২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দুশ্চিন্তায় সঞ্চয়পত্রনির্ভর পরিবারগুলো

-

বিশ লাখ টাকার পারিবারিক সঞ্চয়পত্র কিনেছেন রাজধানীর বাসিন্দা শেখ নূরুদ্দিন। মাস শেষে ১৮ হাজার টাকা মুনাফা পান। মাসের নির্ধারিত তারিখে পোস্ট অফিস থেকে সংগ্রহ করেন লাভের টাকা। পরিবারের জরুরি খরচগুলো সারা হয় এ টাকা দিয়ে। কিন্তু গত কয়েক দিন ধরে এ পরিবারে দুশ্চিন্তা বেড়েছে। নানা মাধ্যমে তারা জানতে পারছেন, সরকার সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার কমাতে যাচ্ছে। এ সংবাদে দুশ্চিন্তা বেড়েছে সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরশীল লাখ লাখ পরিবারের। তাদের প্রশ্ন, দেশে নিরাপদ বিনিয়োগের কোনো পরিবেশ নেই। ব্যাংকে টাকা রেখেও নিরাপদ বোধ করছেন না অনেকে। এ অবস্থায় সরকার যদি সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার কমিয়ে দেয় তবে সংসার চলবে কিভাবে?
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে একক নামে সর্বোচ্চ ৩০ লাখ টাকা এবং যৌথ নামে ৬০ লাখ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র ক্রয় করা যায়। বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা ১৯ হাজার কোটি টাকা ধরা হলেও সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে তিনগুণেরও বেশি। গত অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয় ৫২ হাজার ৪১৭ কোটি টাকার। সরকার গত বছর সুদ পরিশোধ বাবদ খরচ করেছে ৩৪ হাজার কোটি টাকা। এর বেশির ভাগই ব্যয় করতে হয়েছে সঞ্চয়পত্রের সুদ বাবদ। এ খাত থেকে ধার বাড়াতে এবার লক্ষ্যমাত্র নির্ধারণ করা হয় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। তবে যেভাবে বিক্রির চাপ বাড়ছে তাতে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রাও ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সঞ্চয়পত্র বিক্রি বৃদ্ধির মূলে রয়েছে বাড়তি মুনাফা। বর্তমানে পরিবার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ। পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ, পেনশনার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ২০১৫ সালের ২৩ মে’র পর থেকে এ হার কার্যকর আছে। এর আগে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ছিল ১৩ শতাংশেরও বেশি।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ব্যাংকগুলোর চাপের মুখে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমানোর উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সরকার। কারণ এর আগে সরকারের চাপের মুখে ব্যাংকের ঋণ ও আমানতের সুদহার ৯ ও ৬ শতাংশ করার ঘোষণা দিয়েছেন ব্যাংকের উদ্যোক্তারা। ব্যাংকমালিকদের ঘোষণা কার্যকর করার পূর্বশর্ত হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কত কমবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে আগামী বুধবার। ওই দিন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে বৈঠক করে সঞ্চয়পত্রের সুদহার নির্ধারণ করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। আর পরদিন ৯ আগস্ট থেকে ব্যাংকের নয়-ছয় সুদহার কার্যকর করা হবে।
গত সপ্তাহে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কার্যালয়ে অংশীজনদের সঙ্গে এক বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের বলেন, সঞ্চয়পত্রের সুদহার আমরা পর্যালোচনা করব। সঞ্চয়পত্রের সুদহার মাঝে মধ্যে পর্যালোচনা করি। কোনো সময় দুই বছর, তিন বছর, আবার বছরেও হতে পারে। বাজারের সুদহারের সঙ্গে সামঞ্জস্য না হলেই পর্যালোচনা করা হয়। এ নিয়ে আমরা ৮ আগস্ট সিদ্ধান্ত নেব। ৯ আগস্ট থেকে নতুন সুদহার কার্যকর করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমরা এটা করেছি। ৯ আগস্টের পর কেউ না মানলে আপনারা রিপোর্ট করতে পারেন।
অর্থমন্ত্রী বলেন, দেশে কোনো তারল্য সঙ্কট নেই। সরকারি প্রতিষ্ঠানের ৫০ শতাংশ আমানত বেসরকারি ব্যাংকে জমা রাখার বিধান করার ফলে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর অনেক সুবিধা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, আমানতের সুদহার ৬ শতাংশের বেশি হবে না। ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ করতেই হবে। সেখানে কিছু ব্যাংকের আপত্তি আছে, বিশেষ করে ভোক্তা ঋণ ও ক্রেডিট কার্ডের ক্ষেত্রে। অর্থমন্ত্রী বলেন, কিছু ব্যাংক ইতোমধ্যে নতুন সুদহার কার্যকর করেছে। ৯ আগস্ট থেকে সবাই করবে। আজকের সভায় সব সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের এমডি-চেয়ারম্যান ছিলেন। সবাই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সরকার সহযোগিতা দিয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের ৫০ শতাংশ আমানত বেসরকারি ব্যাংক পাচ্ছে। ইতোমধ্যে ৩০ শতাংশ পেয়ে গেছে।
ব্যাংক ঋণের সুদহার কমানোর আশ্বাস দিয়ে সরকার থেকে বিভিন্ন সুবিধা নিলেও সুদহার কমায়নি বেশির ভাগ ব্যাংক। গত ১ জুলাই থেকে কয়েকটি ব্যাংক এক অঙ্কের সুদহার কার্যকরের ঘোষণা দিলেও বাস্তবে তা হয়নি। সুদহার কমানোর ঘোষণায় সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান বেসরকারি ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নিচ্ছে। ফলে পুরো আর্থিক খাতে একধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় এখন এসে বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকরা বলছেন, ৬ শতাংশ সুদে সরকারি ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠান থেকে আমানত পাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে হবে। আমানতের সুদহারের সঙ্গে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার সমন্বয় করতে হবে। কারণ, বেশি সুদের আশায় ব্যাংকের আমানত ভেঙে অনেকে সঞ্চয়পত্র কিনছে, ফলে টান পড়ছে আমানতে।
বিভিন্নপর্যায়ের বিনিয়োগকারীর সাথে কথা বলে জানা যায়, গত কয়েক বছর ধরে একমাত্র সঞ্চয়পত্র ছাড়া অন্য ক্ষেত্রগুলো থেকে আশানুরূপ মুনাফা পাওয়া যাচ্ছে না। দীর্ঘ দিন ধরেই পুঁজিবাজারে মন্দাভাব। ব্যাংকগুলোর সুদহারও আকর্ষণীয় নয়। ফলে সাধারণ মানুষের বিনিয়োগের অন্যতম ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে সঞ্চয়পত্র। মাত্রাতিরিক্ত সঞ্চয়পত্র বিক্রি হওয়ায় সুদ পরিশোধে চাপ বাড়ছে সরকারের ওপর। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মুনাফা কমাতে কয়েক দফা উদ্যোগ নেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। কিন্তু নানা মহলের চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত তা থেকে সরে আসেন তিনি।
এ দিকে, নির্বাচনের বছরে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমানোর ক্ষেত্রে সরকারের ভেতরেও বিরোধিতা রয়েছে। তাদের দাবি, এ মুহূর্তে সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমালে সঞ্চয়কারীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এমন ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না। মুনাফার হার না কমিয়ে বরং সঞ্চয়কারীদের সুবিধার্থে সঞ্চয়পত্র বেচাকেনার প্রক্রিয়া সহজ ও আধুনিকায়ন করার ওপর জোর দেয় বিরোধী পক্ষটি। তাদের আগ্রহের কারণে সারা দেশের সঞ্চয়পত্রের অফিসগুলোকে অটোমেশনের আওতায় আনা হচ্ছে বলে জানা গেছে। ফলে গ্রাহককে সঞ্চয়পত্র ক্রয়, নগদায়ন কিংবা মুনাফা তোলার জন্য সরাসরি সংশ্লিষ্ট অফিসে যেতে হবে না। ঘরে বসেই অনলাইনে এ সংক্রান্ত সব সেবা পাবেন তারা।
বর্তমানে পোস্ট অফিস, সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংকের শাখা ও ব্যুরো অফিসের মাধ্যমে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করা হয়। সারা দেশে পোস্ট অফিস আছে সাড়ে আট হাজার। সঞ্চয় ব্যুরো অফিস ৭৩টি। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের শাখাসহ এসব অফিসকে অটোমেশনের আওতায় আনা হবে। সংস্কারের উদ্দেশ্য হচ্ছে পুরো সঞ্চয়পত্র ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করা। ফলে দুর্নীতি কমবে এবং গ্রাহকরা উপকৃত হবেন। সঞ্চয়পত্রের অপব্যবহার রোধে সংস্কার অপরিহার্য হয়ে পড়েছে জানিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর ফলে ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারী ও পেনশনভোগীরা উপকৃত হবেন।


আরো সংবাদ



premium cement