শুদ্ধি অভিযান ও লুই কানের নকশা
- সৈয়দ নজরুল হুদা
- ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৯:৩২
প্রধানমন্ত্রী প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমাবেশে সততা সাধুতার সাথে কাজ করার পরামর্শ দিচ্ছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের মাধ্যমে এর পথযাত্রা শুরু করেছেন। তিনি ক্রমাগত হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করছেন জাতি তাকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েছে জনগণের মুখে হাসি ফুটানোর জন্য। তিনি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়েছেন। জনগণের করের টাকায় যে বেতন বেড়েছে তাদের স্বার্থে এখন কাজ করার উত্তম সময়। প্রধানমন্ত্রী গত ২৭ জানুয়ারি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পরিদর্শন করতে গিয়ে ডাক্তারসহ সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে চাকরি ছেড়ে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন (সূত্র : দৈনিক প্রথম আলো, ২৮ জানুয়ারি ১৯)। দেশে পুঞ্জীভূত অপরাধ ও অনাচার যে সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাতে যেন কোনো পরামর্শ, হুমকি বা ভীতি কাজে দিচ্ছে না। কেননা, অপরাধ যেন আমাদের সবাইকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। ধূমপায়ী বাবা যদি সন্তানকে ধূমপানে নিষেধ করেন, তাতে যেমন কাজে আসে না, তেমনি উচ্চতম মহল থেকে যতই নসিহত আসুক না কেন, তা কাজে আসছে না।
বিগত কয়েক মাস ধরে মাদকের বিরুদ্ধে সরকার যেভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে- তাতে শত শত ক্রসফায়ার এবং হাজারে হাজার গ্রেফতার সত্ত্বেও ইয়াবা চালান কিন্তু বন্ধ থাকেনি। মাদক ব্যবসায়ী ও সেবনকারীরা কৌশল পাল্টাচ্ছে মাত্র। ব্যাপারটা যে দাবানলের মতো সমাজকে গ্রাস করছিল- তা উপলব্ধির জন্য সরকারকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। কিন্তু সমস্যার মূলিভূত কারণে হাত দিতে হবে। শোধরানোর দায়িত্ব কিন্তু নিরপেক্ষভাবে উচ্চতম মহল থেকেই নিতে হবে। তা না হলে দাবানলের লেলিহান শিখা সমাজ দেশকে গ্রাস করবে, জাতি হিসেবে আমরা ব্যর্থ রাষ্ট্রে প্রতিপন্ন হবো।
দেশের সার্বিক পরিবর্তন সাধন করে নিরপেক্ষভাবে ও সততার সাথে দুদক, বিচারব্যবস্থাসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কর্মতৎপরতা, যেখানে সরকার বা রাষ্ট্রের কোনো অবৈধ হস্তক্ষেপ থাকবে না। কিন্তু হতাশার সুরে বলতে হয়- সে ব্যবস্থা আমরা করতে ব্যর্থ হয়েছি মোটামুটিভাবেই। যেখানে নিজস্ব ক্ষমতা ও স্বার্থ রক্ষার্থে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে হয়, সেখানে অনাচার জ্যামিতিক হারেই বাড়বে, এটা ধরেই নিতে হবে। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দানব তখন স্থান-কাল-পাত্র মানবে না- তার ক্রমাগত থাবায় ক্ষতবিক্ষত হবে সমাজ, এটাই স্বাভাবিক। মানুষের সুকোমলবৃত্তিগুলো নিভে যায় স্বাভাবিকভাবেই। স্বামীর হাতে থাপ্পড় খেয়ে স্ত্রী ৬ খণ্ড করে স্বামী হত্যা (দৈনিক নয়া দিগন্ত, ২৭ জানুয়ারি ১৯), সৈয়দপুর খামারের ঘরে দম্পতির গলাকাটা লাশ (দৈনিক প্রথম আলো, ২৮ জানুয়ারি ১৯) ইত্যাকার শিরোনামের খবরগুলো ভেঙে পড়া সমাজের ছিটেফোঁটা উদাহরণ। এখন সময় এসেছে স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সমাজ ও দেশ সংস্কারে হাত দেয়া।
সেটা অপরাধে ডুবে থাকা অপরাধীকে দিয়ে হবে না। দেশের আমূল পরিবর্তনের লক্ষ্যে সব সুশীল ব্যক্তিত্ব, ধর্মীয় নেতৃত্ব, রাজনৈতিক দলের হিংসার ঊর্ধ্বে উঠে হত্যা-নির্মূলের কুচিন্তা বিবর্জিত এ সমাজ গঠনে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা সমস্যা উপলব্ধি করলেও সমাধানের সঠিক পথে চলতে পারিনি। যার প্রভাবে ভালো তো হচ্ছেই না, বরঞ্চ খারাপের দিকে অধঃপতিত করছে নিরন্তর। কিছু দিন আগে অর্থাৎ গত ৩০ ডিসেম্বর সমাপ্ত হলো একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। জাতির সাড়ে দশ কোটি ভোটারের মধ্যে দেড় কোটি নতুন ভোটার ছিল। জাতি দেখতে পেল ভোটের আগের দিন অর্থাৎ ২৯ ডিসেম্বর রাতেই অবৈধভাবে ভোট কেটে ব্যালট বাক্স ভরে প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রে কিছু ছিটেফোঁটা ভোট নিয়ে ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২৮৫টি আসন জিতে নিলো।
নির্বাচন কমিশন নির্লজ্জের মতো সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ঘোষণা দিলো- আনন্দে তারা পিঠা উৎসবও করল। যে অশ্রুতিপূর্ব ভোট ডাকাতির ভোটের মহড়া আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ছত্রছায়ায় সংঘটিত হলো- ভোট দিতে না পেড়ে সেই দেড় কোটি নতুন যুব ভোটারের কাছে ক্ষমতাসীনেরা কী সততা সাধুতার মেসেজ পৌঁছে দিলেন, তাকি তারা একবারও ভেবে দেখেছেন? জাতির আশা আকাক্সক্ষা নিজেরাই দুমড়ে মুচড়ে নিঃশেষ করে দিচ্ছি। যদি বোধোদয়ের মাত্রা থেকে সরকারি কর্মকর্তাদের ‘শুদ্ধ’ হওয়ার আহ্বান জানানো হয়, তবে তা বিলক্ষণ শুভ আর যদি বাত কি বাত হয় তবে তা অরণ্যে রোদন হবে। জাতির জন্য কল্যাণকর হবে না।
জাতি নির্বাচন-পরবর্তী সময় থেকে থমথমে পরিবেশ লক্ষ্য করছে। স্তম্ভিত জাতি এ ফলাফলে প্রস্তুত ছিল না। একদল হারবে, একদল জিতবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রকোপে শক্তিশালী বিরোধী জোট ঐক্যফ্রন্টের এ রকম অধঃপতন স্বপ্নাতীত! অতি শিগগির নতুন এক নির্বাচনের মাধ্যমে সুষ্ঠু ভোটাধিকার প্রয়োগের বাতাবরণ সৃষ্টি না হলে যেকোনো অনাকাক্সিক্ষত অধঃপতন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন। সেটা কারো জন্যই শুভ হবে না। এ জন্য শুধু ‘চা পিঠা খাওয়ার দাওয়াত’ নয়- অ্যাজেন্ডাভিত্তিক নতুন নির্বাচনের রূপরেখা তৈরির জন্য আলোচনার দাওয়াত থাকতে হবে। এত কিছুর পরও কোনো আন্দোলন বা প্রতিবাদহীনতার প্রকোপ না দেখে উল্লাস করার কোনো কারণ নেই। কেননা, কবরের নিস্তব্ধতা কোনো শান্তি নয়। অবিলম্বে ক্ষমতাসীনদের তা ভেবে দেখতে হবে।
ঐতিহ্যবাহী একটি বর্ণাঢ্য দলের ধারকবাহক হয়ে জাতির এ ক্রান্তিকালে ক্যারিশমেটিক সিদ্ধান্ত সবাই আশা করে। আশা করি, ক্ষমতাসীনদের পোড় খাওয়া ঝানু নেতৃত্ব সে দিকগুলো পুনরায় বিবেচনায় নেবেন। তা না হলে এ অবক্ষয় রোধ করা যাবে না। বিষয়টি উদ্বেগের! পত্রিকান্তরে খবর এসেছে, জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী পেনসিলভানিয়া ইউনিভার্সিটির আর্কিটেকচারাল আর্কাইভ থেকে সংগৃহীত বিখ্যাত স্থপতি লুই আই কানের ডিজাইন করা জাতীয় সংসদ কমপ্লেক্স ও সংশ্লিষ্ট এলাকার মহাপরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত স্থাপত্য নকশা ‘স্থাপত্য অধিদফতর ও ন্যাশনাল আর্কাইভ’ কর্তৃপক্ষের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করেছেন। গত ২৮ জানুয়ারি বিষয়টি প্রায় সবক’টি মিডিয়ায় ছবিসহ গুরুত্বসহকারেই প্রকাশিত হয়েছে। একটি ভবনের স্থাপত্য নকশা হস্তান্তর খুব যে একটা গুরুত্ববহ তা কিন্তু ভাবার অবকাশ নেই।
কিন্তু মিডিয়ার অত্যধিক গুরুত্বারোপ এবং সংসদের কর্ণধার স্পিকারের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে হস্তান্তর অনুষ্ঠান সম্পন্নের কারণেই বিষয়টি সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বর্তমান সরকার দশম সংসদ নির্বাচনের পরেই বলেছিল, লুই আই কানের নকশাবহির্ভূত স্থাপনাগুলো স্থানান্তর বা ভেঙে ফেলা হবে। মূল নকশা না পাওয়ায় তৎকালীন সরকার আমেরিকার পেনসিলভানিয়া কর্তৃপক্ষের কাছে নকশার একটি পূর্ণাঙ্গ কপির আবেদন করেছিল বলে পত্রিকান্তরে খবর এসেছিল। মূল সংসদ ভবনের পাশেই স্বাধীনতার ঘোষক, মরহুম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজার অবস্থিত। নকশাবহির্ভূতভাবে নির্মিত বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবর স্থানান্তরের যেকোনো উদ্যোগ ‘স্পর্শকাতর’ বিবেচিত হবে, শান্ত সুস্থির পরিবেশে অশান্তির বাতাবরণ তৈরি করতে পারে। যেকোনো নকশা পরিমার্জন, পরিবর্তন হতেই পারে। সেটা কোনো আসমানী বিধান নয় যে, তা অপরিবর্তনীয়। বিষয়টি বিজ্ঞজনেরা উদ্বিগ্নতার সাথে দেখছেন। আশা করি ক্ষমতাসীনেরা ব্যাপারটি বিজ্ঞতার সাথে বিবেচনায় নেবেন এবং সর্বাবিধ বিতর্ক পরিহার করবেন।
২ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী গণভবনে পুনরায় ৭৫টি রাজনৈতিক দলের সাথে নির্বাচনোত্তর চা-চক্রের দাওয়াত দিয়েছিলেন। সম্মিলিত বাম জোট, বিএনপি, ইসলামী ঐক্যজোট, পরবর্তিতে ঐক্যফ্রন্ট শুধুই চা-চক্র প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মন্তব্য হচ্ছে! গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত মহাবিতর্কিত নির্বাচন ফলাফল বাতিল করে ও নির্বাচন কমিশন ঢেলে সাজানোর ‘সংলাপ’ হলে তারা যাবেন। অবশ্য ওবায়দুল কাদের ও এইচটি ইমামের কথার ভেতর ভিন্নতা ছিল। কিন্তু চিঠি পাওয়ার পর তা স্পষ্ট হয়ে গেছে, বিষয়টিই শুধু নির্বাচনোত্তর বিজয়ের উৎসব মাত্র।
অনুষ্ঠিত নির্বাচনের বহমান ক্ষত বুকে নিয়ে ও হাজার হাজার মামলার বোঝা মাথায় নিয়ে অহেতুক সংলাপ যে জাতীয় উৎকণ্ঠার কোনোই উপশম দেবে না, এটা গত ২৮ জানুয়ারি রাতে মিডিয়ায় পাঠানো ঐক্যফ্রন্টের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে প্রতিভাত হয়েছে। ক্ষমতাসীনেরা কি এভাবেই দেশ পরিচালনা করবেন, নাকি বিরোধীপক্ষের পাহাড়সম দুঃখজট নিরসনের কোনো উদ্যোগ নেবেন- সেটাই এখন দেখার বিষয়। মনে রাখতে হবে, প্রকৃত নির্বাচিত সরকারই কিন্তু প্রকৃত উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে। সততা ও সাধুতার মানসিক দৃঢ়তাই গগনচুম্বী হতে পারে- ধামাচাপা বা কারচুপির স্থান সেখানে নেই!
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা