২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বগুড়ার ৭টি আসনের বর্তমান এমপিদের সম্পদ বেড়েছে বহুগুণ

বগুড়ার ৭টি আসনের বর্তমান এমপিদের সম্পদ বেড়েছে বহুগুণ - সংগৃহীত

বগুড়া জেলার ৭টি আসনের মহাজোট মনোনীত বর্তমান সংসদ সদস্যদের সম্পদ গত ৫ বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। তবে এসব সংসদ সদস্যদের নিজের সম্পদের চেয়ে তাদের স্ত্রীদের সম্পদ বেড়েছে বেশি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষ্যে জমা দেয়া হলফনামা অনুযায়ী এই তথ্য পাওয়া গেছে।

হলফনামায় উল্লেখ করা তথ্য থেকে জানা গেছে, জেলার ৭টি আসনের এমপিদের মধ্যে গত পাঁচ বছরে সবচেয়ে বেশী সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে বগুড়া-১ (সারিয়াকান্দি-সোনাতলা) আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আব্দুল মান্নানের। একই সময়ে প্রায় ৯ গুণ বেশি সম্পদ বেড়েছে বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনের জাসদ (ইনু) দলীয় সংসদ সদস্য রেজাউল করিম তানসেনের।

অপরদিকে বগুড়া-২ (শিবগঞ্জ) আসনের জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য শরিফুল ইসলাম জিন্নাহর আয় না বাড়লেও কমেছে একই দলের বগুড়া-৬ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম ওমরের।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে অংশগ্রহণের পূর্বে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় বর্তমান সংসদ সদস্যরা প্রত্যকেই হলফনামায় তাদের আয়, স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের বিবরণী দাখিল করেছিলেন। আসন্ন একাদশ সংসদ নির্বাচনেও ওই সংসদ সদস্যরা অংশ নিচ্ছেন। এ জন্য গত ২৮ নভেম্বর মনোনয়নপত্রের সাথে হলফনামা দাখিল করেন তারা।

বগুড়া-১ (সারিয়াকান্দি-সোনাতলা) আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য আব্দুল মান্নানের ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে কৃষি খাত, বাড়ি ভাড়া ও শেয়ার থেকে আয় হতো ৬ কোটি ১ লাখ ৭৯ হাজার ৯১০ টাকা। পাঁচ বছরের ব্যবধানে সেই আয় ১ কোটি ৫২ লাখ ৭৮ হাজার ৬২১ টাকায় কমে এসেছে।

তবে আয় কমলেও নগদ টাকাসহ অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে ৩ কোটি ২৭ লাখ টাকার। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে দাখিল করা হলফনামা অনুযায়ী একটি ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে আব্দুল মান্নানের সম্পদের পরিমাণ ছিল ৭ কোটি ২৫ লাখ ৬১ হাজার ৬৬৮ টাকার। যা বর্তমানে বেড়ে হয়েছে ১০ কোটি ৫৩ লাখ ১০ হাজার ৯৫ টাকা।

একইভাবে তার স্ত্রীর নামেও প্রায় পৌণে ৪ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে। ২০১৩ সালে তার স্ত্রী সাহাদারা মান্নানের সম্পদের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৮৪ লাখ ৯১ হাজার ৭৮২ টাকা। বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ৩ কোটি ৮৩ লাখ ৬৭ হাজার ১৯০ টাকা। সাহাদারা মান্নান বর্তমানে সারিয়াকান্দি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি।

আব্দুল মান্নানের নিজের নামে কোন কৃষি জমি না থাকলেও তার স্ত্রীর পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ৩ দশমিক ১৮ একর জমি রয়েছে যার মূল্য ৩ কোটি ৫৩ লাখ ৬১ হাজার ৬৬১ টাকা। মান্নানের অকৃষি জমি বাড়লেও কমেছে তার স্ত্রীর। ২০১৩ সালে আব্দুল মান্নানের নামে ৩৫ লাখ ৮৬ হাজার ৪০০ টাকা মূল্যের কৃষি জমি থাকলেও এখন রাজউকের প্লট যুক্ত হওয়ায় আরও প্রায় ৯ লাখ টাকা বেড়ে ৪৪ লাখ টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

তবে তার স্ত্রী সাহাদারা মান্নানের নামে আগে ১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা ৪২ হাজার টাকার অকৃষি জমি থাকলেও তা কমে ৫৮ লাখ ৯০ হাজার টাকা হয়েছে। সম্পদ বৃদ্ধির সাথে সাথে এমপি মান্নানের দালান ও বাড়ির সংখ্যাও বেড়েছে। তার নামে তিনতলা এবং পাঁচতলা দু’টি বাড়ি হয়েছে। যার মূল্য ২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।

এছাড়াও স্থাবর সম্পদ হিসেবে ‘অন্যান্য’ খাতে তার স্ত্রীর আরও ১০ লাখ টাকার সম্পদ থাকার কথা হলফনামায় উল্লেখ করা হয়েছে। সংসদ সদস্য আব্দুল মান্নান পাঁচ বছরে ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করলেও ব্যক্তিগত ঋণ তেমন কমাতে পারেন নি।

২০১৩ সালে ব্যাংক থেকে নেয়া তার ব্যক্তিগত ঋণের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৩৬ লাখ যা বর্তমানে কমে হয়েছে ১ কোটি ৩৪ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। তিনি একাদশ সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন লাভ করেছেন।

সংসদ সদস্য থাকা সত্ত্বেও আয় বাড়েনি বগুড়া-২ (শিবগঞ্জ) আসনের জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ও জেলা জাপা সভাপতি শরিফুল ইসলাম জিন্নাহর। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে কৃষি, বাড়ি ভাড়া এবং ব্যবসা থেকে তার আয় ছিল ৩ লাখ ১৯ হাজার ৬০০ টাকা। ২০১৪ সালের ২৮ নভেম্বর দাখিল করা হফলনামায় তিনি ওই তিনটি খাতে তার আয় একই দেখিয়েছেন।

পাঁচ বছর আগে তার কাছে নগদ টাকা ছিল ৪ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। এখন সেটি কমে হয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। তবে স্ত্রীর নগদ টাকা ১ লাখ বেড়ে হয়েছে দেড় লাখ। অবশ্য আগে ব্যাংকে কোন টাকা জমা না থাকলেও এখন তার নামে জমা আছে ৫০ লাখ ৬২ হাজার ৭৯৭ টাকা। পাঁচ বছর আগে শুধু স্ত্রীর নামে একটি পাঁচ লাখ টাকা মূল্যের গাড়ি থাকলেও এখন সেটি নেই।

তবে সংসদ সদস্য শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ নিজে ৩৬ লাখ ৭৪ হাজার ৯৯১ টাকা মূল্যের ল্যান্ড ক্রুজার গাড়ি কিনেছেন। আগে আগ্নেয়াস্ত্র না থাকলেও এখন তিনি একটি পিস্তল এবং একটি মিনি রাইফেলের মালিক। যার মূল্য ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। তবে পাঁচ বছরের ব্যবধানে তিনি ব্যাংক থেকে ব্যবসা এবং গাড়ি কেনার জন্য ৩৬ লাখ ১৬ হাজার ৭৪২ টাকা ঋণ করেছেন।

বগুড়া-৩ (আদমদীঘি-দুপচাঁচিয়া) আসনের জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম তালুকদারের আয় বেড়েছে। পাঁচ বছর আগে তিনি কৃষি খাত এবং আইন পেশা থেকে বছরে আয় করতেন ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। বর্তমানে তিনি ওই দু’টি খাতের পাশাপাশি সংসদ সদস্য হিসেবে তার আয় বেড়ে হয়েছে ৮ লাখ ৯০ হাজার ৪০০ টাকা।

পাঁচ বছরের ব্যবধানে তার নগদ টাকার পরিমাণ পনেরো গুণ বেড়ে হয়েছে ১৫ লাখ টাকা। তবে ব্যাংকে জমা করা টাকার পরিমাণ ২ লাখ থেকে ১ লাখে নেমে এসেছে। বর্তমানে ৩৫ লাখ টাকার জীপ গাড়ির মালিক নুরুল ইসলাম তালুকদার ৪২ লাখ টাকা দামের একটি ফ্লাটেরও মালিক হয়েছেন। অবশ্য আয় এবং সম্পদ বাড়ানোর পাশাপাশি তিনি গৃহ নির্মাণের জন্য ৮০ লাখ টাকা ঋণও করেছেন।

বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনের জেলা জাসদের সভাপতি ও সংসদ সদস্য রেজাউল করিম তানসেনের আয় পাঁচ বছরের ব্যবধানে প্রায় ৯ গুণ বেড়েছে। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে দাখিল করা হলফনামা অনুযায়ী কৃষি খাত, বাড়ি ভাড়া, ব্যবসা ও শেয়ার থেকে তার আয় ছিল সাড়ে ৬ লাখ টাকা। এখন ওইসব খাতের পাশাপাশি সংসদ সদস্য হিসেবে সম্মানী ভাতাসহ তাঁর আয় দাঁড়িয়েছে ৫৪ লাখ ১০ হাজার ৬২২ টাকা।

হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ বছর আগে তার কোনো নগদ কিংবা ব্যাংকে জমানো কোনো টাকা ছিল না। কিন্তু ৫ বছর পর সেই তানসেনের হাতে এখন নগদ ২ লাখ টাকার পাশাপাশি ব্যাংকে ৫ লাখ টাকা রয়েছে।

এছাড়া পাঁচ বছর আগে তার কোনো গাড়ি না থাকলেও এখন তিনি দু’টি গাড়ির মালিক হয়েছেন। গাড়ি দুটির মূল্য ১ কোটি ১০ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। একটি ভিটে বাড়ি থেকে তিনি এখন দু’টি বাড়ির মালিক হয়েছেন যার মূল্য প্রায় ৬০ লাখ টাকা। আয় ও সম্পদ বৃদ্ধির কারণে পাঁচ বছর আগে ব্যাংক থেকে নেয়া ১৫ লাখ টাকার মধ্যে সাড়ে ১৪ লাখ টাকাই শোধ করেছেন।

২০১৩ সালে তার স্ত্রীর নামে নগদ কোনো টাকা কিংবা স্বর্ণালংকার ছিল না। তবে এখন দুই লাখ টাকার পাশাপাশি ৫ ভরি স্বর্ণালংকারের মালিক হয়েছেন তার স্ত্রী।

বগুড়া-৫ (শেরপুর-ধুনট) আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য ও সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা হাবিবর রহমানের আয় গত ৫ বছরে কমেছে। তবে সম্পদ বেড়েছে এই সংসদ সদস্য এবং তার স্ত্রীর। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে কৃষি খাত, চাকরি ও ভাতা থেকে সংসদ সদস্য হাবিবরের আয় ছিল ৯৪ লাখ ৪০ হাজার ৪৭৫ টাকা। কিন্তু বর্তমানে তা কমে হয়েছে ২৭ লাখ ৩২ হাজার ৭৬২ টাকা। তবে নগদ টাকাসহ তার অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে।

২০১৩ সালে নগদ টাকাসহ তার অস্থাবর সম্পদের মূল্য ছিল ১ কোটি ২৭ লাখ ২৯ হাজার ৪৮৫ টাকা। পাঁচ বছরের ব্যবধানে তা বেড়ে হয়েছে ৩ কোটি ২১ লাখ ৫ হাজার ৩১৫ টাকা। সংসদ সদস্য হাবিবর রহমানের পাশাপাশি তাঁর স্ত্রীরও অস্থাবর সম্পদ প্রায় ১৫৪ গুণ বেড়েছে।

২০১৩ সালে তার স্ত্রীর ৪৫ হাজার টাকার স্বর্ণালংকার ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কিন্তু বর্তমানে নগদ টাকা, শেয়ার, স্বর্ণালংকার, গাড়ি এবং একটি রাইফেলের মালিক হয়েছেন তিনি। তবে সংসদ সদস্য হাবিবর রহমান পাঁচ বছরেও ঋণের বোঝা থেকে বের হতে পারেননি। বর্তমানে গৃহ নির্মাণ ও শুল্কমুক্ত জিপ গাড়ির জন্য তার ৪৩ লাখ টাকা ঋণ আছে।

বগুড়া-৬ (সদর) আসনের জাতীয় পার্টির এমপি ও জেলা জাপার সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম ওমরের পাঁচ বছর আগে কৃষি খাত ও ব্যবসা থেকে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা আয় করতেন। বর্তমানে ওই দু’টি খাতে তার আর কোনো আয় নেই। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে দাখিল করা হলফনামায় তিনি নিজেকে ‘ঠিকাদার’ পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন পেশা পরিবর্তন করে হয়েছেন ‘সংসদ সদস্য’।
বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ নুরুল ইসলাম ওমরের অবশ্য পাঁচ বছরের ব্যবধানে নগদ প্রায় ৮ লাখ টাকা বেড়েছে। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে তার নগদ ৪০ লাখ ৬৬ হাজার ৩৪৪ টাকা ছিল। বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ৪৮ লাখ ৭২ হাজার ১৬৩ টাকা। তবে আগে স্ত্রীর নামে নগদ ১লাখ টাকা থাকলেও এখন তার হাতে কোনো টাকা নেই।

স্থাবর সম্পদ প্রায় অপরিবর্তিত থাকলেও পাঁচ বছরে ব্যাংক ঋণের অঙ্ক কমাতে সক্ষম হয়েছেন নুরুল ইসলাম ওমর। ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকে তার ঋণের পরিমাণ ছিল ১ কোটি টাকা। বর্তমানে তার ঋণের পরিমাণ ৬১ লাখ ৩৩ হাজার ৭৯৬ টাকা।

বগুড়া-৭ (গাবতলী ও শাজাহানপুর) আসনের জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ আলতাফ আলীর আয় পাঁচ বছরে প্রায় তিনগুণ বাড়লেও তার নিজের এবং নির্ভরশীলদের হাতে কোনো নগদ টাকা নেই বলে হলফনামায় উল্লেখ করেছেন। এমনকি ব্যাংকেও তার কোনো টাকা জমা নেই বলে উল্লেখ করেছেন।

অথচ ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে তার কাছে নগদ ১ লাখ টাকা এবং ব্যাংকে ছিল আরও ২ লাখ টাকা ছিল বলে উল্লেখ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, আগে তার স্ত্রী এবং নির্ভরশীলদের নামে যে ২০ ভরি স্বর্ণালংকার ছিল, বর্তমানে ‘সেটিও আর নেই’।

অবশ্য স্ত্রী ও নির্ভরশীলদের না থাকলেও নিজে ৩০ হাজার টাকার স্বর্ণালংকার রাখার কথা জানিয়েছেন তিনি। এখানেই শেষ নয়, ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী ও আসবাবপত্রও কমেছে তার। পাঁচ বছর আগে তার বাড়ির ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী ও আসবাবপত্রের মূল্য ছিল ৩ লাখ টাকা কিন্তু এখন তার দাম মাত্র ৫৫ হাজার টাকা বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।

এই সংসদ সদস্য পাঁচ বছরের ব্যবধানে একটি বাড়ি করলেও তার মূল্য জানাতে চাননি তিনি। এমনকি ৪৭ লাখ ২০ হাজার ৩৭৯ টাকার অস্থাবর সম্পদের মালিক হয়েও তিনি ৫ লাখ ৭০ হাজার টাকা ঋণ করেছেন।


আরো সংবাদ



premium cement