটা প্রশস্ত খেলার মাঠের মতো মনে হচ্ছে। অনাবিল জোছনায় ভরে আছে পুরো জায়গা। আলো পড়ে ধু ধু করছে তার ঘাসহীন সাদা খড়খড়ে মাটি। জনমানব বলে কেউ নেই। না আছে চার দিকে কোনো সাড়াশব্দ। মাঠ থেকে হঠাৎ দৃষ্টি ওপরের দিকে নিয়ে গেল সোহানের বাবা। একটি বড়সড় চাঁদ হাসছে ঠিক মাথার ওপরেই। আজ পূর্ণিমা রাত বোধ করি। সোহানের বাবা বলল, সোহান দ্যাখ, ওই যে সেই চাঁদের বুড়িটা আজো সেভাবেই চড়কা কেটে চলেছে। হায় চড়কা! তারই ওপর ঘুরছে তাবত দুনিয়া!
সোহান ওর বাবার কথার কোনো জবাব না দিয়ে বলে উঠল, বাবা, আমি মিষ্টি খাব, মিষ্টি।
মিষ্টি খাবি? কী বলছিস তুই?
হ্যাঁ বাবা, মিষ্টিই খাব।
কী আবোল-তাবোল বলছিস? কোথায় চাঁদ আর কোথায় মিষ্টি? বড় অবাক হচ্ছি তোর কথা শুনে। এ কেমন কথা, বাবা?
কেন বাবা, ঠিকই তো বলছি আমি।
ঠিক বলছিস?
হ্যাঁ বাবা, তুমিই তো বলেছিলে পরীক্ষায় জিপিএ পাঁচ পেলে তুমি মিষ্টি খাওয়াবে। আজ তো পরীক্ষার রেজাল্ট হলো। আমিও জিপিএ পাঁচ পেয়েছি। মাকে কত করে বললাম মিষ্টির কথা। মা শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে চাইল।
কেন রে, কিছু টাকা-পয়সা তোর হাতে গুঁজে দিলেই তো পারত তোর মা। তুই গঞ্জের হাটে ভুবন হালুইকরের দোকান থেকে মিষ্টি কিনে খেতিস।
মায়ের কাছে পয়সা থাকলে তো। অনেক বলার পর মা বলল, তিন বেলা খাবারই জুটে না; আবার মিষ্টি!
তা অবশ্য ঠিক। ওই একটি ধানের ক্ষেত ছাড়া আর কিইবা এখন আছে তোর মায়ের! তাও আবার ধানগুলো দেখলাম এখনো সবুজ-কাঁচা। পাকা হলে না হয় বিক্রি করে ক’টা টাকা তোর হাতে গুঁজে দিতে পারত। প্রাণভরে মিষ্টি খেতিস তুই। কেন যে রেজাল্টটা ক’ দিন পর হলো না! এখন তোর মিষ্টির টাকা আমি কোথায় পাই?
বাবা, দেখ যদি পকেট খুঁজে ক’টা টাকা অন্তত পাও।
কিভাবে পারবে, বাবা? ট্যাক্সির ওই ট্রিপটা পৌঁছে দিতে পারলেও না হয় একটা ব্যবস্থা হতো। কিন্তু ট্রিপটা তো আর দেয়াই গেল না। গুলশান থেকে দয়াগঞ্জ। মাত্র হাতিরঝিল ছেড়েছি, আর তখনই ওই দানব ট্রাকলরিটা এমন ধাক্কা দিলো যে, মিনিবাস দুটো চেপে ধরতে চাইল লরিটাকে; আর লরিটা হামলে পড়ল আমার ট্যাক্সির ওপর। ভেতরে একটা ছেলে ছিল তোরই মতো। সে-ই বোধ করি সবার আগে গেছে। এই তো জীবন! আহারে!
বাবা, আমি মিষ্টি খাব। কত দিন মিষ্টি খাই না। আজ এমন একটা দিন, বাবা। কত দিন আসনি তুমি।
আহারে মানিক, ক’টা টাকা অবশ্য আছে। ওই ট্রিপটার আগে গাবতলী-মহাখালীর যে ক’টি ট্রিপ দিয়েছিলাম। তোর স্কুলের বেতন-ভর্তির জন্য প্যান্টের গোপন পকেটে রেখেছিলাম টাকাগুলো। ক’দিন পরই তোর ভর্তি। ওখান থেকে কিছু না হয় খরচ করলাম! কিন্তু মিষ্টি এখন কোথায় পাই, বাবা? এখানে কোনো দোকান, হালুইকর?
বাবা, ওই যে দেখ, ওই দিকে।
কী ও দিকে?
আহা দেখই না।
মাঠের পশ্চিম বরাবর তাকিয়ে খুব অবাক হলো সোহানের বাবা। ওখানে এত শিগগিরই ওই সব যানবাহন এলো কোত্থেকে? একটা ট্যাক্সি, দুটো মিনিবাস। চাঁদের আলোয় কেমন ঝলমল করছে গাড়িগুলো! রীতিমতো সাদা বুঝি ট্যাক্সিটা। ঠিক সোহানের বাবার সেই ট্যাক্সিটাই যেন। ওই সব কী ঘটছে ওখানে? অনেক লোক দেখা যাচ্ছে বেরোচ্ছে গাড়িগুলো থেকে। সবার পরনে ধবধবে সাদা পোশাক। এখানে কিভাবে, কোত্থেকে এলো তারা; যাবেই বা কোথায়? এ দিকে গাড়ির কোনো রাস্তাই তো নেই, তাহলে?
সোহানকে নিয়ে দ্রুত সে দিকে পা চালাল সোহানের বাবা। কাছাকাছি হতেই লোকগুলোর একজন সোহানের বাবার দিকে চেয়ে হেসে বললÑ আরে, এ কী? রহমান মিয়া যে। তুমিও এখানে চলে এসেছ দেখছি। তা কী মনে করে আজ এখানে?
এই যে স্যার, আমার ছোট ছেলেটা ধানক্ষেত দেখা শেষে এখানে এসে বায়না ধরল।
কিসের বায়না?
স্যার, ও মিষ্টি খাওয়ার বায়না ধরল।
তাতে আর সমস্যা কী? ছোট্ট ছেলেটাকে মিষ্টি খাওয়ানো কী আর এমন কঠিন কাজ? ওই তো পবন হালুইকরের হাওয়াই মিঠাইর দোকান। অল্পবিস্তর চমচম রসগোল্লাও পাওয়া যায়। একটু না হয় খাবে তোমার ছেলে। আচ্ছা চলো এবার সবাই মিলে একযোগে বসে হাওয়াই মিঠাই খাওয়া যাক। ছেলেটার মুখেও ক’টা রসগোল্লা চমচম পড়–ক। বায়না ধরেছে ছেলেটা।
সোহান তার বাবার হাত ধরে একদল লোকের সাথে হাঁটছে। এরই মধ্যে ওদের প্রতিবেশী সুরমান চাচার সাথেও দেখা হয়ে গেছে ওর। ইজিবাইক চালায় ওর সুরমান চাচা। সে দিন মাত্র ট্রাকের ধাক্কায় ইজিবাইকটা ঝিলের পানিতে ছিটকে গেছে। ভালোই হলো। ক’দিন পর হলেও চাচার সাথে দেয়া হলো তার। সেই যে নেই হয়েছিল সে!
মিষ্টি খাওয়া শেষে হালুইকরের দোকান থেকে বেরিয়ে এসেছে সবাই। ওই লোকগুলো সোহানের বাবার কানে কী যেন ফিস ফিস করছে। একটু হেঁটে সোহানের বাবা বিড় বিড় করে বলল, এ কী? সেই গাড়িগুলো গেল কই? এখন কী করে যাবো এতটা পথ? সে কি চাট্টিখানি পথ?
বাবা, কোথায় যাবে? সোহান বিস্ময়ে বলল।
ওই যে চাঁদের আসমানে।
আসমানে?
হ্যাঁ রে, বাবা। এখন ওখানেই তো বসতবাড়ি আমার। ওখানেই তো স্থায়ীভাবে থাকি আমি।
বাবা, আমি যাবো না তোমার সাথে?
না রে বাবা না, ও কথা ভুলেও মুখে আনিস না তুই। খবরদার, ভুলেও মুখে নিসনা ও দুর্মুশা কথা। তা ছাড়া তুই তো যেতেও পারবি না ওখানে।
ক্যান, বাবা?
ওখানে যেতে হলে হাওয়াই মিঠাই খেতে হয়। পবন হালুইকর কত যতœ করে হাওয়াই মিঠাই খাওয়াল আমাদের সবাইকে। তুই খেলি রসগোল্লা- চমচম। তুই এখানেই থাকবি। এই দেখ আমরা সবাই হাওয়াই মিঠাই খেয়ে কেমন আকাশে উড়তে পারি। দেখ, কেমন করে আমরা উড়ে উড়ে চাঁদের আসমানে যাই। এই দেখ কেমন উড়ছি!
চোখের নিমিষে মানুষগুলোকে সাথে নিয়ে শূন্যে উড়তে লাগল সোহানের বাবা। সোহান অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ধবধবে সাদা পোশাকে চাঁদের দিকে উড়ছে সবাই। হঠাৎ শূন্য থেকে ভেসে এলো সোহানের বাবার কণ্ঠ : সোহান, ভালো থাকিস, বাবা। মনে দুঃখ নিসনা, সোনামানিক আমার। দেখিস এক দিন বড় হয়ে তুইও অনেকের সাথে আকাশে উড়বি। জাহাজে উড়ে উড়ে কত দেশ-বিদেশ ঘুরবি তুই। যাইরে বাবা, বিদায়!
বাবা বাবা চিৎকারে ঘুম থেকে জেগে ওঠে সোহান। চোখ খুলে দেখে ভোর হয়ে গেছে। আর রাতে ঘুমানোর আগে শিয়রের পাশে রাখা খেলনা, প্লাস্টিক উড়োজাহাজটা ওর ঘাড়ের নিচে পড়ে চ্যাপ্টা হয়ে আছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা