২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মুসলিম আমেরিকানদের সঙ্কটের শিকড়

-

মার্কিনিরা যাকে ৯/১১ (১১ সেপ্টেম্বর ২০০১ খ্রি.) বলে অভিহিত করে, সেই দিন শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নয়, সারা বিশ্বে ঘটেছিল এক অভূতপূর্ব যুগান্তর। মার্কিন কর্তৃপক্ষের অভিযোগ অনুসারে, বাণিজ্যিক উড়োজাহাজকে ক্ষেপণাস্ত্রের মতো ব্যবহার করে আত্মঘাতী মুসলিম আরবরা নিউ ইয়র্কের বিশ্ববাণিজ্য টাওয়ার ধ্বংস করে দেয় এবং তিন হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করে। এ ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্র এবং সমগ্র পশ্চিমা বিশ্ব মুসলমানদের মারাত্মক সন্ত্রাসী বা জঙ্গি হিসেবে দেখতে শুরু করে। মুখে যাই বলুন না কেন, মনে মনে তারা বিভ্রান্ত। অনেকাংশে ইসলাম সম্বন্ধে অজ্ঞ এই পশ্চিমা নেতারা এ ধারণাকে পোষণ করে এবং প্রবল মুসলিমবিরোধী প্রচার ও কার্যক্রমে লিপ্ত হয়। ৯/১১-এর পরপরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের নেতৃত্বে আফগানিস্তানে (২০০১) এবং ইরাকে (২০০৩) অভূতপূর্ব প্রচণ্ড আক্রমণ চালায় পশ্চিমা বিশ্ব। তারপর থেকে নানা অজুহাতে পশ্চিমা দেশগুলো এবং তাদের অমুসলিম দোসররা ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিষাক্ত প্রচার এবং আক্রমণাত্মক কার্যকলাপ আরো জোরদার করে। জাতি-রাষ্ট্র নির্বিশেষে মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর বিরুদ্ধে পশ্চিমা জগতের, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াপন্থী সরকারগুলো যেন মরিয়া হয়ে ওঠে।
অতি সম্প্রতি ২০১৬ সালে নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট কট্টরপন্থী ও উগ্র জাতীয়তাবাদী ডোনাল্ড ট্রাম্প এই ধারাকে আরো প্রবল করে তুলেছেন। তার হুকুমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছয়টি মুসলিমপ্রধান দেশের নাগরিকদের অভিবাসন প্রায় নিষিদ্ধ করে। এ ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে বসবাসরত মুসলমানদের ওপরও আরোপ করা হয়েছে কড়া নজরদারি। তাদের ধর্ম-কর্ম ও সামাজিক ক্রিয়াকলাপ রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর বিষ নজর এড়াতে পারছে না। ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে আমেরিকার মুসলিম কাউন্সিল সংক্ষুব্ধ হয়ে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে। এই সংস্থার নেতারা অভিযোগ করেন, নির্দিষ্ট মুসলিম আমেরিকান ব্যক্তিদের চলাফেরা ও কাজকর্মের ওপর গোয়েন্দা বিভাগগুলো নজরদারি করছে। শুধু তাই নয়, তাদের অভ্যন্তরীণ চলাফেরার ওপরও নিষেধাজ্ঞা গ্রহণ করছে। নিরাপত্তার অজুহাতে তাদের বিদেশ ভ্রমণও করা হয়েছে দুঃসাধ্য। নিজ দেশে ভিন্নধর্মাবলম্বী মানুষের প্রতি এই বিমাতাসুলভ আচরণ মানবাধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতার নগ্ন বরখেলাপ। কাউন্সিল অব মুসলিম আমেরিকান এ ধরনের কার্যকলাপ মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের পরিপন্থী বলে মনে করে এবং তার প্রতিকার দাবি করে।
দৃশ্যত, মুসলিম আমেরিকানরা আজ এক সঙ্কটের মুখোমুখি। এই সঙ্কট সময়মতো সঠিকভাবে মোকাবেলা করতে না পারলে সেটি মহাসঙ্কট ও বিপর্যয়ের রূপ নিতে পারে। এই সঙ্কটের প্রকৃতি নির্ণয় করতে গেলে এর ঐতিহাসিক ও মনস্তাত্ত্বিক শিকড়ের সন্ধান করতে হয়।
এই শিকড় খোঁজার প্রসঙ্গে মনে পড়ে ১৯৯৮ সালের ১৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত শিকাগোতে এক মুসলিম সম্মেলনের কথা। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক কাজী মোহসিন আমাকে সেদিন হোটেল থেকে শিকাগোর ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যান। কাজী মোহসিন একজন ধর্মপরায়ণ মুসলমান এবং মুসলিম আমেরিকান সমাজের বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক কার্যকলাপে নিয়মিত অংশ নেন। তিনি আমাকে ১৮ এপ্রিলে মুসলিম আমেরিকানদের এক সম্মেলন ও আলোচনা সভার কথা এবং সেখানে আমার আমন্ত্রণ রয়েছে বলে জানান।
সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে আমি মুসলিম আমেরিকান পণ্ডিত, বিশ্লেষক, শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের আলোচনা মন দিয়ে শুনি। তারা নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে মুসলিম আমেরিকানদের অবস্থান ও সমস্যা সম্পর্কে বিবরণ এবং বিশ্লেষণ পেশ করেন। তাদের এই বিদগ্ধ আলোচনা ছিল তথ্য ও তত্ত্ববহুল এবং আকর্ষণীয়। এদের আলোচনায় স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছিল প্রায় ৬০ লাখ মুসলিম আমেরিকানের আশা-নিরাশা, আস্থা ও সংশয়ের কথা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় সম্প্রদায় হওয়া সত্ত্বেও তারা অতিক্রম করছেন এক সঙ্কটের সূচনাকাল। তাদের দেশ যুক্তরাষ্ট্রে তারা তুলনামূলক সংখ্যালঘু এক ধর্মীয় সম্প্রদায়। তাই তাদের অবস্থানে রয়েছে অনেক দুর্বলতা এবং তাদের সামষ্টিক জীবনে সঙ্কট ও দ্বন্দ্বের রেখা ক্রমেই স্পষ্টতর হয়ে ওঠে।
আতিফ হার্ডেন একজন বহুলপরিচিত মার্কিন বুদ্ধিজীবী। তিনি মুসলিম আমেরিকানদের ব্যক্তি ও গোষ্ঠী পর্যায়ে আরো তাৎপর্যপূর্ণ এবং নিয়মিত যোগাযোগ ও আদান-প্রদানের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, মুসলিম আমেরিকানদের বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার মধ্যে যথেষ্ট যোগাযোগ ও সমঝোতা নেই। এরপর তিনি মুসলিম আমেরিকানদের মার্কিনি জীবনধারার মূল স্রোতে সংশ্লিষ্ট হওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেন। তিনি আরো বলেন, তারা যে মার্কিন জীবনধারায় পূর্ণভাবে অংশগ্রহণ করে না, এটাই উদ্বেগজনক। এতে মনে হয়, তারা স্বেচ্ছায় এক বর্ণবিভেদ ব্যবস্থা মেনে নিয়েছেন এবং পরিণতিতে নিজেদের এমন এক পরিস্থিতিতে নিয়ে গেছেন, যা তাদের জন্য মঙ্গলকর নয়। হার্ডেন মনে করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জীবনধারার প্রধান কার্যকলাপে মুসলিম আমেরিকানদের উৎসাহ এবং ইতিবাচক মনোভাবের সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়া অতি প্রয়োজন। হার্ডেন বলেন, যেসব গোষ্ঠী মার্কিন জীবনে মূলধারায় অংশগ্রহণ করেনি, মার্কিন সমাজের ওপর তাদের প্রভাব অতি ক্ষুদ্র। এ ধরনের গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে আমিষ, জিহভাস, উইটনেস, কোয়েকার্স প্রভৃতি। এই গোষ্ঠীগুলো তাদের একাকী জীবনধারায় বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো অস্তিত্ব বজায় রাখে। ফলে তারা বৃহত্তর সমাজ ও রাষ্ট্রের হৃদস্পন্দনের সাথে সংশ্লিষ্ট হতে পারে না। পরিণতিতে জীবনপ্রবাহের বাইরে বড়জোর পর্যটকের জন্য আকর্ষণীয় এবং সমাজতত্ত্ববিদদের গবেষণার বিষয় হয়ে সমাজে বিরাজ করে। হার্ডেন আরো বলেন, আমিষ ও কোয়েকার্সদের ভাগ্য বরণ না করতে চাইলে মুসলিম আমেরিকানদের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের মূল জীবনপ্রবাহে সংশ্লিষ্ট হওয়া ছাড়া উপায় নেই।
হার্ডেন বলেন, পক্ষান্তরে যেসব গোষ্ঠী ও সম্প্রদায় বিপরীতমুখী নীতি ও কার্যক্রম, অর্থাৎ বৃহত্তর সমাজ জীবনে অংশগ্রহণের পথ বেছে নিয়েছেন, তারা তাদের সম্প্রদায়ের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অর্জনে এবং তা টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করেছেন। এসব গোষ্ঠীর উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায় আমেরিকায় আইরিশ ক্যাথলিক, মোরমন ও ইহুদিদের মধ্যে। এ ক্ষেত্রে মার্কিন ইহুদিরা প্রবল ভূমিকা পালন করছেন। তারা যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসা-বাণিজ্য, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, অর্থনীতি, রাজনীতি ও গণমাধ্যমের ওপর গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যময় প্রভাব রাখেন। একমাত্র ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল ছাড়া বিশ্বের আর কোথাও ইহুদি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের এত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রচণ্ড ভূমিকা নেই। আতিফ হার্ডেন হাসির ছলে বলেন, ফিলিস্তিনিরা নিজ অঞ্চল ছাড়া অন্য সব জায়গায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদিদের মতো বৃহত্তর সমাজের সাথে সফলভাবে একাত্ম হতে পারেন।
এই বক্তা মুসলিম আমেরিকানদের রাষ্ট্র ও সমাজের জনজীবনে সংশ্লিষ্ট হয়ে জনসেবামূলক কার্যক্রমে অংশ নেয়ার আহ্বান জানান। জনসেবামূলক কাজের মাধ্যমেই সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নীতির ওপর প্রভাব রাখা যায়। জনসেবাকে মূল জাতীয় জীবনের প্রবেশপত্র বললেও অত্যুক্তি হবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো এক বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক সমাজে সিনেটর, কংগ্রেস সদস্য, অঙ্গরাজ্যের নির্বাচিত গভর্নর, মহানগরের মেয়র এবং কাউন্সিলর ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই জনমতের প্রধান নিয়ামক এবং রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারক। বহু জাতির এবং বহু সংস্কৃতির সমন্বয়ে গঠিত যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে একীভূত হতে হলে মুসলিমদের এসব পদে অবশ্যই নির্বাচিত হতে হবে। এ পথ ধরেই প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের আইরিশ ক্যাথলিক অভিবাসীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জীবনপ্রবাহের মূলে একীভূত হয়েছে।
আতিফের মতে, ইসলামের আত্মসমর্পণকারী রূপটি তার জনসেবামূলক কার্যক্রমের চেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। তিনি নবী হজরত ইউসুফ আ:-এর উদাহরণ উল্লেখ করে বলেন, ইউসুফ আ: ছিলেন এক অসফল ইহুদি পরিবারের সন্তান। তার সৎ ভাইয়েরা তাকে দাস হিসেবে বিক্রয় করে। তিনি এমন এক সমাজে সংখ্যালঘু ধর্মীয়গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন, যে সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মবিশ্বাস ও আচরণ ছিল ভিন্ন। তদুপরি তার ছিল না আনুষ্ঠানিক শিক্ষা। এত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তিনি জনসেবামূলক কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে ভূমিকা রাখেন এবং তার সম্প্রদায়কে সমাজে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করেন। ইউসুফ আ:-এর দৃঢ় নৈতিক অবস্থানের জন্য রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ তাকে কারাগারে পাঠায়। সেখানেও নানা বাধা অতিক্রম করে তিনি কারাবন্দীদের সংগঠিত করে এক মঙ্গলকর জীবনের দিকে নিয়ে যান। এই অদম্য নবীর উদাহরণ একেশ্বরবাদী ধর্মগুলোতে আদি যুগের এক গৌরবময় ঐতিহ্য। আতিফ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইয়ো অঙ্গরাজ্যের ক্লিভল্যান্ড নগরে তার ১৮ বছর বয়সে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি স্কুলে দেখতে পান যে, একদল গুণ্ডার আক্রমণের মুখেও ধৈর্য, সাহস ও প্রশান্তি নিয়ে এক মুসলিম তরুণ ওই হয়রানি মোকাবেলা করছে। সে নিজেকে পশুসুলভ দ্বন্দ্বে সংশ্লিষ্ট করেনি বরং ধৈর্যের সাথে মারধর সহ্য করে তার শান্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। আতিফ এই মুসলিম তরুণের সাহসী ও শান্তিপূর্ণ আচরণে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তার সাথে আরো দু’জন শ্বেতকায় ককেশীয় আমেরিকান ওই সাহসী যুবকের অদমনীয় ধৈর্য দেখে মুগ্ধ হন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
আরেক বক্তা রিয়াজ আহমেদ তার আলোচনায় বলেন, মার্কিন সমাজের মূল দুই বৈশিষ্ট্য হচ্ছেÑ বলিষ্ঠ সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা। যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিমরা এ দুই বিষয়েই অভিজ্ঞ ও দক্ষ। তাদের শতকরা ৪০ ভাগ সর্বোচ্চ ট্যাক্স দানকারী নাগরিকদের অন্তর্ভুক্ত, অথচ রাষ্ট্র ও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ জনসেবামূলক ক্ষেত্রে তাদের উপস্থিতি কম। অন্য ধর্ম-সম্প্রদায়ের লোকেরা কিন্তু এ ক্ষেত্রে সফলভাবে উপস্থিত হয়েছেন। তারা যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, কংগ্রেস সদস্য ও সিনেটরদের সহকারীদের কাতারে তারা শামিল হয়েছেন। মুসলিমরা সেখানে নেই। রিয়াজ আরো বলেন, প্রত্যেক কংগ্রেসম্যানের ১৭ থেকে ৩৪ জন সহকারী থাকে, সিনেটরদের থাকে ৪০ থেকে ৮০ জন। এসব গুরুত্বপূর্ণ সহকারীদের মধ্যে সাধারণত কোনো মুসলমানকে দেখা যায় না। অথচ এ ক্ষেত্রে ইহুদিরা দৃশ্যমানভাবে উপস্থিত। এই সহকারীদের মধ্যে তাদের সংখ্যা সারা যুক্তরাষ্ট্রে তাদের জনসংখ্যার চেয়ে আনুপাতিকভাবে অনেক বেশি।
পরবর্তী বক্তা মাইক অন্য এক সমস্যার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি পবিত্র কুরআনের বাণীর কথা বলেন। যেখানে বলা হয়েছে, মুসলিমদের ভবিষ্যতে বাঁচতে হবে এবং সে জন্য সমাজের বৃহত্তর জীবনে অংশ নিতে হবে। মুসলিম আমেরিকানদের প্রধান সমস্যা হলো, তাদের কোনো উল্লেখযোগ্য মঞ্চ নেই। যেখানে তারা তাদের বিভিন্ন সমস্যা সম্বন্ধে আলোচনা করে তার সমাধান খুঁজতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রের মসজিদগুলো কার্যকরী সামাজিক মঞ্চ হিসেবে ব্যবহৃত হয় না। শিকাগো শহরে তিন লাখ মুসলমানের মধ্যে মাত্র পাঁচ হাজার নিয়মিত শুক্রবারে সাপ্তাহিক জুমার নামাজে অংশ নেয়। মাইক আরো বলেন, বৃহত্তর সমাজের কাজে অংশগ্রহণে যেমন ইতিবাচক দিক আছে, তেমনি আছে অংশগ্রহণ না করাতেও। কিন্তু প্রধান সমস্যা হলো, ধর্মীয় গোষ্ঠীর নিজস্ব আলোচনা মঞ্চ এবং কার্যকর যোগাযোগমাধ্যমের অভাব। মাইক আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম সম্প্রদায়ের সামাজিক সাময়িকীর গ্রাহক সংখ্যা অতি অল্প এবং প্রচার দারুণভাবে সীমিত। এ দেশের প্রায় ৬০ লাখ মুসলিম বসবাস করলেও মুসলিম সাময়িকীর গ্রাহক সংখ্যা পাঁচ-ছয় হাজারের বেশি নয়। মুসলিম নাগরিকরা অনেকেই উচ্চপদ ও সামাজিক অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের অভাব এবং বিভেদের কারণে দুর্বল।
মধ্যযুগে ইসলামি সভ্যতার চিন্তা ও গবেষণার উচ্চমান সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে মাইক বলেন, সে যুগের মুসলিম আফ্রিকান দেশের শহর কিম্বাকতুতে এক সময় ২০ হাজার বিদেশী ছাত্রছাত্রী লেখাপড়া করত। শিক্ষা ও জ্ঞানের বিস্তারে মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের আগে ইউরোপের অবস্থা ছিল করুণ। তাদের প্রকাশিত বইপত্রের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩০ হাজার, অথচ যন্ত্র আবিষ্কারের পর সে সংখ্যা প্রবল গতিতে বেড়ে দাঁড়ায় ৯০ লাখে। ফলে অবস্থানের যে বিশাল পরিবর্তন ঘটল তাতে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা সম্প্রসারণে ইউরোপ দ্রুত বিপুল ভূমিকা রাখতে শুরু করে।
পরিণতিতে ইউরোপীয় তথা পাশ্চাত্য সভ্যতা আমাদের কালের প্রধান ও নিয়ামক সভ্যতার রূপ ধারণ করেছে। পশ্চিমা জীবনযাত্রা, প্রকৃতি ও ধরনের যতই সমালোচনা করা যাক না কেন; এর প্রবল প্রাধান্যের কথা অস্বীকার করার উপায় নেই।
মাইক আরো বলেন, যোগাযোগপ্রযুক্তি ও জ্ঞানের ক্ষেত্রে বর্তমান সভ্যতা এক নতুন ইতিবাচক মোড় অতিক্রম করেছে। কম্পিউটার বিপ্লব সাধন করেছে বিরাট পদক্ষেপ। আধুনিক কম্পিউটার শুধু অভিনবই নয়, এটি অধিকতর সুলভমূল্যে সরবরাহকৃত এবং তুলনামূলকভাবে আরো শক্তিশালী। এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনকে ১৪৫৩ সালে ইউরোপীয় রেনেসাঁ বা পুনর্জাগরণের সাথে তুলনা করা যায়। তথ্য ও জ্ঞানের জগতে এবং যোগাযোগ ও আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে কম্পিউটার এক বিশাল মাত্রা যোগ করেছে।
মাইক মনে করেন, এই নতুন পরিবর্তনের ধারাকে ব্যবহার করে মুসলিম আমেরিকানরা তাদের অবস্থান আরো দৃঢ় ও সমৃদ্ধ করতে পারে। তিনি সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, তরুণ মুসলিম আমেরিকানরা কম্পিউটার ব্যবহারে দক্ষ ও কুশলী হয়ে উঠেছেন। ইন্টারনেট ব্যবহারে তাদের শক্তিশালী অংশগ্রহণ ভবিষ্যতের জন্য উজ্জ্বল সম্ভাবনা নিয়ে আসে।
পেশাজীবী টিপু সুলতান যথাযথ নেতৃত্বের প্রয়োজনের কথা বলেন। মুসলিম আমেরিকানদের নেতৃত্ব শুধু রাজনৈতিক মাধ্যমেই আসবে এমন কোনো কথা নেই, বরং সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিপুল অধ্যবসায় ও ঐকান্তিক পরিশ্রম এবং দুর্ভোগ সহ্য করার শক্তি প্রয়োজনীয় নেতৃত্বের বিকাশ ঘটাতে পারে। তিনি বলেন, পেশাজীবী হিসেবে দক্ষতা ও সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে মুসলিম আমেরিকান নেতৃত্ব অধিক সফল ও কার্যকর হতে পারে।
তিনি মার্কিন সমাজের উচ্চতম স্তরে মুসলিমদের দুঃখজনক অনগ্রসরতার কথা উল্লেখ করে বলেন, সিলিকন ভ্যালিতে কর্মরত উচ্চতম অবস্থানে যে ৭৫০ জন বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, যারা প্রত্যেকে বছরে ১০ লাখ ডলারের বেশি আয় করেন, তাদের মধ্যে ইহুদিদের সংখ্যা ৩০০, হিন্দুদের সংখ্যা ১১ এবং মুসলিমদের সংখ্যা মাত্র ৮ জন।
সম্মেলনে আলোচনায় সব বক্তাই একবাক্যে মুসলিম আমেরিকান নেতৃত্বে আমূল পরিবর্তনের ওপর জোর দিয়ে বলেন, মুসলিম আমেরিকানদের নতুন তরুণপ্রজন্ম তাদের পূর্বপ্রজন্মের মতো তাৎক্ষণিক বস্তুবাদী চিন্তায় মগ্ন নয়। তাদের মধ্যে আরো বলিষ্ঠভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে বিশাল মহাবিশ্বের বিশ্ব সম্পর্কে এবং চিরন্ময় মানবতা সম্বন্ধে সক্রিয় চেতনা ও জ্ঞান। আলোচকরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদিদের উল্লেখযোগ্য সাফল্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তারা বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদি সম্প্রদায় সে দেশের বৃহত্তম সমাজকে এমন সব ধ্যান-ধারণায় সিক্ত করেছে, যা তাদের গোষ্ঠীর প্রতি সহানুভূতিশীল। দক্ষভাবে গণমাধ্যমকে এবং প্রযুক্তিকে সপক্ষে ব্যবহার করে তারা এই সাফল্য লাভ করেছেন। মুসলিম আমেরিকানদেরও মনে রাখা দরকার, যুক্তরাষ্ট্রীয় সমাজে শীর্ষে ভাবনা-চিন্তা ও ধ্যান-ধারণার সৃষ্টিতে এবং প্রচারে তাদেরকে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে।
অন্য বক্তার মধ্যে ড. চিমা আমেরিকান মুসলিম কাউন্সিলের সক্রিয় ভূমিকার কথা উল্লেখ করে বলেন, সংশ্লিষ্ট মার্কিন কর্তৃপক্ষের সাথে ফলপ্রসূ আলোচনা করে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে যেন ঢালাওভাবে মুসলিমরা নির্যাতিত না হন, সেই সুরক্ষার বিষয়ে সচেষ্ট থাকতে হবে।
ফিলাডেলফিয়ার মেহেদি বলেন, একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বে ইসলামের জন্য এক সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করে আছে। প্রযুক্তির প্রসারের ফলে ওই সময় ক্লোনিংসহ অন্যান্য প্রক্রিয়ার প্রসার এবং কৃত্রিম বুদ্ধি বা জ্ঞান বিবর্তনের ফলে যেসব মানবিক ও নৈতিক চ্যালেঞ্জ দেখা দেবে, তার মোকাবেলায় ইসলামের মানবিক নৈতিকতা এক বিশাল সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে। এ ক্ষেত্রে পরমতসহিষ্ণুতা এবং অন্য ধর্ম ও বিশ্বাসের প্রতি সম্মানের যে মানবিক শিক্ষা ইসলাম দেয়, সারা বিশ্বে তার প্রচার ও প্রসার করার ব্যবস্থা আশুপ্রয়োজন।
আলোচনায় আমার বক্তব্যে আমি বাংলাদেশের প্রগতি ও উন্নয়নের কথা বলি এবং উল্লেখ করি যে, হাজার বাধা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মানুষ এই অর্জন সম্ভব করেছে। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের অবস্থা মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিমদের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার সাথে তুলনীয়। যুক্তরাষ্ট্রে তারা সক্রিয় ও দেশপ্রেমিক হয়েও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আস্থাহীনতা ও অনিশ্চয়তায় ভোগেন। বাংলাদেশের মুসলিমরা এ দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও সীমান্তের তিন পাশে অবস্থিত ভারত ও মিয়ানমারের অমুসলিম জনগোষ্ঠীর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার তুলনায় সংখ্যালঘু মাত্র। মুসলিম মার্কিনিদের মতো বাংলাদেশের মুসলমান বাঙালির আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে আধুনিক জ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিক শিক্ষা লাভ করে দক্ষ ও দূরদর্শী নেতৃত্ব অর্জন করে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করবে, এটাই এই সময়ের দাবি।
মুসলিম আমেরিকানদের জন্যই শুধু নয়, সারা বিশ্বের মুসলমানদের জন্য যে কথা প্রযোজ্য তা লিখে গেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথÑ
‘সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান
সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ।
মুক্ত করো ভয়; আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়।
দুর্বলেরে রক্ষা করো, দুর্জনেরে হানো,
নিজেরে দীন নিঃসহায় যেন কভু না জানো।
মুক্ত করো ভয়, হব নিজের পরে করিতে ভর না রেখো সংশয়।
ধর্ম যবে শঙ্খরবে করিবে আহ্বান
নীরব হয়ে, নম্র হয়ে, পণ করিয়ো প্রাণ।
মুক্ত করো ভয়, দুরূহ কাজে নিজেরই দিয়ো কঠিন পরিচয়।


আরো সংবাদ



premium cement