২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মানবজাতির পথপ্রদর্শক

-


আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:কে পাঠালেন মানবজাতির পথপ্রদর্শক হিসেবে। তাঁর উপর নাজিল করা হয় আল্লাহর পবিত্র গ্রন্থ আল কুরআন, যা সমগ্র মানবজাতির জন্য অনুসরণীয় একটি জীবনাদর্শ। আধুনিক জীবনে বৈজ্ঞানিক জিজ্ঞাসা ও তৎপরতা মানুষের কৃষ্টির একটি অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে, পবিত্র কুরআন ও হাদিসে যেহেতু মানুষের জীবনপদ্ধতির সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে, তাই এই দু’টি সূত্রে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিও ইঙ্গিত থাকার কথা। হ্যাঁ, ইঙ্গিত আছে এবং আছে খুব জোরালোভাবে। পবিত্র কুরআনের ছয় হাজার ৬৬৬টি আয়াতের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৭০০ আয়াতই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসংক্রান্ত। মানুষ এই আয়াতগুলো খুব একটা শোনেনও না, বোঝেনও না। যারা ধর্মীয় ওয়াজ করেন, তারাও এসব আয়াতের কথা তেমন বলেন না। এর একটা কারণও রয়েছেÑ আমাদের দেশে যারা কুরআন তিলাওয়াত করেন তাদের অনেকেই মানে বোঝেন না- আর যারা মানে বোঝেন, তাদের বেশির ভাগের সাথেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিশিার সম্পর্ক খুব কম। কিন্তু আমাদের নবীজীর জ্ঞান Revealed Knowledge, অর্থাৎ নাজিলকৃত জ্ঞান। স্বয়ং আল্লাহই ছিলেন তাঁর শিক। সূরা নাজমে বলা হয়েছে, নবীজী কোনো মনগড়া কথা বলতেন না, তার প্রতি প্রত্যাদেশ হয়েছিল ওহি এবং আল্লাহ তাঁকে শিাদান করেছিলেন শক্তিশালী জিবরাইলের মারফত। আল্লাহ যেখানে নিজেই নবীজীকে শিা দিয়েছেন, সেখানে নবীজীর উক্তিগুলো যে বিজ্ঞানসম্মত হবেÑ তাতে আর সন্দেহ কোথায়? নবীজী যেসব কাজ করতে বলেছেন এবং যেসব কাজ করতে নিষেধ করেছেনÑ সেগুলো একটু খুঁটিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, সেগুলো সত্যিই বিজ্ঞানসম্মত। নবীজীর জ্ঞান যে সুদূরপ্রসারী এবং সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য ছিল, তা কয়েকটি হাদিস বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়।
আবু হুরাইরা রা: থেকে একটি হাদিসে বর্ণিত আছেÑ একদিন এক ব্যক্তি নবী করিম সা:-এর কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার একটি কালো সন্তান হয়েছে। ওই ব্যক্তি স্বভাবতই কালো রঙের সন্তান আশা করেননি। নবীজী তাকে জিজ্ঞেস করলেন ভিন্নতর এক প্রশ্নÑ ‘তোমার উট আছে?’ লোকটি উত্তর দিলেন, জি আছে। উটগুলোর রঙ কী? নবীজী আবারো জিজ্ঞেস করলেন। লোকটি উত্তর দিলেন, লাল রঙের। নবীজীর পরের প্রশ্নÑ সব লাল রঙের, একটাও কি ধূসর বর্ণের নেই। এবার লোকটি উত্তর দিলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, একটা ধূসর বর্ণের উট আছে বটে। এবার নবীজী লোকটিকে প্রশ্ন করলেন, ‘অনেক লাল উটের মধ্যে হঠাৎ ধূসর রঙের উট এলো কেমন করে? লোকটি উত্তরে বলল, হয়তো সেটা একটা গুপ্ত বৈশিষ্ট্য থেকে গেছে। নবীজী লোকটিকে বুঝিয়ে দিলেন হয়তো তোমার সন্তানের কালো রঙও এসেছে একটি গুপ্ত বৈশিষ্ট্য থেকে। উল্লেখ্য, এই গুপ্ত বৈশিষ্ট্যকে জেনেটিক বা বংশগতি বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় Hidden trait. ভাবতে অবাক লাগে, আজ থেকে চৌদ্দ শ’ বছর আগে এই হাদিসে নবীজী যে প্রসঙ্গটির অবতারণা করেছিলেন তা ছিল Recessive জিন বা সুপ্ত জিনের কথা যা বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেন অনেক পরে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, মানবদেহের বিভিন্ন traits বা বৈশিষ্ট্যের জন্য এক বা একাধিক জিন দায়ী। জিন হচ্ছে জীবকোষের মধ্যে অবস্থিত ডিএনএ বা Deoxyribo nucleic acid নামক যে Master molecule of life বা বংশগতির নীলনকশা নির্ধারক যে অণু রয়েছে, তার অংশবিশেষÑ যা বিশেষ কয়েকটি Chemical Components দিয়ে তৈরি। বংশপরাণুক্রমে এই জিন এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে প্রবাহিত হয় প্রজনন কোষের মারফত। যেসব বাবা-মার চোখ কালো, তাদের সন্তানের চোখ কালো হবেÑ সেটাই স্বাভাবিক। এ েেত্র কালো চোখের জন্য যে জিনগুলো দায়ী, সেগুলো সন্তানের মধ্যে সরাসরি প্রকাশিত হয়- এগুলোকে বলা হয় Dominant জিন। এখন বংশগতির কোনো একপর্যায়ে কোনো এক পূর্বপুরুষের চোখ যদি নীল থেকে থাকে, তবে সেই নীল চোখের জন্য দায়ী জিনগুলো সরাসরি প্রকাশিত না হয়ে বেশ কয়েক জিন ধরে সুপ্ত থাকতে পারে এবং হঠাৎ কালো চোখওয়ালা বাবা এবং কালো চোখওয়ালা মায়ের সন্তানের মধ্যে সেই পূর্বপুরুষের নীল চোখের জন্য দায়ী জিনগুলোÑ যেগুলো এতকাল সুপ্ত ছিল, সেগুলো যদি হঠাৎ করে প্রকাশ পায়, তবে বাবা-মার চোখ কালো হওয়া সত্ত্বেও সন্তানের চোখ নীল হতে পারে এবং তা মাঝে মাঝে হতেও দেখা যায়। বাবা মায়ের গায়ের রঙ সাদা হওয়া সত্ত্বেও সন্তানের রঙ কালো হতে পারে এবং সেটি ঠিক এ কারণেই। ভাবতে অবাক লাগে যে, Dominant জিন এবং সুপ্ত জিনগুলো আমরা ভালো করে জানতে পেরেছি এইমাত্র সে দিন, আর আমাদের মহাজ্ঞানী নবী সেগুলোর প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন কত শত বছর আগে। নবীর হাদিসটিতে আরো একটি বিষয় লণীয় তা হচ্ছে, উটের বৈশিষ্ট্যের সাথে মানুষের বৈশিষ্ট্য তুলনা করেছেন তিনি অর্থাৎ তিনি বোঝাতে চেয়েছেন এটাকে বংশগতির নিয়মকানুন, জীবজন্তু ও মানুষের বেলায় সদৃশ এবং এটাই আধুনিক বংশগতিরও কথা।
এবার পরিবেশসংক্রান্ত একটি হাদিসের আলোচনা করা যাক। আজকের বিশ্বে পরিবেশ একটি বহুল আলোচিত বিষয়Ñ সম্প্রতি ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে হয়ে গেল বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলন। এর পরপরই বিশ্বজুড়ে পরিবেশসংক্রান্ত সচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশে সরকার বিভিন্ন এনজিও বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন কাব পরিবেশের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলছেÑ চারদিকে গাছ লাগানোর এক হিড়িক ল করা যায়। এই হিড়িক একটি শুভ পদপে, যদি অবশ্য গাছ লাগানোর ব্যাপারটি এলোপাতাড়ি না হয়ে সুপরিকল্পিত হয় এবং ব্যাপারটিকে মনিটর করা হয়Ñ কোনখানে গাছ বাঁচল না, কোনখানে আবার লাগাতে হবে সেসব দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। উল্লেখ্য, গাছের অস্তিত্বের সাথে আমাদের ও অন্যান্য প্রাণীর অস্তিত্ব ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমরা কার্বন ডাই-অক্সাইড ত্যাগ, বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করিÑ গাছ কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় অক্সিজেন ত্যাগ করে। আমরা যদি বেশি মাত্রায় গাছ কেটে ফেলি এবং তা জ্বালাই, তা হলে এক দিকে যেমন আমাদের এবং যানবাহন, কলকারখানা থেকে নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করার মতো পর্যাপ্ত গাছ রইল না, অন্য দিকে কাঠ পোড়ানোর ফলে বাতাসে অতিরিক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড সংযোজন করলাম। অর্থাৎ বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড buildup বা পুঞ্জীভূত হতে থাকল। এ কথা সুবিদিত যে, বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড, Water vapour, Nitrous oxide, methane ইত্যাদি গ্যাসের মাত্রা বেড়ে গেলে ভূপৃষ্ঠে যে সৌরতাপ এসে পড়ে তা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে আটকা পড়ে যায় অধিক মাত্রায়Ñ এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় গিনে হাউজ অ্যাফেক্ট এই তাপমাত্রা বাড়ার ঘটনাকে বলা হয় global warming. তাপমাত্রা বাড়লে বরফ গলবে বেশি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে, সমুদ্র উপকূলবর্তী দেশগুলো তলিয়ে যাবেÑ এ এক ভয়াবহ পরিণতি। এসব কথা ভেবে সব দিকে গাছ লাগানোর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে, বেশি গাছ থাকলে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা কমবে- তা ছাড়া গাছ মাটিকে আঁকড়ে রাখে, নদীর তীরে গাছ থাকলে ভূমিধস হয় না, গাছের সাথে পরিবেশ সংরণ ও বন্যার প্রকোপ ইত্যাদি গভীরভাবে সম্পৃক্ত।
ভাবতে অবাক লাগে, বাংলাদেশে যেখানে ৮৬ শতাংশেরও বেশি জনসাধারণ মুসলমান, সেখানে গাছ লাগানোর প্রেরণা তো অনেক আগেই আসা উচিত ছিল হাদিস থেকে। গাছ লাগানোর প্রতি নবীজী অত্যধিক গুরুত্বারোপ করেছেন। কানজ-উল উম্মাল কিতাবে হজরত বিবি আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত একটি হাদিস অনুযায়ী নবীজী বলেছেন, ‘যদি নিশ্চিতভাবে জানো যে, রোজ কিয়ামত এসে গেছে, তথাপি তোমার হাতে যদি একটি গাছের চারা থাকে যা লাগানো যায়Ñ তবে সেই চারা লাগাবে।’
আমরা সবাই জানি যে, রোজ কিয়ামত কখন হবে, সে জ্ঞান আল্লাহ দেননি। রোজ কিয়ামত যখন হবে, তখন গর্ভবতী উটের গর্ভও প্রত্যাখ্যাত হবেÑ তখন কে কার কথা ভাববেÑ দৌড়াদৌড়ি, ছুটোছুটি শুরু হয়ে যাবেÑ এ অবস্থায় চারা লাগাতে যাবে কে? অথচ এ অবস্থাতেও চারা লাগাতে বলা হয়েছে। এই হাদিসটির মারফত নবীজী বৃরোপণের প্রতি যে অসাধারণ গুরুত্বারোপ করেছেন তার তুলনা হয় না। হাদিস অনুসরণ করতে হবে, এ কথা মনে করেও ধর্মপ্রাণ সাধারণ মুসলমানেরা যদি গাছ লাগাতে শুরু করে এবং শুরু করা উচিতও, তবে তা হবে দেশের জন্য একটি শুভ পদপে।
জ্ঞান-বিজ্ঞানসংক্রান্ত অনেক হাদিস রয়েছে। সবগুলো আলোচনা করা বেশ সময়সাপে। এবারকার ঈদে মিলাদুন্নবী উপলে দেশবাসীর প্রতি একটি কথাই বলার আছে, তা হলো- আপনারা অনেক হাদিস মেনে চলেন- নবীর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দেখিয়ে এবং আল্লাহর আদেশ পালন করেই। এখন জ্ঞান-বিজ্ঞানসংক্রান্ত হাদিসগুলো বুঝুন, ছেলেমেয়েদের বোঝান এবং পালন করুন। একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদিস হচ্ছে জ্ঞানার্জন নর ও নারীর জন্য অবশ্য কর্তব্যÑ এই হাদিস মানলে তো বাংলার ঘরে ঘরে নিরর লোক থাকারও কথা নয়। তাই দেশবাসীর প্রতি আমার আকুল আবেদন, আপনারা ঘরের দোরগোড়ায় এই হাদিসটি লিখে রাখবেনÑ জ্ঞানার্জন প্রত্যেক নর ও নারীর জন্য অবশ্য কর্তব্য। আমাদের জ্ঞান বাড়লে আমরা রাসূলকে ভালো করে বুঝতে পারব, আল্লাহর মহিমা বুঝতে পারব।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ভিসি,
সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়


আরো সংবাদ



premium cement