২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রাজনীতির ‘বাম হাত’

সময়-অসময়
-

Left Hand of the Law প্রবাদ বাক্যটি আইনশাস্ত্র প্রয়োগ হওয়ার দিন থেকেই চলে আসছে। ধারণা করা হয়, জনগণের কল্যাণের জন্য আইনের চেয়ে অধিক সত্য কথা এই যে, ক্ষমতাকে আঁকড়ে রাখার জন্যই আইন প্রয়োগ করা হয় এবং হচ্ছে। যখন এর ব্যত্যয় ঘটে, তখনই ‘জনস্বার্থের’ কথা বলে আইনটি বাতিল করা হয়, যে আইন রচিত হয়েছিল ‘জনস্বার্থের’ কথা বলেই। ‘জনস্বার্থ’ যখন রাজার স্বার্থে (‘রাজা’ বলতে ক্ষেত্রমতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, শাসনকর্তাকে বোঝানো হয়েছে) আঘাত হানে, তখনই আইনটিকে বিলুপ্ত করে মাটিচাপা দেয়া হয়। যেমনÑ আমাদের সংবিধান থেকে নির্দলীয় তত্ত্ব¡াবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের অনুচ্ছেদটি ক্ষমতায় এসেই মাটিচাপা দিলেন প্রধানমন্ত্রী, যিনি ছিলেন আইনটি পাস করানোর অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা। প্রস্তাবটি প্রথমে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে উপস্থাপন করা হয়েছিল। আইনের ‘বাম হাতের’ শেষ নেই। আইন প্রয়োগকারী ব্যক্তিরাও আইনের অপপ্রয়োগ করে থাকেন আইনের ‘বাম হাত’ ব্যবহার করে। যেমনÑ একই অপরাধ সরকারি দল করলে আইন প্রয়োগকারীরা অন্ধের মতো বলেন যে, কোনো ঘটনা ঘটেছে কিনা শুনিনি, জানি না কিংবা কোনো অভিযোগ পাইনি। অথচ বিরোধী দল বা সাধারণ মানুষ যদি একই অপরাধ করে, তবে আইন তৎক্ষণাত প্রয়োগ হয়ে যায় এবং একেই বলে Left Hand of the Law. কোথাও কোথাও অপরাধ না করেও আইন দ্বারা হেনস্তা হতে হয়, যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সরকারপন্থী না হন।
আমাদের দেশের আইন Interpret (ব্যাখ্যা) করা হয় সাধারণত সরকার প্রধানের মুখের দিকে তাকিয়ে। কারণ সংবিধানের ৪৮(৩) ধারা মোতাবেক, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা (অপমান-অপদস্থ হয়ে) দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়ে বিমানবন্দরে যাওয়ার উদ্দেশে গাড়িতে ওঠার সময় বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আমার ওপর অভিমান করেছেন।’ তিনি কারো ওপর অভিমান করলে শেষ রক্ষা নাই, যেমনটি শেষ রক্ষা হয়নি সিনহার। কারো মান অভিমানের ওপর ভিত্তি করে যখন আইনের ব্যাখ্যা করা হয় তখনই চলে আসে Left Hand of the Law. অতএব আইন সর্বক্ষেত্রে জনস্বার্থে ব্যবহৃত হয় তা বাস্তবতা নয় বরং একপ্রকার মিথ্যার নামান্তর।
এ তো গেল আইনের বাম হাতের কথা। কিন্তু রাজনীতির যে ‘বাম হাত’ তা আরো জটিল। এ কারণেই জনগণের ভোগান্তির শেষ হচ্ছে না। পাওয়া যাচ্ছে না কথায় ও কাজের সমন্বয়। রাজনীতির একাল ও সেকাল একই ধারায় অতিবাহিত হচ্ছে না। কারণ, এর গুণগত তফাৎ অনেক। আগে নিজের সম্পদ বিলিয়ে রাজনৈতিক নেতারা রাজনীতি করতেন, কিন্তু বর্তমান রাজনীতি হচ্ছে শুধু সম্পদ নয়, অঢেল সম্পদের পাহাড় গড়ার প্রতিযোগিতা। অতীতে ‘নীতির’ ক্ষেত্রে অটুট থাকাই ছিল রাজনীতিবিদের জন্য মর্যাদাকর। এখন নীতির পরিবর্তনই রাজনীতিতে প্রমোশনের হাতিয়ার। এ হেন ‘ছ্যাবলামি’ দেখে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ টিপ্পনি কাটেন, অথচ ‘পল্টি’বাজেরা এতে নিজেকে খুবই মর্যাদাবান মনে করেন। অবস্থার পরিবর্তনের কারণে বুটের তলায় এখন রাজনীতিবিদদের ‘মর্যাদা’পূর্ণ অবস্থান মিলিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রটি দিনে দিনে ‘পুলিশি’ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ায় এটাও একটি কারণ।
অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়, চক্ষু লজ্জা উঠে গেছে। কারণ ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ অবস্থা এখন আর নেই। ‘যে যাই বলুক ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই’ নীতিতে চলছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। হাতের কাছে যা পেলাম সেটাই হজম করার যে নীতি অবলম্বন করা হচ্ছে তাতে লাভবান হচ্ছে দেশের রাজনীতিতে সুবিধাবাদী ও সুযোগসন্ধানী চক্র। বঞ্চিত হচ্ছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা, যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দল ও দলীয় মার্কাকে সারা বছর পাহারা দেন। অথচ সময়মতো ‘মার্কা’ বেহাত হয়ে যায় সুবিধাবাদীদের দৌরাত্ম্যে। এর সহযোগিতা করেন জাতীয় নেতৃত্ব, যদি মুখেও থাকে ভিন্ন কথা এবং এটাই এ দেশীয় রাজনীতির বর্তমান সংস্কৃতি।
রাজনীতির গুণগতমান পরিবর্তন হয়নি বিধায় অঙ্গনটি আবর্জনা পূর্ণ হয়ে পরিবেশ ভারসাম্যহীন করে তুলেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর একমাত্র টার্গেট ক্ষমতা দখল। সাংগঠনিকভাবে দলকে গড়ে তোলা অথবা নেতৃত্ব দেয়ার মতো আস্থাশীল সংগঠক তৈরি করার কোনো পরিকল্পনা বা পদক্ষেপ দলগুলোর নেই। ফলে নির্বাচনে অন্য দল থেকে প্রার্থী টেনে আনতে হয়; অন্যথায় মনোনয়ন বিক্রি করার একটি রাস্তা তো খোলা সব সময়ই থাকে, যাকে বলা হয় ‘পার্টি ফান্ড’ সংগ্রহ। কিন্তু দল বা কর্মীদের নিদানকালে এ পার্টি ফান্ড কোথায় থাকে- এর খবর আর কেউ দিতে পারেন না।
রাজনৈতিক দলগুলো যদি সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় গড়ে উঠত তবে কর্মীর মূল্যায়ন হতো এবং কর্মীরা নিজেকে দলের অংশীদার বলে মনে করতে পারত। কিন্তু বর্তমানে বাস্তবতার নিরিখে কর্মী ও কর্মচারীর মধ্যে দৃশ্যত তফাৎ নেই। জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বই কর্মীদের কর্মচারী বানিয়ে রেখেছেন। স্মর্তব্য, ব্রিটিশরা ভারত উপমহাদেশকে কলোনিতে পরিণত করেছিল, যার অন্যতম হাতিয়ার ছিল ‘ÔDIVIDE AND RULEÕ সুবিধাবাদী/সুবিধাসন্ধানীদের দ্বারা রাজনৈতিক অঙ্গন ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ায় ‘রাজনীতি’ নামক শক্তি পরগাছায় পরিণত হয়েছে। এদিকে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে আমলাগোষ্ঠী, যারা প্রকৃতপক্ষে জনগণের অর্থে লালিত রাষ্ট্রীয় কর্মচারী মাত্র, অথচ তাদের ভাবসাব এমন যে, তারাই দেশের নীতিনির্ধারক।
রাজনীতিতে রাজপথের নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন মান্দাতার আমলের দাবিতে পরিণত হয়েছে। অনেকে অভিমান করে বলে থাকেন, রাজপথে রক্ত দিয়েছি, কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব আমাদের মূল্যায়ন করেনি। এ দুঃখ থেকে হতাশায় অনেকে নিষ্ঠাবান কর্মীকে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। বাস্তবতার নিরিখে, নিষ্ঠাবান কর্মীরা কেন ভুলে যান, এক ব্যাগ রক্তের মূল্য ১৪৫ টাকা। টাকা যেখানে মূল্যায়নের মাপকাঠি, সেখানে ১৪৫ কোটি টাকার মালিকের কাছে ১৪৫ টাকার মূল্যের রক্ত কিভাবে পাল্লা দিয়ে রাজনীতিতে টিকে থাকবে? ১৪৫ কোটি টাকার মালিকেরা সারা বছর রাজনীতি করেন না, তারা রাজনীতির মাঠে নামেন সময় বুঝে এবং জয় ছিনিয়ে নেন। এটাই বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতি রাজনৈতিক অঙ্গনকে গ্রাস করে নিয়েছে বিধায় দেশ ও জাতি আজ রাজনীতিশূন্য। ফলে রাজনীতির বাম হাতের প্রভাব আজ প্রকৃত রাজনীতিবিদদের মাঠ ছাড়তে বাধ্য করেছে এবং দলছুট, ব্যাংক লুটেরা ও ভূমিদস্যুদের স্থান করে দিয়েছে। লুটেরাদের কোনো ধর্ম নেই। যেখানে সুযোগ পায় সেখানেই লুট করে, এখন কৌশলে লুট করাই দেশের রাজনীতি। রাজনীতিকে এখন রাজনীতি দিয়ে মোকাবেলার সংস্কৃতির অবসান হওয়ায় নীতি ও আদর্শের কোনো মূল্য নেই। মূল্যায়িত হচ্ছে টাকা আর টাকা। এ দৃশ্য দেখার জন্য রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে আমাদের দেশটি স্বাধীন করা হয়নি। হ
লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবী
(অ্যাপিলেট ডিভিশন)
taimuralamkhandaker@gmail.com

 

 


আরো সংবাদ



premium cement