২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চাঁদ দেখা : সমস্যা ও সমাধান-১

-

১৪৪০ হিজরি মোতাবেক ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের রমজান-পূর্ব শাবান মাসের চাঁদ দেখার ঘোষণায় ৬৪ জেলার স্থানীয় ৬৪ উপকমিটি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সংশ্লিষ্টদের চাঁদ দেখতে না পাওয়া এবং সে মোতাবেক নেতিবাচক ঘোষণাদানের পরই ওই রাতে এবং পরবর্তী কয়েক দিন পর্যন্ত বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, পত্রপত্রিকায় সে দিন বাস্তবে অন্যরা বা বিভিন্ন স্থানে চাঁদ দেখা গিয়েছিল মর্মে প্রচার ও লেখালেখি হতে থাকে। যদিও কর্তৃপক্ষের সেই ঘোষণা বিধিবহির্ভূত ছিল না, তারপরও ধর্ম-প্রতিমন্ত্রীর সদয় উদ্যোগে সবার সংশয় দূরীকরণার্থে কয়েক দিনের মাথায় একটি বৈঠক ডাকেন। বৈঠকে ঢাকার বড় বড় মুফতি ও আলেমদের এবং যারা যেখানে চাঁদ দেখেছেন মর্মে ইতঃপূর্বে অবহিত করেছিলেন, তাঁদেরও সাক্ষ্যদান বা বক্তব্য শোনার জন্য আহ্বান করা হয়। সে অনুষ্ঠানে ঘোষণার দিন যারা চাঁদ দেখেছেন বলে দাবি করেছিলেন (রাঙ্গামাটি/মুন্সীগঞ্জ/দিনাজপুর বা ঠাকুরগাঁও) তাঁদের সবার বক্তব্য শুনে বিশেষত মুন্সীগঞ্জের ইমাম সাহেবের নিজে ব্যতীত আরো দু’জনসহ দেখার কথা শুনে এবং তাঁকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো, তা হলে আপনি কেন মুন্সীগঞ্জের জেলা উপকমিটিকে বা আপনার থানা/উপজেলার সংশ্লিষ্ট কাউকে অবহিত করলেন না? তখন তাঁর নিরুত্তর হয়ে থাকায়; এ ছাড়া, বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিনের চিন্তাভাবনায় আমার কাছে দু’টি সমস্যা মনে হয়েছেÑ
সাধারণ জনগণের মত, অনেক জানাশোনা লোকও একদিকে এ বিষয়টি জানেন না যে, ‘জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি’ তথা ধর্ম-মন্ত্রণালয় বা ইসলামিক ফাউন্ডেশন কেবল বায়তুল মোকাররমে বসেই বা এ একস্থানে চাঁদ দেখেই চাঁদ প্রমাণিত হওয়া বা না হওয়ার ঘোষণা দেন না; বরং ৬৪ জেলার ৬৪টি স্পটে চাঁদ দেখার পর একে একে সবগুলোর তথ্য বা সংবাদ নিশ্চিত হয়েই ঘোষণাটি দেয়া হয়।
আরেক দিকে ৬৪ জেলার ৬৪ স্পটের বাইরে যারা চাঁদ দেখেন (যা একেবারেই সম্ভব, কারণ একটা জেলা তো অনেক বড়; অনেকগুলো উপজেলা হয়ে থাকে। মেঘাচ্ছন্ন দিনে জেলা কমিটির স্পটের বাইরে বিশাল এরিয়ার মধ্যে, মেঘের ফাঁকফোকরে, সামান্য সময়ের জন্য চাঁদ দেখা অসমম্ভব নয়) তেমন সাধারণ লোকজন এমনকি সাধারণ আলেম/ইমাম/মুয়াজ্জিনও এ বিষয়টি জানেন না যে, ‘বিক্ষিপ্তভাবে আমাদের মতো কেউ যেকোনো স্থানে চাঁদ দেখলেই রোজা-ঈদ পালন করা যায় না বা তা জরুরি হয় না। বরং তা অবশ্যই সুনির্দিষ্ট চাঁদ দেখা কমিটিকে জানাতে হবে। আর এ জানানো, চাঁদ দেখার চেষ্টা করা, বিশ্বাসযোগ্য নিকটস্থ কেউ দেখেছেন বলে জানতে পারলে, তাকেসহ স্থানীয় কমিটির কাছে সংবাদটি পৌঁছাতে চেষ্টা ও সহযোগিতা করা, একজন মুসলমান হিসেবে প্রত্যেকেরই দায়িত্ব রয়েছে। কেননা নামাজ-রোজা পালন আমাদের প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগতভাবেও ফরজ দায়িত্ব। যে কারণে বা যে চাঁদ দেখার সাথে আমারও ফরজ রোজা এবং ঈদ পালনের সম্পর্ক রয়েছে; সেখানে আমি নিজে আমার সাধ্যের ভেতরের দায়িতটুকুও পালন না করে, কেবল সরকারকে বা চাঁদ দেখা কমিটিকে বা অমুক-তমুককে দোষারোপ করাই যথেষ্ট নয়, যৌক্তিকও নয়।
এ বিষয় দু’টি স্পষ্ট করা, আমাদের করণীয়, চাঁদ দেখা কমিটির করণীয় এবং এতদসংক্রান্ত শরিয়তের বিধান-দিকনির্দেশনাকে সহজবোধ্য করাই প্রবন্ধটি প্রস্তুতির মূল প্রয়াস।
সূচনা : কয়েক বছর থেকে মাঝে মধ্যে রমজান ও ঈদুল ফিতরের সময়ে পুরো দেশে এক অবাক করা বিক্ষিপ্ত-বিরোধ অবস্থা ছড়িয়ে পড়ে। কেন্দ্রীয় চাঁদ দেখা কমিটির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য যেখানে ছিল সারা দেশে সবাই মিলে একসাথে একই দিনে মিলেমিশে ঈদ উদযাপন করা, সেখানে তার বিপরীতে স্থানে-স্থানে, জেলায়-জেলায় দুই দিনে ঈদ হতে শুরু করেছে; আবার এ বছর (২০১৯ খ্রি./১৪৪০হি.) তো বাংলাদেশে মোট তিন দিন ঈদ উদযাপিত হয়ে গেল। স্বয়ং ঈদের দিন যা আনন্দ-খুশি ও ঐক্য-ভালোবাসার একটা দিন সুযোগ ছিল, তাতেও পরস্পর বিরোধ-বিবাদ ও মনোমালিন্যের সূত্রপাত ঘটছে! যা একজন বিবেকবান মানুষ কোনো দেশের পক্ষেই কাম্য ও সমীচীন বলে ভাবতে পারেন না।
এর চেয়েও অধিক ক্ষতিকর সেসব আলোচনা-সমালোচনা যা ঈদ-পরবর্তী এক সপ্তাহব্যাপী পত্রপত্রিকা, গণমাধ্যম বা টকশো ইত্যাদিতে চলতে থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে (অনিয়ম ও ভুল হলে বা সরকারের ঘোষণার বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে) সংশ্লিষ্ট আলেমদের দোষারোপ করা হয় যে, তাঁরা নিজেদের আপসের বিরোধের কারণে বা রাজনৈতিক কারণে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে গোলমাল বাধাতে চাচ্ছেন! পক্ষান্তরে সরকারের বিরুদ্ধেও এমন অবাস্তব অভিযোগ করা হয় যে, তাঁরা জেনে-বুঝে মুসলমানদের ইবাদতে বিঘœ ঘটান এবং ধর্মীয় বিষয়-ব্যাপারে খামখেয়ালি করেন!
কিন্তু সামান্য চিন্তা করলেই বোঝা যাবে, উভয় অভিযোগই একেবারে ভুল ও অবাস্তব। কেননা, সংশ্লিষ্ট আলেমদের মাঝে বিরাট একটা সংখ্যা এমনও হয়ে থাকেন, যাদের রাজনীতির সাথে ন্যূনতম সম্পর্কও থাকে না এবং এ ক্ষেত্রে তাদের কারো কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থেরও কল্পনা করা যায় না। একইভাবে সরকারের সংশ্লিষ্ট সেই বিভাগ বা কমিটিতে জড়িত সদস্যসহ অপরাপর সবাই মুসলমান, নিজেরাও রোজা রাখেন, ধর্ম-কর্মের প্রতি তাদের সবারই সম্মানবোধ অবশ্যই আছে। তাদের ব্যাপারে এমন কু-ধারণা পোষণ যেমন সঠিক বলে মনে হচ্ছে না; তেমনি তারা জেনেবুঝে জনগণের ঈদ-রোজা বিনষ্টের মারাত্মক পরিণতি, নিজের ঘাড়ে নিতে যাবেন কেন?
মূল কারণ ও সমস্যা : আসল বিষয়টি এ ছাড়া আর কিছুই নয় যে, একে অন্যের অবস্থান বুঝতে ও বুঝাতে ভুল বোঝাবুঝির শিকার হচ্ছেন বা পড়েছেন। তার কারণ সম্ভবত এটাই যে, সংশ্লিষ্ট সরকারি লোকজন এটিকে একটি জাতীয় উৎসব এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনাধীন একটা ব্যাপার মনে করে থাকেন; যাতে আলেমদের কোনোরূপ হস্তক্ষেপ তাদের কাছে অনাকাক্সিক্ষত মনে হতে পারে। আরেকটি বিষয় হলো, তারা এ ক্ষেত্রে কেবল সত্য সংবাদ, যা শ্রোতার কাছে সত্যরূপে নিশ্চিতভাবে প্রতিভাত হয়, তার ওপর ভিত্তি করেই রোজা বা ঈদ-চাঁদের ঘোষণা দানকে যথেষ্ট মনে করে থাকেন। অথচ এ ক্ষেত্রে এমন একটা পার্থক্য যে, কারো নিজ প্রত্যয়-বিশ্বাস অপর কারো বেলায়, অন্যভাবে বলা যায়, একজনের বোধ-বিশ্বাস বা জানা সত্য বিষয়টি অন্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বা বাধ্যতামূলক বলতে গেলে বা ধর্তব্য হতে পারে তখন, যখন তা সত্য সাক্ষ্য হিসেবে পেশ করা হবে; যার জন্য বিধিবদ্ধ বিশেষ শর্ত ও নিয়ম-নীতি বিদ্যমান। কেবল সত্য সংবাদ হওয়াই শরিয়তের নির্দেশনা মোতাবেক এ ক্ষেত্রে আইনত যথেষ্ট হয় না।
তা ছাড়া, আলেমরা জানেন যে, আমাদের ঈদ পালন অপরাপর সাধারণ জাতী-গোষ্ঠীর উৎসবপর্ব পালনের অনুরূপ নয়; তা বরং একটি ইবাদত শুরু করা এবং এর শেষান্তে আরেকটি ইবাদত পালনের নামান্তর হয়ে থাকে। যেখানে শরিয়তের বাতানো নিয়ম-নির্দেশনার বাইরে বা বিপরীতে কোনো পন্থা-পদ্ধতি বৈধ হয় না। আর কোনো বিষয় যতই সত্য হোক, নির্ভরযোগ্য হোক এবং শ্রোতার/শ্রোতাদের সে বিষয়ে যতই পাকাপোক্ত প্রত্যয় জন্ম নিয়ে থাকুক; কিন্তু তারা তাদের এই প্রত্যয়পূর্ণ বিষয়টি পুরো দেশের জনগণের ওপর আবশ্যকরূপে প্রয়োগ বা চাপিয়ে দিতে পারবেন না যে পর্যন্ত না শরিয়তসম্মত দলিল মোতাবেক এবং বিধি মোতাবেক ‘সাক্ষ্য বাক্য’ উচ্চারণের মাধ্যমে চাঁদ দেখার ‘সংবাদ’টি ‘সাক্ষ্য’ হিসেবে কমিটি বা কর্তৃপক্ষের কাছে প্রমাণিত হয়ে যায় এবং তারপর কর্তৃপক্ষ তা বিধি মোতাবেক ঘোষণা করেন। সে কারণেই প্রয়োজন, বিষয়টি প্রশ্নে সুচিন্তিতভাবে এগুনো এবং শরিয়তের নিয়ম-বিধি মোতাবেক চাঁদ দেখার ঘোষণা দানের লক্ষ্যে দেশের বিজ্ঞ মুফতি আলেমদের পরামর্শ মতে একটা কর্মকৌশল তথা নীতিমালা প্রণীত হওয়া বা (যদি না থাকে) থাকা চাই। যাতে বিষয়টি প্রশ্নে সব আলেম ও সর্বসাধারণ মানুষের আস্থা-বিশ্বাস থাকে। তারপর ওই নীতিমালা ও কর্মপন্থা প্রতিপালন সংশ্লিষ্ট সবার ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক করে দিতে হবে। আর সেই কর্মপন্থার নিরিখেই রেডিও, টিভি ও বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে চাঁদ দেখার এবং তা প্রমাণিত হওয়ার সংবাদটি ঘোষণা করা, প্রচারিত হওয়া চাই।
এমন কর্মকৌশল অবিলম্বনে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, পুরো দেশের আনাচে-কানাচে কোথাও থেকে সরকারিভাবে প্রদত্ত ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠবে না। বিভিন্ন ধ্যান-ধারণার সাথে জড়িত ও শ্রেণিপেশার আলেমরা সবাই তার সাথে ঐকমত্য পোষণ করবেন এবং সারা দেশে খুশি ও আনন্দঘন পরিবেশে মিলেমিশে একসাথে, একই দিনে ঈদ উদযাপিত হবে। যদিও শরিয়তের বিবেচনায় সারা দেশে একই দিনে ঈদ উদযাপিত হওয়া বিষয়টির ক্ষেত্রে তেমন বিশেষ কোনো গুরুত্বারোপ করা হয়নি। কেননা, ইসলামের প্রথম যুগগুলোতে তৎকালীন বিদ্যমান সম্ভাব্য যোগাযোগের উপকরণগুলোকেও এ কাজের প্রয়োজনে ব্যবহারে এবং একই দিনে ঈদ উদযাপনের বিষয়ে কোনো তাকিদ করা হয়নি। আবার যে ক্ষেত্রে দেশটির আয়তন সুবিশাল হবে, সে ক্ষেত্রে তো উভয়স্থলের ভিন্নতার কারণে, মারাত্মক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।
তারপরও যদি একটা দেশের জনগণ ও সরকারের সদিচ্ছা হয় যে, সারা দেশে একই দিনে ঈদ উদযাপন হওয়া চাই; সে ক্ষেত্রেও শরিয়তের আলোকে তার সুযোগ আছে। তবে তার শর্ত হলো, ঈদের ঘোষণা যেন পুরোপুরি শরিয়তের ওই সাক্ষ্যবিধি বা নিয়ম মোতাবেক হয়।
লেখক : মুফতি, ইফা


আরো সংবাদ



premium cement