২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রবিউল আওয়াল সিরাতের মাস

-

রবিউল আউয়াল মানে প্রথম বসন্ত। রবিউন অর্থ বসন্ত, আউয়াল মানে প্রথম। রবিউন থেকে রবিউল আওয়াল। অর্থাৎ প্রথম বসন্তের মাস। হিজরি বর্ষের তৃতীয় মাস এটি। রবিউল আউয়াল মাস নামকরণ যথার্থ হয়েছে। কারণ, এ মাস জুলুম-অত্যাচারে অতিষ্ঠ, পাপাচারে লিপ্ত মানুষের জন্য বসন্তের আগমনী বার্তার মতো তাদের ত্রাণকর্তার আগমনের সওগাত নিয়ে এসে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছে যে, তোমাদের জন্য একজন ত্রাণকর্তার আবির্ভাব হচ্ছে।
সিরাতুন্নবী সা:-এর মাস রবিউল আউয়াল : এই মাস সিরাতুন্নবী সা: সম্পর্কে বেশি বেশি করে জানার এবং আলোচনা করার মাস। এই মাসে ব্যাপক হারে সিরাতুন্নবী মাহফিল করে, যারা ইসলামকে জঙ্গি, সন্ত্রাসী এবং সাম্প্রদায়িক ধর্ম প্রমাণের ব্যর্থ ও হীন প্রচেষ্টা চালিয়ে পেয়ারা নবী সা:-এর আদর্শকে কলঙ্কিত করতে চায়, তাদের মুখোশ খুলে দেয়া, পেয়ারা নবী সা: এবং তাঁর আদর্শের সৌন্দর্য ও শ্রেষ্ঠত্ব সবার সামনে পরিষ্কার করে দেয়া উম্মতের দায়িত্ব।
ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের, ধর্মীয়, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যাপারে তাঁর হেদায়েত ও নির্দেশনা কী তা সব শান্তি ও মুক্তিকামী মানুষের সামনে স্বচ্ছভাবে তুলে ধরা এবং সেভাবে চলার শপথ নেয়া মুসলমানদের নৈতিক দায়িত্ব। আর রবিউল আউয়াল মাস হলো তার উত্তম সময়।
সিরাতে রাসূল সা: কেমন ছিলেন : ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন সৎ, চরিত্রবান, কোমল হৃদয়, ন্যায়পরায়ণ, সহজ-সরল ও মানবদরদি। ধর্মীয় ব্যাপারে ইবাদত-বন্দেগিতে তিনি বেনজির তুলনাহীন। রাতের তাহাজ্জুদ নামাজে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে উনার পা ফুলে যেত। কেউ প্রশ্ন করলে বলতেন, আমি কি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হবো না? পারিবারিক ব্যাপারে মা আয়েশা রা:-এর একটি উক্তিই যথেষ্ট। তিনি বলেন, ‘আকাশের একটি সূর্য আছে, আমারও একটি সূর্য আছে, আমার সূর্যটি আকাশের সূর্যের চেয়ে উত্তম।’ একদিন জনৈক সাহাবি পেয়ারা নবী সা:-এর সাথে দেখা করতে এলে, পেয়ারা নবী সা:-এর হাতে হলুদের গুঁড়া দেখে বললেন, হে রাসূল সা: আপনার হাতে এগুলো কী? পেয়ারা নবী সা: বলেন, ‘আমি পারিবারিক কাজে সাহায্য করছি।’ এতে বোঝা যায়, প্রিয় রাসূল সা:-এর পারিবারিক জীবন কেমন ছিল। সামাজিকভাবে তিনি কত জনপ্রিয় এবং বিশ্বস্ত ছিলেন, হিজরতের রাতের ঘটনা থেকে তা অনুমান করুন। হজরত আলীকে ঘরে রেখে যাওয়ার সময় তাকে বললেন, ‘মানুষের এই আমানতগুলো তাদের কাছে পৌঁছে দিয়ে, দু-একদিন পর তুমি মদিনায় চলে যাবে।’ সমাজের নেতারা যাকে মারার জন্য চক্রান্ত করে, সাধারণ জনগণ তার কাছে ধন-মাল আমানত রাখেন।
শান্তি ও মানবতার দূত প্রিয়নবী সা: : শান্তিপ্রিয় ছিলেন তিনি। তাই কিশোর বয়স পাড়ি না দিতেই হিলফুল ফুজুল গঠন করেন সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য। দাসপ্রথার বিরুদ্ধে নানা পদক্ষেপ নিয়ে তিনি মানুষকে তার স্বীয় মর্যাদা ফিরিয়ে দেন। নারীজাতিকে ভোগ্যপণ্যের অবস্থান থেকে তুলে এনে মাতৃত্বের মর্যাদাপূর্ণ আসনে সমাসীন করেন। মানুষকে মানুষের দাসত্ব এবং প্রভুত্ব থেকে মুক্ত করেন। প্রভু হয়ে বসে যারা মানুষের উপর জুলুম-অত্যাচার করত, শোষণ করত, আত্মসাৎ করত মানুষের সম্পদ, তাদের রাহুগ্রাস থেকে তিনি মানুষকে আজাদি দান করেন। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ নির্মূল করে সাম্য প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
মানবতার প্রতি তার সবচেয়ে বড় অবদান, তিনি বিশ্ব মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তা, ইহকালীন এবং পরকালীন মুক্তির জন্য, একটি পরিপূর্ণ ন্যায়বিচার-সমৃদ্ধ পক্ষপাতমুক্ত, মানবতাবাদী পূর্ণাঙ্গ একটি জীবনব্যবস্থা মানুষকে উপহার দিয়েছেন। তা বাস্তবায়ন করে এর প্রয়োগপদ্ধতি এবং এর সুফল মানুষকে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন।
ওয়াফাতুন্নবী সা:-এর মাস রবিউল আউয়াল : সূর্য যেমন রাতের আঁধার ভেদ করে বিশ্বময় আলো ছড়িয়ে দিয়ে দিন শেষে অস্ত যায়, আমাদের পেয়ারা নবী সা: ১২ রবিউল আউয়ালে সকালে জন্ম নিয়ে সারা দুনিয়ার হেদায়েতের জন্য আলোর মশাল জ্বালিয়ে দিনের শেষভাগে দুনিয়া থেকে একই দিন সোমবার আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান। উম্মত যেন পথহারা না হয়, জীবনসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে অন্য কারো দ্বারস্থ হতে না হয়, নিজেদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক এবং ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সব সমস্যার সমাধান তারা নিজেরা করতে পারে, তার জন্য একটি বিরাট ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার বাস্তব রূপ এবং তার সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য কুরআন-সুন্নাহর সংবিধান ও গাইডলাইন রেখে ৬৩ বছরে নশ্বর দুনিয়াকে বিদায় জানান। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তাই এই রবিউল আউয়াল মাস ওয়াফাতুন্নবী সা:-এর মাসও। সারা জীবন তিনি মানবতার মুক্তির জন্য জীবনবাজি রেখে কাজ করেছেন। মরণকালেও উম্মতের জন্য পেরেশান ছিলেন। কারণ তিনি ছিলেন রাহমাতুল্লিল আলামিন।
রবিউল আউয়াল হেদায়েত গ্রহণের মাস : রবিউল আউয়াল মাস প্রিয় নবী সা:-এর জীবনচরিত স্মরণ ও আলোচনা করে ভুলে যাওয়া সেই হেদায়েত গ্রহণ ও নবায়নের মাস। তাঁর হেদায়েতের প্রথম কথা ছিল আল্লাহকে ছাড়া অন্য কাউকে লালন-পালনকারী, বিধানদাতা, হুকুমকর্তা, রিজিকদাতা, শাসনকর্তা এবং সেজদা পাওয়ার ও প্রার্থনা কবুল করার একক, নিরঙ্কুশ, সার্বভৌম ক্ষমতার উপযুক্ত সত্তা হিসেবে বিশ্বাস, স্বীকার, গ্রহণ ও মান্য করা যাবে না। এসব ব্যাপারে নিরপেক্ষও থাকা যাবে না।
তাঁর হেদায়েতের দ্বিতীয় কথা ছিলÑ আল্লাহর রাসূল সা:-এর নেতৃত্ব ছাড়া অন্য কারো নেতৃত্ব মানা যাবে না। যারা রাসূল সা:-এর অনুসারী তাদের মানা রাসূল সা:কে মানার নামান্তর। যারা সব ক্ষেত্রে রাসূলের অনুসারী নয়, তাদের নেতৃত্ব গ্রহণ, রাসূলকে অমান্য ও অস্বীকার করার নামান্তর। তাই রাসূল সা: বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের রাসূলের নিয়ম ছেড়ে দিলে পথহারা গুমরাহ হয়ে যাবে’ (আল হাদিস)।
আল্লাহ বলেছেন, ‘সব ব্যাপারে রাসূল সা: তোমাদের যা দিয়েছেন তা আঁকড়িয়ে ধরো, আর যা নিষেধ করেছেন তা ছাড়ো। কারণ তোমাদের জন্য সব ব্যাপারে উত্তম আদর্শ আছে আল্লাহর রাসূল সা:-এর জীবনে’ (আল কুরআন)। রাসূল সা: বলেন, ‘তোমাদের দায়িত্ব হলো আমার সুন্নত ও আমার হেদায়েতপ্রাপ্ত চার খলিফার সুন্নত মতো চলা। তোমাদের ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক, ব্যক্তিগত ও সামাজিক সব কাজ আমার এবং আমার চার খলিফার সুন্নত অনুযায়ী সম্পাদন ও পরিচালনা করা তোমাদের দায়িত্ব।’
যারা মিলাদুন্নবী সা: ও সিরাতুন্নবী সা: উদযাপন করেন কিন্তু রাসূল সা:কে সব ব্যাপারে বিশ্বাস এবং আদর্শ হিসেবে গ্রহণ ও মান্য করেন না, তারা রাসূল সা:-এর প্রকৃত মহব্বতের উম্মত এবং মুসলমান হতে পারেন না। যারা ধর্মীয় ব্যাপারে রাসূল সা:কে মানেন। সামাজিক, রাজনৈতিক এবং রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে পেয়ারা রাসূল সা: প্রদর্শিত নীতিমালা বাদ দিয়ে অন্য দেশী-বিদেশী নীতিমালাকে বিশ্বাস, গ্রহণ ও মান্য করে চলে, তারা মুসলমান কিভাবে হয়? আল্লাহ বলেন, তোমরা আল্লাহর এবং রাসূল সা:-এর কথা মেনে চলো। নিজেদের আমল (নামাজ-রোজা-হজ-জাকাত ইবাদত-বন্দেগি) বরবাদ করিও না (আল কুরআন)। এতে বোঝা যায়, সব ব্যাপারে আল্লাহ রাসূল সা:-এর কথা না মানলে নামাজ-রোজা ও ইবাদত-বন্দেগির কোনো মূল্য হবে না। তাই এই মাসে পেয়ারা নবী সা:-এর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে, নিজেদের জীবন, পরিবার ও সমাজ গঠনের সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
লেখক : খতিব, বান্দরবান কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ


আরো সংবাদ



premium cement