২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মাদক দমনে ক্রসফায়ার : নাকি আড়ালে আবডালে অন্যকিছু?

মাদক দমনে ক্রসফায়ার : নাকি আড়ালে আবডালে অন্যকিছু? - ছবি : সংগৃহীত

ঘটনাটা আচমকা ঘটে গেল গত ২১ মে, ২০১৮ বেলা ১টার সময়। রাজশাহীর একটি আদালতের এজলাসে। একটি মাদকের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের নিয়োজিত আইনজীবী হিসেবে দুইজন সাক্ষীর জেরা শেষে আসামির জামিন প্রার্থনা করলে। বিজ্ঞ আদালত বলেই ফেললেন, জামিন না দেয়াটাই উত্তম। দেখছেন না কী চলছে। আমি তাৎক্ষণিক ক্রসফায়ারকে মানবতাবিরোধী অপরাধ বলে অ্যাখ্যায়িত করি। আমার এই মন্তব্যে সরকারি আইন কর্মকর্তা তেড়ে উঠলেন। আজকাল আমাদের কোর্টগুলোতে সরকারি আইন কর্মকর্তারা প্রায়শ এই রকম করে থাকেন। বিতর্ক এড়ানোর জন্য বলিনি, এখানকার একজন সংসদ সদস্যকে মাদকদ্রব্যের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রিপোর্ট অনুযায়ী) একটি পত্রিকায় রিপোর্ট করলে, সংসদ সদস্য মানহানীর মামলা ঠুকে দেন। ওই সংসদ সদস্যের পৃষ্ঠপোষকতায় ওই এলাকায় মাদকের বিস্তার ঘটেছে। সেই এলাকার লোকজন এখনো প্রকাশ্যে বলাবলি করেন। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মন্তব্য হলো, সেই সময় বর্তমান সরকার মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করলে আজকের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। আসলে করার ইচ্ছাও ছিল না। আজকে মাদক কারবার নির্মুলের জন্য সরকার যে দানবীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন তা আমাদের ভয়ঙ্করভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। সরকার সত্যিকারভাবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে এই পদক্ষেপ নিয়েছেন কি না, সেটা পর্যালোচনার দাবি রাখে। অবশ্য ক্রসফায়ারের ঘটনা আমাদের দেশে নতুন কোনো ঘটনা নয়। আজকের ক্রসফায়ারে মাদক কারবারির নিহত হওয়ার আগে অনেক ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছে। মানবাধিকার কর্মীরা প্রতিবাদ করলেও সরকার কোনো সময় আমলে নেয়নি। যদিও বর্তমান সরকার ক্ষমতায় যাওয়ার আগের সময়ের বিরোধী দলের নেতা আজকেরও প্রধানমন্ত্রী জাতিকে বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ক্ষমতায় গেলে র‌্যাবকে ভেঙে দেবেন, এমনকি ক্রসফায়ারও বন্ধ করবেন।

কিন্তু বর্তমান সরকারের আচরণ দেখে প্রতীয়মান হচ্ছে র‌্যাবকে আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরেছেন। র‌্যাবকে বেআইনি হত্যাযজ্ঞে ব্যবহার করছেন। র‌্যাবের বর্তমান মহাপরিচালক ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। আওয়ামী লীগের রাজনীতির আদর্শ বাস্তবায়নে যে তিনি মনে-প্রাণে চেষ্টা করবেন সেটাই স্বাভাবিক। মাদক কারবার প্রসার ঘটছে এটা যেমন বাস্তব সত্য, তার চেয়ে সত্য হলো পুলিশের নির্লজ্জ সহায়তা। একজন আইনজীবী হিসেবে মাদক মামলার আসামিদের কাছে পুলিশের অর্থলোলুপতার যে কাহিনী শুনি তাতে লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যায়। কিন্তু আজকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেই সত্য গোপন করে কেবলমাত্র চুনোপুটিদের প্রাণ সংহার করে চলেছেন। যদিও আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বারবার বলেছেন, তালিকা ধরে এই অভিযান করছে র‌্যাব ও পুলিশ। ইতোমধ্যে বিএনপি অভিযোগ করেছে তাদের দুইজন নিরীহ কর্মীকে মাদক কারবারির আবরণ দিয়ে ক্রসফায়ারে প্রাণ সংহার করেছে। আর এখানেই শুরু হয়েছে আমাদের আসল উদ্বেগ।

অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের ধারণা, এর উদ্দেশ্য হলো বিরোধী দলের কর্মীদের মনে ভীতির সঞ্চার করা। মাদক কারবারিদের কবল থেকে উদ্ধার করা হয়তো সরকারের আসল উদ্দেশ্য নয়। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, চট্টগ্রামের কক্সবাজারের সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদিকে মাদক সম্রাট বলা হলেও সরকার এখন পর্যন্ত রহস্যজনক কারণে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। কেন নেয়া হয়নি, তারও একটা অপূর্ব ব্যাখ্যা দিয়েছেন আমাদের মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেছেন, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে বটে, কিন্তু যথেষ্ট প্রমাণ নেই। অতএব তিনি আপাতত গ্রেফতার হচ্ছে না। অথচ কেবলমাত্র সরকারি প্রেস রিলিজের বানানো অভিযোগের ওপর চড়াও হয়ে এ যাবৎ ১০০-এর বেশি লোকের প্রাণসংহার করেছে র‌্যাব-পুলিশ। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, বদিকে গ্রেফতার করতে সরকারের বাধা কোথায়? ওবায়দুল কাদের অবশ্য একহাত বাড়িয়ে বলছেন, অসংখ্য প্রমাণ থাকতে হয়। সরকারকে মাদক নির্মুলে যে দানবীয় পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়েছে, স্বভাবত প্রশ্ন উঠেছে-, আমাদের প্রচলিত বিচারব্যবস্থা এই ভয়ঙ্কর মাদক কারবার প্রসার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য উপযোগী কি না? অবশ্যই সহায়ক নয়। কারণ, প্রধানত আমাদের ১৯৯০ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের বাস্তবায়ন করতে গিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কাজেকর্মে নানা ধরনের গাফলতি দেখা যায়। বিশেষ করে আটক হেরোইন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে।

এমনো দেখা যায় যে, একই ধরনের হেরোইনের দুই ধরনের রিপোর্ট পাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা শোনা যায়নি। বড় বড় মাদকের মামলায় আসামিদের জামিনের ক্ষেত্রে সরকারি আইন কর্মকর্তার নীরব বিরোধিতা চোখে পড়ার মতো। এমনকি বিচারকদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগও আদালত পাড়ায় চাওর হয়ে যায়। বেশ কিছু দিন আগে রাজশাহীর একটি মাদক মামলায় আসামি ৫৪০ গ্রাম হেরোইনসহ ধরা পড়েছিল। সেই আসামিকে হাইকোর্ট বিভাগ তাড়াতাড়ি জামিন দিলে পরে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক নিজ উদ্যোগে মূল নথি যেমন এজাহার ও চার্জশিট পাঠালে দেখা যায় নকলে (যাকে জাবেদা নকল বলা হয়।) ৪৫ গ্রাম উল্লেখ থাকায় হাইকোর্ট বিভাগ আসামিকে জামিন দেন। পরে এটা জানাজানি হয়ে গেলে রাজশাহীর আদালত পাড়ায় আলোড়ন তোলে। শেষ খবরে জানা গেছে তদন্ত চলছে, তবে কবে শেষ হবে বলা দুষ্কর। অনেক সিনিয়র আইনজীবীর সাথে আলাপ করে জানতে পেরেছি, মামলার সংশ্লিষ্ট আইনজীবীও দায়ী। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আসল রহস্য উদঘাটিত হবে। আশা করা যায়, কয়েকদিন পরে রাজশাহীর অন্যান্য আইনজীবীর মতো আমিও এই চাঞ্চল্যকর মামলাটির ঘটনা ভুলে যাবো। লক্ষণীয় বিষয়, এই মাদকবিরোধী অভিযানে সরকার পুলিশ ও র‌্যাবকে সবখানে গুরুত্ব দিচ্ছেন, সীমান্ত রক্ষী বাহিনীকে সেই হিসেবে কাজে লাগানো হয়নি। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরকে ডাকা হয় না। যদিও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর বরাবরই অভিযোগ করে আসছে তাদের লোক জনবলের অত্যন্ত অভাব।

এই হতাশাবোধক অভিযোগ বহুপুরনো। সত্যি হয়ে থাকলে লোকবল বাড়ানোর জোরালো দাবি সরকারের কাছে তারা করেছে বলে মনে পড়ছে না। আজকাল প্রায়ই মাদক কেন্দ্রিক মামলাগুলো দায়ের করছেন পুলিশ ও র‌্যাব। তাদের হাতে খুব বেশি ক্ষমতা আছে বলে মনে হয় না। যদিও ইতোমধ্যে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর মাদক নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে আরো বেশি তৎপর হওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। এখন প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগ সরকার কেন হঠাৎ করে মাদক কারবারিদের হত্যার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা অবশ্য সরকারের এই সিদ্ধান্তে মোটেও অবাক হননি। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম কৃতিত্ব হলো একটার পর একটা ইস্যু তৈরি করে তার আগের অন্যায়কে ঢেকে রাখতে পারে। খুলনার মেয়র নির্বাচনের পর জনগণের দৃষ্টি অন্যত্র ফিরিয়ে নেয়ার জন্য এই দানবীয় সিদ্ধান্ত নেয়াটা জরুরি হয়ে পড়েছিল। কারণ, বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের ভয় দেখানোর কাজটা অভিযানের আড়ালে আবডালে চালিয়ে যাবে। সরকারের বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে মাদকের সমস্যা বেশ কয়েক মাস আগে তৈরি হয়েছিল। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার প্রায় নয় বছর ধরে ক্ষমতায় আছে। সরকারি দলের পৃষ্ঠপোষকতায় মাদক কারবারিরা ক্রমাগত কারবার চালিয়ে গেছেন। গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। আর এই মাদক কারবারিদের মাসোয়ারার টাকা রাজনীতিবিদ ও পুলিশ বাহিনীর পকেটে চলে গেছে।

তাদের এই কার্যকলাপের খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হলেও আওয়ামী লীগ সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। যদিও ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা এই দানবীয় পদক্ষেপের বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়েছে। সরকারি নেতা ও মন্ত্রীদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে মনে হচ্ছে এই সমস্ত মানবাধিকার গোষ্ঠীর মতামত গ্রহণ করার মতো কিছু নেই। তাদের ইচ্ছামতো এই ভয়ঙ্কর অভিযান চালিয়ে যাবে। ঠিক যেভাবে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট মহোদয় ক্রমাগত মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চালিয়ে গেছেন হত্যার উৎসব। কোনোভাবেই তোয়াক্কা করেননি আন্তর্জাতিক চাপকে। সরকার যদি এই ভয়াবহ পদক্ষেপ গ্রহণ করে তাহলে তার আগে দেশের প্রচলিত আইন আদালতকে বন্ধ ঘোষণা করলে সমালোচনার কিছু থাকে না। সরকার আইনের শাসনও চাইবেন আবার আইনবিরোধী তৎপরতা অব্যাহত রাখবেন তা হয় না। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুল মেসেজ এরই মধ্যে বিদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। যা আমাদের বিনিয়োগ বাণিজ্যের জন্য ক্ষতিকর বটে।
লেখক : আইনজীবী, রাজশাহী


আরো সংবাদ



premium cement