২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

টেকসই পুঁজিবাজার ও বন্ড মার্কেট উন্নয়ন

-

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাংলাদেশের পুঁজিবাজার ইক্যুইটি বা পুঁজির ওপর ভর করেই চলছে। কারসাজি, সিন্ডিকেটেশন, ইনসাইডার ট্রেডিং, যোগসাজশের মাধ্যমে শেয়ারদর বৃদ্ধি বা কমানোর প্রক্রিয়া এখনো বন্ধ করা যায়নি। গুজবনির্ভরতা কাটেনি। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের অনেকেরই আয়ের একমাত্র উৎস শেয়ার হাতবদলের মুনাফা। এজন্য প্রতিদিনই মুনাফা চায়। স্বভাবজাত এই প্রবৃত্তির কারণে জেনে না জেনেও অনেকে অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছেন।
কিন্তু বিকল্প ও নিশ্চিত আয়ের ব্যবস্থা থাকলে এই পথে পা বাড়ানো কমবে বলেই বিশ্বাস করা যায়। শেয়ারদর কমলেই পুঁজির ক্ষয় হয়। এতে বাজারের আচরণও বোঝা যায় না। একপর্যায়ে পুঁজি হারিয়ে দোষারোপ করা হয় বাজারের প্রতি। ফলে বিনিয়োগকারীদের আস্থায় আনার বিষয়টি নিয়মিতই আলোচনায় আসছে পুঁজিবাজারে।
উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের পুঁজিবাজারে বন্ড মার্কেট সফলতা দেখাচ্ছে। প্রতিবেশি দেশ ভারত, চীন, অস্ট্রেলিয়া, হংকংসহ অনেক দেশ বন্ড মার্কেটের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের বন্ড মার্কেট এখনো গড়ে ওঠেনি সেভাবে। ফলে স্বল্পমেয়াদি আমানত নিয়েই ব্যাংকগুলো দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে যাচ্ছে। ব্যাংকগুলো আমানত সঙ্কটে পড়লেই শেয়ারদর কমে যাচ্ছে। মৌলভিত্তির কোম্পানির শেয়ারদর কমলে প্রভাব পড়ছে অন্যদের ওপরও। এতে বিনিয়োগ হারাচ্ছেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা।
বন্ড ছেড়ে কয়েকটি কোম্পানি অর্থ সংগ্রহ করলেও বিনিয়োগকারীরা এখনো এ বিষয়ে জ্ঞাত নন। সরকারি বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে বন্ড ছেড়ে অর্থ সংগ্রহের বিষয়টি আলোচিত হলেও তা জোরালো হচ্ছে না। সরকারি কর্মকর্তাদের উদাসীনতাকেও দায়ী করছেন অনেকে। মেগা প্রকল্পগুলো বন্ডের অর্থে নির্মিত হলে সরকারের ব্যাংক ঋণ কমে যাবে। জাতীয় সঞ্চয়পত্র খাতেও উচ্চ সুদ ব্যয়ের প্রয়োজন হবে না।
এতে ব্যাংকগুলোও আমানত সঙ্কটে ভুগবে না। বছর শেষে নিশ্চিত মুনাফার আশায় বিনিয়োগকারীও স্বল্পমেয়াদি মুনাফার দিকে ছুটবে না। নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে বন্ডকেই বেছে নেবে। এতে পুঁজিবাজারে শেয়ার কারসাজি চক্রের দৌরাত্ম্য কমবে।
বাংলাদেশে বন্ড মার্কেটের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলেও সমন্বিত উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। অথচ বিষয়টি এখন অত্যন্ত জরুরি। কারণ বন্ড মার্কেটের মাধ্যমে বিনিয়োগকারী এবং কর্তৃপক্ষ উভয়ই লাভবান হবে। জিরো কুপন বন্ড, ফিক্সড কুপন বন্ডের মতো পণ্য আনা যেতে পারে সহজেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বন্ড মার্কেট উন্নয়নের বিষয়টি স্বীকার করে আসছেন নিয়মিত।
বন্ড মার্কেট উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন। সিআইবির নীতিমালাও সংশোধন করতে হবে। আর এটি বাস্তবায়নে প্রয়োজন সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সিদ্ধান্ত। কারণ বাংলাদেশের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা তাকিয়ে থাকেন সরকারি সিদ্ধান্তের দিকে। আগে এটি কম হলেও এখন নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই সরকারের পরিচালনায় থাকা কর্তাব্যক্তিদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে বন্ড মার্কেট উন্নয়নের।
এজন্য একটি শক্তিশালী টাক্সফোর্স গঠন করতে পারে সরকার। জাতীয় সঞ্চয়স্কিম, ট্রেজারি বন্ড, করপোরেট বন্ডসহ সব ধরনের বন্ড একই বন্ডের আওতায় আনা যেতে পারে। তাহলে বন্ডসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কোনো ধোঁয়াশা তৈরি হবে না। এজন্য একক কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা নতুন কোনো সংস্থার অধীনেও দেয়া যেতে পারে। তারাই বন্ড মার্কেট নিয়ে গবেষণা, তদারকি, উদ্ভাবন ও নিয়ন্ত্রণ করবে।
পাশাপাশি ইসলামী ধারার আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য করা যেতে পারে শরিয়াহভিত্তিক বন্ড। ২০০৮ সাল থেকেই ইসলামী ধারার সুকুক বন্ড তৈরির বিষয়টি আলোচিত হয়ে আসছে। সুকুক জনপ্রিয়তা পেলে ইসলামী ধারার আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোরও মূলধন নিয়ে ভাবতে হবে না। ব্যাংকগুলো এখন ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়ন করার প্রক্রিয়াতে রয়েছে। এজন্য মূলধন প্রয়োজন আগের চেয়েও অনেক বেশি। বন্ড মার্কেট চালু হলে তাদের ঋণ দেয়া সক্ষমতাও বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের আর্থিক অবস্থার শক্ত ভিত গড়তে পারবে।
নির্বাচনের পর থেকেই পুঁজিবাজার ইতিবাচক প্রবণতায় চলছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে দেশের বেসরকারি বিনিয়োগে কাক্সিক্ষত গতি আসেনি। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধিতে জোর দেয়া হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যাংক খাতই সরবরাহের একমাত্র উৎস। ব্যাংকে অতিরিক্ত তারল্য থাকলেও নতুন বিনিয়োগের চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। অপর দিকে, ব্যাংকগুলোতে আমানতপ্রবাহ কমে যাচ্ছে।
ব্যাংকের আর্থিক ভিত মজবুত ও পুঁজিবাজারে অর্থের সরবরাহ বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারে বন্ড মার্কেট। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা রক্ষায় প্রয়োজন আর্থিক খাতের সুষম উন্নয়ন। এজন্য অর্থ সংগ্রহের উপযুক্ত মাধ্যমে পরিণত হতে পারে বন্ড মার্কেট। বাংলাদেশের অর্থনীতির টেকসই উন্নয়নে এখনই প্রয়োজন বন্ড মার্কেটের উন্নয়ন। সময়ের চাহিদা পূরণে সরকার এগিয়ে আসবে বলেই আমরা বিশ্বাস করতে চাই।


আরো সংবাদ



premium cement