২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বিরান হওয়ার আশঙ্কায় অনেক দেশ

বিরান হওয়ার আশঙ্কায় অনেক দেশ - ছবি : সংগৃহীত

বিশ্বে গত ১২ বছরে মানুষ বেড়েছে ১০০ কোটি । আগামী ১৩ বছরে যোগ হবে আরো ১০০ কোটির বেশি। জাতিসঙ্ঘের ২০১৭ সালের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে বিশ্বে মানুষের সংখ্যা ৭৬০ কোটি। এ যখন বিশ্বে জনসংখ্যা বৃদ্ধির চিত্র তখন এ শতাব্দী শেষেই বিশ্বের অনেক জনবহুল অঞ্চল মানুষের অভাবে বিরানভূমিতে পরিণত হতে যাচ্ছে। এর কারণ অনেক দেশে দ্রুত কমছে জনসংখ্যা। এর কারণ অনেক দেশে প্রতি দুইজন মানুষের মৃত্যুর বিপরীতে জন্ম নিচ্ছে একটি শিশু। ক্রমাগতভাবে জনসংখ্যা কমছে এমন দেশের সংখ্যা ৫১টি হওয়ার কথা বলা হয়েছে জাতিসঙ্ঘের ২০১৭ সালের প্রতিবেদনে । এর মধ্যে অনেক দেশে গত ৫০ থেকে ৬০ বছর ধরে জনসংখ্যা বাড়েনি; বরং কমেছে।

২০৫০ সালের মধ্যেই অনেক দেশের জনসংখ্যা বর্তমানের চেয়ে তিন ভাগের এক ভাগ কমে যাবে মর্মে দেখানো হয়েছে জাতিসঙ্ঘসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে। জনসংখ্যার অব্যাহত এ হ্রাসকে অনেকে ‘ডেমোগ্রাফিক টাইম বোম্ব’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। যদি জন্ম হার বাড়াতে সক্ষম না হয় এবং বিদেশীদেরও গ্রহণ না করা হয় তাহলে এক সময় মানুষের অভাবে কোনো কোনো দেশ বিরানভূমিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে। বিলুপ্ত হতে পারে অনেক সভ্যতা এবং তা এ শতাব্দীর শেষেই। 

গত কয়েক দশক ধরে জন্মহার না বাড়ার কারণে ইতোমধ্যে বুলগেরিয়া, স্পেন, জাপান এবং ইউরোপের প্রায় সব দেশের অনেক গ্রাম উজাড় হয়ে গেছে। বুলগেরিয়া, স্পেন ও জাপানের অনেক গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাটবাজার, যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে মানুষ না থাকায় । অনেক বাড়িঘর পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। বিবিসি, রয়টার্স, গার্ড়িয়ানসহ অনেক বিশ্বখ্যাত গণমাধ্যম ছাড়াও সংশ্লিষ্ট দেশের গণমাধ্যমে এ বিষয়ে সরেজমিন প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। বুলগেরিয়ার কোনো কোনো পাড়া ও গ্রামে মাত্র এক থেকে ৩০ জন মানুষের সন্ধান পাওয়া গেছে, যেখানে একসময় ছিল মানুষের কোলাহলে মুখর। 

দেশটিতে প্রতি হাজারে মারা যায় ১৬ জন আর জন্ম নেয় ৯ জন। এ তথ্য গত বছর ৩১ ডিসেম্বরের। পর্তুগালে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মারা গেছে ৫২ হাজার ৩৬৩ জন আর জন্ম নিয়েছে ৩৪ হাজার ৪৮৩ জন। ইতালিতে গত জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত মারা গেছে এক লাখ ৮৫ হাজার মানুষ। আর একই সময়ে জন্ম নিয়েছে এক লাখ আট হাজার শিশু। 

জাতিসঙ্ঘের ২০১৭ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বিশ্বে একজন নারীর গড়ে ৪ দশমিক ৫ জন সন্তান ছিল। ২০১৫ সালে তা ২ দশমিক ৫-এ নেমে এসেছে। 
জাতিসঙ্ঘসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জনসংখ্যা স্থিতিশীল রাখার জন্য একজন নারীর গড়ে ২ দশমিক ১ জন করে সন্তান থাকা প্রয়োজন। সেখানে গোটা ইউরোপে এ হার গড়ে মাত্র ১ দশমিক ৫৫। জাপান, দণি কোরিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো আরো অনেক জনবহুল দেশেও এ হার একই। বিশ্বে দ্রুত জনসংখ্যা কমছে এমন শীর্ষ দশটি দেশের তালিকা করা হয়েছে জাতিসঙ্ঘসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে । এর সব দেশই পূর্ব ইউরোপের। এসব দেশে একজন নারীর গড়ে সন্তান রয়েছে ১ দশমিক ৩ জন। স্পেনে এ হার ১ দশমিক ২। 
জার্মানির মতো অনেক দেশে গত ৫০ থেকে ৬০ বছর ধরে অব্যাহতভাবে স্থানীয় জনসংখ্যা কমলেও শুধু অভিবাসন নীতি বা বিদেশীদের গ্রহণের মাধ্যমে জনসংখ্যার স্থিতিশীলতা ধরে রাখা হয়েছে। কোনো কোনো বছর সে দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে। গোটা ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অনেক চেষ্টা এবং পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমেও নারীদের প্রয়োজনীয়সংখ্যক সন্তান জন্মদানের বিষয়ে উৎসাহিত করতে পারছে না। এক দিকে বুলগেরিয়াসহ অনেক দেশ নিজ দেশে জন্মহার বাড়াতে ব্যর্থ হচ্ছে, অপর দিকে বিদেশীদের আশ্রয় দেয়ার বিষয়েও কঠোরতা আরোপ করে রেখেছে । ফলে দ্রুত কমছে বুলগেরিয়ার মতো প্রবাসীদের গ্রহণের ক্ষেত্রে কঠোর নীতিগ্রহণকারী দেশের জনসংখ্যা। 

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও হ্রাসের যে চিত্র তাতে দেখা যায়, এক দিকে বর্তমান বিশ্বে কিছু দেশ হিমশিম খাচ্ছে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে। আরেক দিকে অনেক দেশ জোর চেষ্টা চালাচ্ছে জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য। কিন্তু অনেক দেশে জন্মহার বৃদ্ধির প্রায় সব চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে। দীর্ঘকাল ধরে বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছে। আর এখন বিশ্বের অর্ধশতাধিক দেশের সরকার মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য। কারণ এসব দেশে অব্যাহত জনসংখ্যা হ্রাস ভয়াবহ রকমের একটি আতঙ্ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। মানুষের অভাবে শিল্পের চাকা থেমে যাওয়া, অর্থনীতিতে ধস নামা, শিল্প, সেবাখাতসহ অনেক কিছু বিদেশীদের হাতে চলে যাওয়া, দেশের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক দৃশ্যপট বদলে যাওয়াসহ আরো অনেক সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে চিন্তিত তারা। 

জাতিসঙ্ঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ সাল থেকে ২০৫০ সাল পর্যন্ত যেসব দেশের জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি হ্রাস পাবে সেগুলো হলো বুলগেরিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, পোল্যান্ড, মলডোভা, রোমানিয়া, সার্বিয়া, ইউক্রেন, হাঙ্গেরি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিন দ্বীপগুলো। 

দ্রুত জনসংখ্যা কমছে জাতিসঙ্ঘের এমন দেশের তালিকায় ১১তম স্থানে রয়েছে এশিয়ার জাপান। এরপরের দেশগুলো হলো জর্জিয়া, পর্তুগাল, বসনিয়া হার্জেগোভিনা, এস্টোনিয়া, লেবানন, গ্রিস, দণি কোরিয়া, আলবেনিয়া এবং বেলারুস। 
জনবহুল যেসব দেশে সবচেয়ে নিম্ন জন্মহার সেগুলো হলো চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, রাশিয়া ফেডারেশন, জাপান এবং ভিয়েতনাম। 
নগরায়ন, শিল্পায়ন, শিক্ষা, কর্মসংস্থানে নারীর অগ্রযাত্রা, নারীর ক্যারিয়ার, শিশু লালনপালন ও শিক্ষার ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি, কাজের সন্ধানে দেশ ত্যাগ, ভোগবাদীতা, জীবনযাত্রা ক্রমে কঠিন থেকে কঠিনতর হওয়ায় উন্নত দেশের অনেক নারী সন্তান ধারণ এমনকি বিয়েতে পর্যন্ত আগ্রহ হারিয়েছে অনেক আগে। এসব কারণে বিভিন্ন দেশে দ্রুত কমছে জনসংখ্যা। 

জাতিসঙ্ঘের ২০১৭ সালের প্রতিবেদনে কত বছর পর কোন দেশের জনসংখ্যা কত হবে তা তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে ২০১৭ সালে বুলগেরিয়ার জনসংখ্যা ছিল ৭০ লাখ ৮৫ হাজার। ২০৫০ সালে তা ৫৪ লাখে এবং এই শতাব্দী শেষে তা ৩৮ লাখে নেমে আসবে । বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৮৯ সালে বুলগেরিয়ার জনসংখ্যা ছিল ৯০ লাখ। 

২০১৭ সাল পর্যন্ত লাটভিয়ার জনসংখ্যা ১৯ লাখ ৫০ হাজার। ২০৫০ সাল নাগাদ তা ১৫ লাখ এবং এ শতাব্দী শেষে তা ১১ লাখে নেমে আসবে। 
লিথুনিয়ার জনসংখ্যা প্রায় ২৯ লাখ। এ শতাব্দী শেষে এটা ১৯ লাখে নেমে আসবে। পোল্যান্ডের জনসংখ্যা বর্তমানে প্রায় চার কোটি। এ শতাব্দী শেষে তা ২ কোটিতে নেমে আসবে। রোমানিয়ার জনসংখ্যা বর্তমানে প্রায় ২ কোটি। বর্তমান শতাব্দী শেষে তা নেমে আসবে ১ কোটি ২০ লাখে। সার্বিয়ার বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৮৮ লাখ। চলমান শতাব্দী শেষে তা ৫৪ লাখে নেমে আসবে। জাপানের জনসংখ্যা ১২ কোটি ৭৪ লাখ। ২০৫০ সালে ১০ কোটি ৮৭ লাখে নেমে আসবে। অপর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৬০ সালের মধ্যে জাপানের জনসংখ্যা ৮ কোটি ৭৪ লাখে নেমে আসবে। দণি কোরিয়ার বর্তমান জনসংখ্যা ৫ কোটি থেকে নেমে শতব্দী শেষে ৩ কোটি ৮৭ লাখে নেমে আসবে। 
রাশিয়ার জনসংখ্যা বর্তমানে ১৪ কোটি ৩০ লাখ থেকে ২০৫০ সালে ১১ কোটি ১০ লাখে নেমে আসবে। 

গার্ডিয়ান পত্রিকার এক প্রতিবেদনে গত বছর বলা হয়, পর্তুগালের জনসংখ্যা দেড় কোটি থেকে ২০৬০ সালে ৬৩ লাখে নেমে আসবে। 
অর্গানাইজেশন অব ইকোনমিক করপোরেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইডিসি) এর চলতি বছরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দণি কোরিয়ায় প্রতি একজন নারীর গড়ে ১ দশমিক ২ জন সন্তান রয়েছে, যা বিশ্বে সর্বনিম্ন। 
সিঙ্গাপুরের মন্ত্রী জোসেফ টিও চলতি বছর মার্চে ঘোষণা করেছেন সে দেশে একজন নারীর গড়ে ১ দশমিক ১৬ জন করে সন্তান রয়েছে। এটি বিশ্বে সবচেয়ে কম জন্মহার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে।
১০ বছর আগে একজন মার্কিনী নারীর গড়ে ২ দশমিক একজন করে সন্তান থাকত। এখন তা ১ দশমিক ৭৭ জন। গত বছর একে ঐতিহাসিক পতন হিসেবে উল্লেখ করেছে বোস্টন গ্লোব পত্রিকা।


আরো সংবাদ



premium cement