মালয়েশিয়ার সম্ভাবনায় শ্রমবাজার সাড়ে ছয় মাস ধরে (এসপিপিএ) স্থগিত হয়ে আছে। মাহাথির মোহাম্মদ সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর সোর্স কান্ট্রিভুক্ত দেশ থেকে নতুন পদ্ধতিতে লোক নেয়ার আগ পর্যন্ত ‘ম্যানুয়েল’ পদ্ধতিতে শ্রমিক নেয়ার পরিকল্পনা মোটামুটি চূড়ান্ত করেছিল; কিন্তু বাংলাদেশেরই কিছুসংখ্যক ‘ওভার একটিভ’ (অতি উৎসাহী) ব্যবসায়ী/এজেন্টদের অপতৎপরতার কারণে সেটি আর এগোয়নি। এতে বাংলাদেশের সাধারণ ব্যবসায়ী এবং রিক্রুটিং এজেন্সিতে টাকা জমা দিয়ে অপেক্ষায় থাকা কর্মীরাই বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। তারপরও বৃহৎ শ্রমবাজারটি যাতে বন্ধ হয়ে থাকে, সে জন্য দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র এখনো অব্যাহত রয়েছে বলে মনে করছেন এ পেশার সাথে সম্পৃক্ত কূটনীতিক ও বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টরা।
২০১৬ সালে জি টু জি প্লাস পদ্ধতিতে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে এমওইউ চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল। নাজিব রাজাক সরকারের আমলে সিনারফ্ল্যাক্স কোম্পানির তৈরি করা অনলাইন সিস্টেমে বাংলাদেশ থেকে কর্মী যাওয়া শুরু হয়। ২০১৮ সালের ৩০ আগস্ট পর্যন্ত দেশটিতে মোট আড়াই লাখ কর্মী পাড়ি জমালেও বেশির ভাগ কর্মী ভালো আছেন। এসব কর্মী গিয়েছিল ঢাকার ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে। তখন মালয়েশিয়া সরকার শৃঙ্খলা ফেরাতে বাংলাদেশের ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী নেয়া শুরু করেছিল। মালয়েশিয়ার জাতীয় নির্বাচনে নাজিব রাজাক সরকারের ভরাডুবির পর আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার মাহাথির মোহাম্মদ আবারো প্রধানমন্ত্রী হন।
নতুন সরকারের মন্ত্রিপরিষদ দায়িত্ব নেয়ার পর ঢাকার ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে (জি টু জি প্লাস) কর্মী নেয়ার কার্যক্রম (এসপিএএ) স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ, নেপাল, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, ভারত, পাকিস্তানসহ সোর্স কান্ট্রিভুক্ত দেশ থেকে ইউনিফাইড সিস্টেমে শ্রমিক নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ নিয়ে দুই দেশে দু’টি জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার স্থগিত হওয়ার পর প্রায় সাড়ে ছয় মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে; কিন্তু দেশটিতে এখনো বাংলাদেশী কোনো কর্মী যাচ্ছে না। এমনকি জি টু জি প্লাস পদ্ধতিতে যাওয়া কর্মীদের মধ্যে অপেক্ষায় থাকা ৭১ হাজার কর্মীকে যাওয়ার জন্য সুযোগ দেয়া হয়। তারপরও ঢাকার হাইকমিশনসহ অন্যদের গাফিলতির কারণে ৩০ হাজারের মতো শ্রমিক দেশটিতে যেতে পারেনি বলে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর বহির্গমন শাখার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান। এরমধ্যে মালয়েশিয়া সরকারের নির্ধারিত সময়ে না যাওয়ার কারণে ভিসাগুলো বাতিল হয়েছে।
এরই মধ্যে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নতুন মন্ত্রিসভায় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন উচ্চশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ রাজনীতিক মো: ইমরান আহমদ। কিন্তু তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ ধনী দেশ কাতার, সৌদি আরব, ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করলেও এখন পর্যন্ত মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের বর্তমান অবস্থা জানতে দেশটি পরিদর্শনে যাননি। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, শ্রমবান্ধব চারটি দেশ সফর করার পর আগামী ২৫ মার্চ প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী ইমরান আহমদের নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদলের মালয়েশিয়া সফরে যাওয়ার কথা রয়েছে। তবে তার এই সফরসূচি ঠিক রয়েছে কি না তা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কেউ গতকাল রাত পর্যন্ত নিশ্চিত করতে পারেননি।
গতকাল মালয়েশিয়া থেকে একজন ব্যবসায়ী নাম না প্রকাশের শর্তে নয়া দিগন্তকে বলেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের ভবিষ্যৎ কী, তা নিয়ে অনেকেই উদ্বিগ্ন। কারণ প্রতিনিয়ত বাংলাদেশকে নিয়ে দেশী-বিদেশী নানা ষড়যন্ত্র চলছে। বিশেষ করে এনজিওদের অপতৎপরতা বেশি বলে অভিযোগ করেন তিনি।
ঢাকা ও মালয়েশিয়ার কূটনীতিক সূত্রগুলো মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের সর্বশেষ অবস্থান জানিয়ে গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, মালয়েশিয়ার সাথে বাংলাদেশের দু’টি জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকের পর একটা পরিপূর্ণ রিপোর্ট দিতে হয়। কয়েক দিন আগে তারা তাদের রিপোর্টটি সাবমিট করেছে। তাদের গঠিত ওই কমিটি রিপোর্টটা আগে ভালোভাবে দেখবে। যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষ হলে রিপোর্টটি মালয়েশিয়ার কেবিনেটে উঠবে। রিপোর্টটি কেবিনেট এপ্রুভাল দিলেই ইউনিফাইড সিস্টেম (সবার জন্য) চালু হবে। এক প্রশ্নের উত্তরে তারা বলেন, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যে মডেল তাদের দেয়া হয়েছে সেটিই বেস্ট মডেল হিসেবে বিবেচনা করছে তারা। মালয়েশিয়ান সরকারের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে ঢাকার একজন কূটনীতিক গতকাল শুক্রবার নয়া দিগন্তকে বলেন, তারা শুধু আমাদের কাছে একটি শব্দ বলেছে, ‘আমরা নতুন গভর্মেন্ট, আমরা সব কিছু আসলে বুঝে উঠতে পারছি না। আমাদের কাছে একেকজন একেকভাবে বুঝানোর চেষ্টা করছে। তারা আরো বলেছে, তোমাদের লোকজন (জনশক্তি ব্যবসায়ী এবং কমিউনিটি) একটু ওভার একটিভ। এর জন্য আমাদের বিভিন্ন লেভেলে বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তি তৈরা হয়েছে। তখন আমরা তাদের বোঝানোর চেষ্টা করলাম, তারা ওভার একটিভ না? দ্য ওয়ান্ট টু নো দিজ থিংকস। তখন তারা আমাদের বললÑ মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারটা এবার নতুন ফর্মেটে হচ্ছে। আর সেটি একেবারে চূড়ান্ত হয়ে আছে। এখন আরেকটা জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক হবে। আশা করছি দ্রুত স্থগিত থাকা শ্রমবাজারটি আবারো চালু হবে। অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, মালয়েশিয়ার সরকার চাচ্ছে থার্ড পার্টির এনগেজমেন্টটা আসলে কেমন হবে? আর ২ নম্বর হচ্ছে আগে যে অনলাইন সিস্টেমটা ছিল সেটি না হয়ে নতুন কোন পদ্ধতিতে হবে? সোর্স কান্ট্রিভুক্ত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের নাম বাদ দেয়া হচ্ছে কি নাÑ এমন প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা এই বিষয়ে হাইকমিশনে কথা বলেছি। অন্যান্য জায়গায়ও খোঁজ নিয়েছি। যতটুকু জানতে পেরেছি আসলে এই খবরটি এখন পর্যন্ত ভুয়া। এরপর ওই কর্মকর্তা মালয়েশিয়া হাইকমিশনের একটি সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, সোর্স কান্ট্রি দেশের তালিকা থেকে নাম বাদ দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। বাদ দিতে হলে আগে আমাদের সাথে বসতে হবে। ওদের কেবিনেটে প্রস্তাব উত্থাপন করতে হবে। কেবিনেটে বলতে হবে কী কী কারণে বাদ দেয়া হবে।
গতকাল জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান নয়া দিগন্তকে বলেন, মালয়েশিয়ার মার্কেটটি খোলার জন্য যে কাজটি করা হয়েছে, সেটি এখন মালয়েশিয়ান অথরিটির হাতে রয়েছে। তারা আমাদের এখানে যে কাজগুলো করে গেছেন বা সর্বশেষ মিটিংয়ের ধারাবাহিকতায় তা আমাদের জানাবার কথা। সার্ভিস প্রোভাইডার কে নিয়োগ দেবেন এবং সেই সার্ভিস প্রোভাইডারের মাধ্যমে তারা আমাদেরকে জানাবেন কোন পদ্ধতিতে মালয়েশিয়াতে নতুন করে এই ডিমান্ডগুলো প্রসেস হবে। যেহেতু তারা এটি এখন পর্যন্ত আমাদেরকে জানাননি সেই কারণেই আপাতত কাজটি শুরু হচ্ছে না। সোর্স কান্ট্রি দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের নাম কি বাদ দেয়া হচ্ছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আসলে এই খবরটির সত্যতা জানার চেষ্টা করেছি। এখন পর্যন্ত খবরটি ভুয়াই মনে হচ্ছে।
বায়রার সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন স্বপন এর আগে নয়া দিগন্তকে বলেছেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার আবার শুরু হবে। আমরা আবারো নতুন পদ্ধতিতে ব্যবসা শুরু করতে পারব বলে আশাবাদী।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা