২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শিল্পের সঙ্গে সৌন্দর্যের সম্পর্ক জন্মগত

-

শিল্প এবং শিল্পের সৌন্দর্য সম্পর্কে বিশ্বশিল্পের ইতিহাসে বিচিত্রধর্মীয় আলোচনা এবং ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছে। আলোচনা ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দেহ, দেহলাবণ্য, মোনরমনতা, ধ্যানাভিনিবেশ, তন্ময়তা, চিত্তচমৎকারিত্ব, ভাবব্যঞ্জকতা, সৌসাদৃশ্য, ভারসাম্য, অনুপাত, কর্ম, অনুকরণ ইত্যাকার বিষয়ে। কী, কেন, কোথায়, কখন এসব প্রশ্নের কারণে সৃষ্ট দর্শনের সময়কাল থেকেই শিল্পের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের শুরু। আর্ট বা শিল্প কী? শিল্পের সৌন্দর্য কী? কাকে সৌন্দর্য বলা হবে এমন প্রশ্ন উঠেছে শিল্পের যাত্রালগ্ন থেকেই। এসব প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন অনেকেই। শিল্প শাস্ত্রকারদের মধ্যে, শিল্পের তাত্ত্বিকদের মধ্যে মতভেদেরও সৃষ্টি হয়েছে উত্তর দেয়ার ক্ষেত্রে। তা ছাড়া এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকা, এসব অঞ্চলের শিল্প এবং শিল্পের সৌন্দর্যও এক নয়। আর এ জন্য ব্যাখ্যাও হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন। আফ্রিকার কথাই ধরা যাক। আফ্রিকার মানুষ, তাদের চেহারা, তাদের গায়ের রঙ, তাদের পোশাক-আশাক এবং সংস্কৃতির সাথে এশিয়া, ইউরোপের কিংবা আমেরিকার ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। আফ্রিকার নর-নারীর গায়ের রঙ কালো, কুচকুচে কালো। চুল কুঁকড়ানো। সুতরাং তাদের নিয়ে রচিত চিত্রকর্ম কিংবা ভাস্কর্যও তাদেরই মতো দেখতে। যার সাথে এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকার নর-নারীর চিত্র-ভাস্কর্যের কোনো মিল নেই। এ জন্য চিত্র-ভাস্কর্যের সৌন্দর্যেরও পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
শিল্প কী? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে কেউ কেউ বলেছেন, শিল্প হচ্ছে ভাষার অবয়ব কিংবা বলা যায় ভাষার প্রতিমূর্তি। এই অবয়ব কিংবা প্রতিমূর্তি মানবতা এবং সভ্যতার সংরক্ষণ ও পরিপুষ্টিকরণের জন্য আবশ্যক। কেউবা বলেছেন শিল্প হচ্ছে যোগাযোগ স্থাপনের মূল অবয়ব (কর্ম)। এ যোগাযোগ মানুষের সাথে মানুষের, সমাজের সঙ্গে সমাজের, সভ্যতার সঙ্গে সভ্যতার। যার মাধ্যমে অভিজ্ঞতা এবং উন্নয়নের বিষয়ে মতবিনিময় করা যায়। বলা হয়েছে যে, শিল্প অভিজ্ঞতার গুণকীর্তন করতে সক্ষম যা শব্দের দ্বারা সম্ভব নয়। এসব অভিমত ছাড়াও শিল্পের আরো ব্যাখ্যা রয়েছে। যেমন বলা হয়েছে, শিল্প হচ্ছে অপ্রকাশিত রহস্যময় জীবনের প্রকাশ, জীবন সম্পর্কে ব্যাখ্যা বা বিশ্বজনীন ধর্ম, নিছক খেলা, আদর্শবাদের বাহ্যিক রূপ বাধ্যবাধকতামুক্ত, অবাস্তবের আবিষ্কার, নিজ অভিব্যক্তি, মানবতার প্রকাশ ইত্যাদি। অতি সম্প্রতি পাউরুটির প্যাকেট করা থেকে নির্বস্তুক বা বিষয়হীন চিত্রকর্মকে এবং চায়ের কেটলি থেকে আকাশছোঁয়া ইমারতকেও শিল্প হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। প্রিপারেশন ফর আর্ট নামক গ্রন্থসহ (পৃ. ১৯) বিভিন্ন গ্রন্থে এসব বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
শিল্পের সঙ্গে সুন্দরের সম্পর্ক জন্মগত। অর্থাৎ একটি শিল্পকর্মের জন্মই হয় সুন্দরকে প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে। সেই অর্থে শিল্পের সঙ্গে সুন্দরের সম্পর্ক আত্মিক। অর্থাৎ আত্মার সম্পর্ক। কোনো শিল্প যখন সুন্দর রূপ ধারণ করে এবং সেই সুন্দর শিল্পকর্মটি মানুষের হৃদয়ে দোলা দেয়, হৃদয়-মনকে আন্দোলিত করে, উৎফুল্ল করে, মনে নেশা ধরিয়ে দেয় তখন আমরা সেটাকে শিল্পের সৌন্দর্য বলে উল্লেখ করি। কিন্তু এই সৌন্দর্য নিয়ে রয়েছে জটিল ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। প্রকৃত অর্থে কোনটা সৌন্দর্য, সৌন্দর্যের স্বরূপই বা কী এ নিয়ে একেক জন একেক রকম মন্তব্য করেছেন। সৌন্দর্য শরীরবিষয়ক হতে পারে অথবা অশরীরিও হতে পারে। যেমনÑ মানুষ, জীবজন্তু, পাখি এগুলোর রয়েছে শরীরী সৌন্দর্য। আবার যার শরীর নেই, যাকে স্পর্শ করা যায় না, শুধুই শ্রবণ করা যায়, অনুভব করা যায় এমন বিষয়েরও রয়েছে সৌন্দর্য। যেমন সঙ্গীতের সুমধুর সুরলহরি কিংবা আলো। প্রতিটি বিষয়কে আলোকিত করে বলেই সুন্দর বিষয়গুলো দৃষ্টিতে ধরা দেয়। কিংবা আলো নিজেই যেভাবে সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটায় সেই সৌন্দর্যকে শিল্পতাত্ত্বিক ফিসিনো গুরুত্ব দিয়েছেন। অন্যপক্ষে তাত্ত্বিক জিওরডানো ব্রুনো ইন্দ্রীয়গত সৌন্দর্য বা শর্তহীন বিশুদ্ধ সৌন্দর্যের ওপর জোর দিয়েছেন। আবার শিল্পতাত্ত্বিক লিও বাতিস্তা আলবাতি মনে করেন, যা আমাদের সম্মুখে উদ্ভাসিত হয়, যার সঙ্গে কোনো কিছুর যোগ বা বিয়োগ করার প্রয়োজন হয় না, তাই সৌন্দর্য। অলঙ্কারের সাহায্যে, বেশভূষার বা পোশাকের সাহায্যে যদি সৌন্দর্য সৃষ্টি করা হয় কিংবা সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হয়, তাহলে তাকে প্রকৃত সৌন্দর্য বিবেচনা করা যাবে না বলে মত দিয়েছেন তাত্ত্বিক আলবার্তি। তিনি মনে করেন, সৌন্দর্য হচ্ছে একটি বিশেষ গুণ, যা জন্মগত বা সহজাত এবং শরীর বা দেহের সর্বত্র পরিব্যাপ্তি লাভ করে। শিল্পী আলব্রেখট ডুরারের কথা অনেকেই জানে যে, তিনি চিত্রে আলো-ছায়া ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিপ্লব এনেছেন। তাকে আলো-ছায়ার জাদুকর বলা হয়। তিনি শেড বা অন্ধকারের মধ্যে সৌন্দর্য সৃষ্টি করে সবাইকে অবাক করে দিয়েছেন। এই শিল্পী ডুরার যুক্তিনির্ভর সৌন্দর্যের প্রশংসা করেছেন। যুক্তিপূর্ণ নয়, কিংবা যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত নয় এমন সৌন্দর্যকে তিনি গুরুত্ব দেননি। তিনি মনে করেন, প্রকৃত সৌন্দর্য বিষয়বস্তুর ঐক্যের আধার। আধ্যাত্মিকতা এবং ঐশ্বরিকতার অভিব্যঞ্জনাকেও সৌন্দর্যবোধের কারণ বলে মত প্রকাশ করেছেন তিনি। এত গেল পশ্চিমা জগতের তাত্ত্বিকদের সৌন্দর্যবিষয়ক অভিমতের কথা। এশিয়ার তথা ভারতের তাত্ত্বিক জগন্নাথ পণ্ডিত সৌন্দর্যকে চমৎকারিত্ব বলে বর্ণনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিনা প্রয়োজনের যে আনন্দ তাকেই সৌন্দর্যের স্বরূপ বলে বর্ণনা করেছেন। শিল্পী এবং তাত্ত্বিক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘যে আলোয় দোলে অন্ধকারে দোলে, কথায় দোলে সুরে দোলে, ফুলে দোলে, ফলে দোলে, বাতাসে দোলে, পাতায় দোলে, সে শুকনোই হোক, তাজাই হোক, সুন্দর হোক, অসুন্দর হোক, সে যদি মন দোলালো তো সুন্দর হলো’। সুন্দর এবং সৌন্দর্য সম্পর্কিত এসব তথ্য মেলভিন রাডারের মর্ডান, বুক অব এসথেটিকস, নিউ ইয়র্ক, আচার্য সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্তের সৌন্দর্য তত্ত্ব, ড. আবদুস সাত্তারের প্রকৃত শিল্পের স্বরূপ সন্ধান, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি এবং প্রাচ্যচিত্রের সৌন্দর্য নামক গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত আছে। এসব তথ্য-উপাত্ত কমবেশি এশীয় শিল্পের সৌন্দর্য তত্ত্বকে আলোকিত করেছে।
এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শিল্প সংস্কৃতির ক্ষেত্রে চীনের সুখ্যাতি সর্বজনবিদিত। চীনের শিক্ষা, সভ্যতা অনেক দেশের জন্যই অনুসরণীয়। কিন্তু অনেকেরই হয়তো জানা নেই, চীনের চেয়েও শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ভারতবর্ষ অনেক এগিয়ে। বৌদ্ধ ধর্ম বিষয়ে জানার জন্য এবং তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের জন্য চীন থেকে লোক পাঠানো হয়েছিল ভারতে। সম্রাট সিং জি ৬১ খ্রিষ্টাব্দে এই লোক পাঠিয়েছিলেন। প্রাচ্য হ্যান বংশের ইতিহাসে বিষয়টি লিখিত আছে।
শুধু তাই নয়, চীনারা ভারতীয় শিল্পকর্ম থেকেও শিক্ষা গ্রহণ করেছে এবং নিজেদের শিল্পকর্মকে সমৃদ্ধ করেছে (আচার্য সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত, সৌন্দর্যতত্ত্ব, পৃ. ১৩৮)। বর্তমান আধুনিককালে যন্ত্রচালিত নানা ধরনের পুতুল, পাখি এবং সিংহ কিংবা কুকুরের মুখ নিঃসৃত পানির কল বা ফোয়ারার জন্য পশ্চিমা সভ্যতা যে গৌরব অনুভব করে সেই গৌরবের বিষয়টিও ম্লান হয়ে যায় যখন দেখা যায়, এর চেয়েও উন্নত ব্যবস্থা প্রাচীন ভারতে প্রচলিত ছিল। বহু শতাব্দী আগে প্রাচীন ভারতের সুপ্রসিদ্ধ কবি বানভট্ট কাদম্বরীর আবাসস্থলে ক্রিস্টালের তৈরী বকের মুখ দিয়ে পানি নির্গত হওয়ার ব্যবস্থা ছিল। কোথাও ফলের সাহায্যে ঘূর্ণায়মান মেঘমালার ব্যবস্থা ছিল। যেগুলো ঘুরে ঘুরে দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করত। এই মেঘমালার মাঝে রামধনুর সৃষ্টি হতো। কোথাও বা কলের সাহায্যে, নির্মিত বৃক্ষ বারিবিন্দু বর্ষণ করত এমন ব্যবস্থাও ছিল। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছেÑ কল বা যন্ত্রের সাহায্যে সৃষ্ট এক ধরনের পাখি ডানা মেলে উড়ে উড়ে জলকণামিশ্রিত ঠাণ্ডা বাতাসের প্রবাহ ছড়িয়ে দেয়ার মতো ব্যবস্থাও ছিল (গিরিশচন্দ্র বেদান্ততীর্য, প্রাচীন শিল্পপরিচয়, কলিকাতা-৯, পৃ. ১২০-২১)। প্রাচীন ভারতের এসব প্রভাবিত শিল্প সফলতা এবং এর সৌন্দর্যের বিষয় পশ্চিমা সভ্যতার অহঙ্কারকে ধূলিসাৎ করে দেয়।
যথার্থ শিল্প এবং শিল্প সৌন্দর্যের ক্ষেত্রেও যে ভারত প্রাচীনকাল থেকেই সমৃদ্ধ ছিল তার অসংখ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রকৃত অর্থে ভারতীয় শিল্প এবং শিল্পের সৌন্দর্য বিকাশ লাভ করেছে ধর্মকে কেন্দ্র করে। ধর্মীয় অনুভূতি শিল্পের পেছনে কাজ করেছে বলেই শিল্প হয়েছে স্বার্থক এবং সুন্দর। সুন্দর এবং সাবলীল। ধর্মের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধাভক্তি এবং ঈশ্বরের প্রতি বিনম্র ভক্তি ভালোবাসা এবং ভীতি ভারতের শিল্পকলাকে করেছে সার্বিক সফল এবং স্মরণীয়। এ জন্যই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভারতীয় শিল্পকে অনুসরণ করেছে। প্রাচীন আর্য সাহিত্য, চিত্রসূত্র, বৈদিক গ্রন্থসহ বিভিন্ন সূত্রে এসব তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়। এসব গ্রন্থের বর্ণনাতেই স্পষ্ট, প্রাচীন ভারতের শিল্পকর্ম কতটা সার্থক, সমৃদ্ধ এবং নান্দনিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ ছিল। চিত্রসূত্রকে চিত্রবিদ্যার আদিম গ্রন্থ গণ্য করা হয়। এ গ্রন্থে ধর্মীয় শিল্প নির্মাণের বিধিবিধানগুলো স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। চিত্রসূত্র নামক গ্রন্থের উপসংহারে বলা হয়েছে, ‘কলার মধ্যে চিত্রই প্রধান বলিয়া বিবেচিত হইয়াছে। উহা ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ এই চতুরবর্গ ফলের প্রদায়ক। উহা যে গৃহে স্থাপিত হয়, সেখানে মঙ্গল বিধান করে।’ এই গ্রন্থে আরো বলা হয়েছে, চিত্রের সহিত নৃত্যের বিশেষ সম্বন্ধ আছে। কারণ নৃত্যের ন্যায় চিত্রেও ত্রৈলোক্যের অনুকৃতি হইয়া থাকে। সুতরাং মহানৃত্যে যেরূপ দৃষ্টি, ভাব, অঙ্গোপাঙ্গ ও হস্তের নির্দেশ হইয়াছে, চিত্রেও সেইরূপ বুঝিতে হইবে (গিরিশচন্দ্র নেতান্ততীর্থ, প্রাচীন শিল্প-পরিচেয়, পৃ. ১০৫)।
প্রাচীনকালে শিল্পীদের মনগড়া কিছু করার সুযোগ ছিল না। কারণ কোন শিল্প কিরূপ হবে সে বিষয়ে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নিয়ম বেঁধে দেয়া ছিল। আমরা পশ্চিমা জগতের রেনেসাঁ এবং রেনেসাঁ যুগের পরবর্তী পর্যায়ের উন্নয়ন সম্পর্কে সীমাহীন গর্ব অনুভব করি। বিভিন্ন পণ্ডিত এবং শিল্পীর মানবদেহের আনুপাতিক বিভাজন বিষয়ে আমরা যথেষ্ট গুরুত্ব দেই। কিন্তু ভারতবর্ষে সেই প্রাচীনকালেই যে শিল্পকর্মের স্থায়িত্ব ও উন্নয়ন বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত প্রদান করা হয়েছে এবং মানবদেহের আনুপাতিক পরিমাপ সম্পর্কে মাপজোকের হিসাব দেয়া হয়েছে সে বিষয়ে কোনো খবরই রাখি না। আমরা পশ্চিমা প্রেমে এতটাই বিভোর যে, নিজেদের কর্মকাণ্ড এবং অবদানের কথা স্মরণ করতেও ভুলে গেছি। এ কথা ঠিক যে, পশ্চিমা জগত শিল্পকলার অনেক কিছুকে সহজ করে দিয়েছে। যেমন রঙ। রঙের ব্যবহার এশিয়ার দেশগুলোর জন্য কষ্টসাধ্য ছিল। কারণ রঙ প্রকৃতি থেকে আহরণপূর্বক সেগুলোকে ব্যবহার উপযোগী করে নিতে হতো। যেমন নীল রঙের পাথর ঘষে ঘষে দীর্ঘ সময় ধরে পস্তুত করতে হতো। এর পর ঘষে প্রস্তুতকৃত রঙের সঙ্গে আঠাজাতীয় উপকরণ কিংবা ডিমের কুসুম (হলুদ অংশ) মিশিয়ে তবেই আঁকার কাজে ব্যবহর করতে হতো। সেখানে পশ্চিমাদের আমদানি করা টিউবের রঙ সেই কষ্টকে লাঘব করে দেয়। সুতরাং সহজে ব্যবহারযোগ্য রঙ গ্রহণ করতে বাধা নেই। দোষেরও কিছু নেই। দোষের হচ্ছে নিজেদের ভুলে যাওয়া, নিজেদের অতীত গৌরবজনক অবদানকে স্মরণ না করা। একতরফা পশ্চিমাদের গুণগান করা এবং নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতিবিবর্জিত বিষয়কে শিল্পে ব্যবহার করা। উন্মাদের মতো পশ্চিমাদের পেছনে ছুটে চলা। মাতৃভূমি মাকে অস্বীকার করে পশ্চিমের ‘মাদার’কে গ্রহণ করে গর্ব অনুভব করা। এ সবই অস্বাভাবিক এবং নির্লজ্জ বেহায়াপনা। ভারতপ্রেমী শিল্পীরা পশ্চিমাদের অনুকরণ-অনুসরণে যারা শিল্পচর্চা করেন তাদেরকে চোর বলতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। তারা বলেছেন, ‘এ দেশে বসে জার্মান এবং আমেরিকার আর্থসামাজিক পটভূমির পরিপ্রেক্ষিতে ছবি আঁকেন যারা আমরা তাদের সাথে নেই। পোস্ট মর্ডানিজমের নামে এক ধরনের নকলনবিসি কাজ আমাদের সংস্কৃতির ক্ষতি করছে। আমরা সোসাইটির সদস্যরা সব সময় এই চ্যালেঞ্জের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চাই। গ্লোবালাইজেশনের নামে এই কুম্ভিলক প্রথা একদিন আমাদের দেশীয় শিল্পকলার ক্ষেত্রে জাতীয় বিপর্যয় হিসেবে দেখা দিতে পারে (ড. আবদুস সাত্তার, সোমনাথ হোরের পত্র কলকাতার চিত্র, পৃ. ৭৬)।
একসময় বিদেশীরা এবং ভারতের খ্যাতিমান শিল্পীরা যে অজন্তা গুহার চিত্রাবলি অনুশীলন করে নিজেদের চিত্রকর্ম এবং চিত্রনির্মাণ পদ্ধতিকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। সেই অজন্তাকে সবাই ভুলে গেছেন পশ্চিমের শিল্প পদ্ধতিকে অনুসরণ করতে গিয়ে। টেকসই এবং স্থায়ী দেয়ালচিত্র অঙ্কন পদ্ধতিও বিস্মৃত হয়েছি আমরা। দীর্ঘস্থায়ী দেয়ালচিত্রের পদ্ধতিতে যেসব উপকরণ ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে, তার সবই সহজলভ্য ও দেশজ। যেমনÑ তিন প্রকার ইটের গুঁড়া, সাধারণ মাটি তিন ভাগ, গুগগুল, মোম, মধুক অর্থাৎ রঙ অথবা যষ্টিমধু, মুরুক (একপ্রকার গন্ধ্যদ্রব্য), গুড়, কুসুম্ভ এবং তেল সমান ভাগে গ্রহণ করে তিন ভাগ চুনের সঙ্গে চূর্ণাকারে মিশিয়ে নিতে হবে। উল্লেখ্য, উল্লিখিত উপকরণাদি মিশ্রণের সময় দুই ভাগ কাঁচা বিল্বচূর্ণ এবং প্রয়োজনমতো বালু ও গাছের ছালবাকল ভেজান বিজলীভাবাপন্ন পানি প্রয়োগ করতে হবে। এভাবে মিশ্রণের ফলে মিশ্রণ নরম স্বভাবের হবে। তবে এই পানিতে ভেজান উপকরণগুলো এক মাস ভিজিয়ে রাখতে হবে। তারপর সব উপকরণ মিশ্রিত করলে ব্যবহার উপযোগী হবে। এভাবে প্রস্তুতকৃত উপকরণের মিশ্রণের সাহায্যে, দেয়ালে প্রলেপ দিয়ে চিত্রাঙ্কন করলে চিত্র দীর্ঘস্থায়ী হবে। শতবর্ষ পরও চিত্রের কোনো ক্ষতি হবে না।
আধুনিক পশ্চিমা সভ্যতা শিল্পকর্ম নির্মাণের ক্ষেত্রে যেসব বিধিবিধানের কথা বলে থাকে, তার সবই উল্লেখ করা হয়েছে ভারতীয় প্রাচীন শাস্ত্রে। অর্থাৎ পশ্চিমা জগৎ বর্তমানে যা ভাবছে এবং যেসব তথ্য প্রদান করছে তার সবই সর্বাগ্রে ভেবেছেন এশিয়ার শিল্পশাস্ত্রকাররা এবং সেই ভাবনা এবং যৌক্তিক বিষয়গুলো লিখিত আকারে প্রকাশ করে গেছেন। অর্থাৎ পশ্চিমা জগৎ এশিয়া বিশেষ করে ভারতীয় সভ্যতা এবং শিল্প-সংস্কৃতির কাছে ঋণী। আমাদের জানা যে, বিশ্বখ্যাত শিল্পী লিওনার্দো দা-ভিঞ্চি ‘লাস্ট সাপার’ নামক দেয়ালচিত্র আঁকার সময় একজন খুনির চেহারা কেমন হওয়া উচিত তা জানার জন্য বিভিন্ন সরাইখানাসহ নানা স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছেন। অসংখ্য স্টাডি করেছেন এবং যখন যথাযথ কিংবা অর্থবহ হয়েছে মনে করেছেন, তখনই সেই চেহারা চিত্রে ব্যবহার করেছেন। ভারতীয় শিল্পশাস্ত্রে এ কথাই স্পষ্ট করে বলা হয়েছেÑ কার চেহারা কেমন হওয়া উচিত এবং কিভাবে তা করা উচিত।


আরো সংবাদ



premium cement
আশুলিয়ায় বাঁশবাগান থেকে নারী পোশাক শ্রমিকের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার মিয়ানমারের কর্মকর্তারা ফেরত গেলেন, কিন্তু রোহিঙ্গা সঙ্কট কি আরো জটিল হচ্ছে দিনাজপুরে দুই ট্রাকের সংঘর্ষ, চালক-হেলপার নিহত মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২ সখীপুরে বৃষ্টির জন্য অঝোরে কাঁদলেন মুসল্লিরা দক্ষিণ ভারতে কেন কাজ করেনি বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের নতুন আংশিক কমিটি বাংলাদেশের হাসপাতাল ও চিকিৎসায় বিনিয়োগ সম্ভাবনা অন্বেষণে থাইল্যান্ডের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান ট্রাম্পের বিচার নিয়ে বিভক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট চুয়েট শিক্ষার্থীদের আন্দোলন স্থগিত, ক্লাসে ফেরার সিদ্ধান্ত আমদানি ব্যয় কমাতে দক্ষিণাঞ্চলের সূর্যমুখী তেলের আবাদ

সকল