২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অ ভি ম ত : কোরবানির চামড়া ও মাদরাসা

-

বাংলাদেশ বহু ধর্মের সম্প্রীতির দেশ এবং এখানে মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা লক্ষ্যণীয়। মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে দাবি করলেও এদেশে এখনো জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশ মধ্যম আয়ের সুবিধা থেকে বঞ্চিত বা সহজ কথায় ‘দরিদ্র’। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরানো’ এসব পরিবারের মধ্যে সন্তানাধিক্যও চোখে পড়ার মতো। এ জন্য অনেক দরিদ্র মা-বাবারই ইচ্ছা থাকলেও তারা সন্তানের ন্যূনতম শিক্ষার ব্যবস্থাও করতে পারেন না। তবুও তাদের অবদমিত ইচ্ছা, আর্থিক দৈন্য আর ধর্মভীরুতা এক হয়ে বেশির ভাগ সময় তারা সন্তানদের এতিমখানা-মাদরাসায় পাঠান। বিশেষত অতিশয় গরিব মা-বাবারা এ পথ বেছে নিতে বাধ্য হন। এর পেছনে বেশ কিছু কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ এতে করে পরিবারে অন্তত একটি খাওয়ার মুখ কমল। সাথে পরকালে সাফল্য পাওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল বলে মনে করা হয়। তবে সবার ওপরে, নিঃসন্দেহে সন্তানের মঙ্গল কামনাই মা-বাবার মুখ্য উদ্দেশ্য।
কিন্তু ‘দোজাহানের কামিয়াবি’ হাসিল করতে মাদরাসায় পাঠানো, সেসব এতিমখানা বা মাদরাসার ভেতরের প্রকৃত চিত্রটা ঠিক কেমন? দেখা যাক সে চেহারা।
এ দেশের সম্ভ্রান্ত মুসলিমদের মধ্যে মাদরাসা বা এতিমখানা স্থাপনের ঝোঁক দেখা যায়, যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এক পুরুষ পরে ঝিমিয়ে পড়ে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠান চালানোর জন্য সরকারি বা ব্যক্তিগত দান-অনুদানের দ্বারস্থ হতে হয়। ফলে অনেক মাদরাসা বা এতিমখানার ছাত্র ও শিক্ষকেরা মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হন। সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত, বরিশালের এক মাদরাসায় শিশুদের শুধু মুড়ি খেয়ে দিন কাটানোর খবর এর মর্মান্তিক উদাহরণ।
যা হোক, এসব মাদরাসার আয়ের একটা বড় উৎস হলো কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহের পর তা বিক্রির অর্থ। এ কারণে কোরবানির আগেই বিভিন্ন মাদরাসা কোরবানির পশুর চামড়া দানের জন্য পোস্টার বা লিফলেট বিলি করে থাকে। ঈদের দিন পশু জবাইয়ের স্থানে মাদরাসার ছাত্ররা দাঁড়িয়ে থাকে চামড়া সংগ্রহের আশায়। কিন্তু প্রায় প্রতি বছরই চামড়া ব্যবসায়ীরা মুনাফার লোভে সিন্ডিকেট করে চামড়ার ন্যায্যমূল্য থেকে মওসুমি এসব বিক্রেতাদের বঞ্চিত করে থাকেন। বলতে দ্বিধা নেই, অনেক সময় সরকারকেও তাদের কাছে অসহায় মনে হয়। যেমনÑ এ বছর কোরবানির ঈদে চামড়া ব্যবসায়ীদের দাপট ও দৌরাত্ম্য আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে। এর প্রতিবাদে কেউ চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলার, কেউবা তা পুড়িয়ে আবার কেউ বিভিন্ন রেসিপিতে রান্না করে খাওয়ার কথাও বলছেন। কিন্তু এসব কিছুই ‘চোরের ওপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়া’র মতো মনে হয়। আমরা কি আরেকটু গঠনমূলকভাবে ভাবতে পারি না?
মাদরাসায় প্রধানত ধর্মীয় শিক্ষা দেয়ার কারণে এখান থেকে বের হয়ে ছাত্ররা আজো মসজিদ-মাদরাসায় চাকরি করা বা কেউ কেউ ওয়াজ মাহফিলের বক্তা হওয়া ছাড়া তেমন কোনো বিকল্প জীবিকা গ্রহণ করতে পারে না। এর ফলে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে খুব একটা মুক্তি মেলে না। কিন্তু মাদরাসায় যদি চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের ওপর ছাত্রদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় তবে বেশ কিছু ফায়দা হবে। ১. কোরবানি পর পাওয়া চামড়া মাদরাসাগুলো নিজেরাই প্রক্রিয়াজাত করে বিক্রি করতে পারলে আর্থিক সুবিধা বাড়বে। ২. মাদরাসা ছাত্রদের বিকল্প জীবিকার উপায় সৃষ্টি হবে। ৩. অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট অকার্যকর হবে। সর্বোপরি, দেশের আর্থিক উন্নয়ন ঘটবে।
তবে এসব কিছুর জন্য সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। যেমনÑ প্রথমত. মাদরাসায় শিক্ষার্থীদের জন্য এ সংক্রান্ত কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। বর্তমান সরকার মাদরাসা শিক্ষার প্রতি দৃশ্যত ইতিবাচক হওয়ায় এটি খুব কঠিন কিছু নয়। এতে করে তাদের স্বনির্ভরতা তৈরি হবে। দ্বিতীয়ত. প্রক্রিয়াজাত চামড়ার বিক্রি ও রফতানির জন্যও সরকারকেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে হবে।
এ কাজ কঠিন। কিন্তু অসম্ভব নয়। অনেকেই হয়তো বলবেন সরকার চাইলে তো বর্তমান এ সঙ্কটেরই সমাধান সম্ভব। এ ক্ষেত্রে বলা যায়, বহুদিন ধরে বিদ্যমান, মধ্যস্বত্বভোগী এ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ হয়তো সহজ নয়; কিন্তু বিকল্প এ উদ্যোগে নিশ্চিতভাবে একসময় এ অর্থগৃধনুদের পরাহত করা যাবে। মোট কথা, সবকিছু আজ ইউটোপিয়া মনে হলেও এর বাস্তবায়ন খুব কঠিন নয়। আর একটা সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য আমাদের এমন উদ্যোগ নেয়াটাও কিন্তু খুব বেশি কিছু নয়। হ
লেখক : জিনান বিনতে জামান, শিক্ষক।
zinanphilosophy@gmail.com

 


আরো সংবাদ



premium cement