২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কলম : এক বিরাট নিয়ামত

-


কথায় বলেÑ ‘তরবারির চেয়ে কলমের শক্তি বেশি’। কথাটি যে বর্ণে বর্ণে সত্যি তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। ইতিহাস ঘেঁটে কলমের বলে স্মরণীয় ব্যক্তিত্বের নজির পাওয়া যায় ভুরিভুরি। কিন্তু শুধু তরবারির ব্যবহারে ইতিহাস খ্যাত হয়েছে এমন ব্যক্তির নজির সম্ভবত একটিও পাওয়া যাবে না। অবশ্য আগেকার দিনে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে দক্ষতার সাথে তরবারি চালিয়ে অনেকে অসামান্য সফলতা অর্জন করেছেন। তবে তাতে যে তারা ইতিহাস খ্যাত হয়েছেন এমন দৃষ্টান্ত সম্ভবত নেই। অপর দিকে এ যাবৎ পৃথিবীতে যত জ্ঞানী, বিজ্ঞানী, পণ্ডিত, সাহিত্যিক, কবি, লেখক নিজের জ্ঞান গরিমায় স্মরণীয় ও বরণীয় হয়েছেন তাদের প্রত্যেককেই কলমের আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়েছে। তা ছাড়া বাস্তব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা কলমের সীমাহীন গুরুত্বের প্রমাণ পাই। কলমই মানুষকে দান করে অন্যান্য জীব থেকে স্বাতন্ত্র্য। কেন না যেকোনো ধর্মের শাস্ত্রবিধি এমনকি গবেষণালব্ধ কল্যাণকর বিধিনিষেধ, নিয়ম-কানুন সবই কলমের মাধ্যমেই লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। আর সেই সব বিধিবিধান পালন করেই মানুষ সম্মানের, সফলতার অধিকারী হয়। পবিত্র কুরআন মজিদে অবতীর্ণের সূচনাপর্বের পাঁচটি বাণীর একটি বাণীই ছিল কলমকে কেন্দ্র করে। তাতে বলা হয়েছেÑ ‘যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন’ (সূরা আলাক : ৪)
বিদ্বানগণ গবেষণা চালিয়ে কলমের তিনটি প্রকার নির্ধারণ করেছেন। ১. আল্লাহ তায়ালার স্বহস্তে সৃজিত সর্বপ্রথম কলম, যাকে তিনি তাকদির বা ভাগ্য লেখার আদেশ করেছিলেন। যেমনÑ হাদিসে বর্ণিত হয়েছেÑ ‘আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করেন এবং তাকে লেখার নির্দেশ দেন। সে মতে কলম কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু হবে, সব লিখে ফেলে। এ কিতাব আল্লাহর নিকট আরশে রক্ষিত আছে’ (কুরতুবি)। ২. ফেরেশতাদের কলম দ্বারা তারা ভবিতব্য ঘটনা, তার পরিণাম এবং মানুষের আমলনামা লিপিবদ্ধ করেন। এ সম্পর্কেই আল্লাহ বলেনÑ ‘কিয়ামতের দিন আমি তাকে একটি কর্মলিপি বের করে দেবো এবং সে তা খোলা অবস্থায় পাবে এবং বলা হবে, তোমার আমলনামা পড়ে দেখো, আজ তুমিই তোমার নিজের হিসাবের জন্য যথেষ্ট’ (সূরা বনি ইসরাইল : ১৩-১৪)।
৩. সাধারণ মানুষের কলম দিয়ে তারা তাদের কথাবার্তা লিখে এবং নিজেদের অভীষ্ট কাজে ব্যবহার করে। লিখন প্রকৃতপক্ষে এক প্রকার বর্ণনা এবং বর্ণনা মানুষের বিশেষ গুণ (কুরতুবি)। হজরত কাদাতাহ রা: বলেন, ‘কলম আল্লাহ তায়ালার একটি বড় নিয়ামত। কলম না থাকলে কোনো ধর্ম প্রতিষ্ঠিত থাকত না এবং দুনিয়ার কাজ-কারবারও সঠিকভাবে পরিচালিত হতো না।’ হজরত আলী রা: বলেন, ‘এটা আল্লাহ তায়ালার একটি বড় কৃপা যে, তিনি তাঁর বান্দাকে অজ্ঞাত বিষয়সমূহের জ্ঞানদান করেছেন এবং তাদের মূর্খতার অন্ধকার থেকে জ্ঞানের আলোর দিকে বের করে এনেছেন। তিনি মানুষকে লিখন বিদ্যায় উৎসাহিত করেছেন। কেননা এর উপকারিতা অপরিসীম। আল্লাহ ছাড়া কেউ তা গণনা করে শেষ করতে পারে না। যাবতীয় জ্ঞান বিজ্ঞান, পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের ইতিহাস, জীবনালেখ্য ও উক্তি, আল্লাহ তায়ালার অবতীর্ণ কিতাবসমূহ সমস্তই কলমের সাহায্যে লিখিত হয়েছে এবং পৃথিবীর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অক্ষয় হয়ে থাকবে। কলম না থাকলে ইহকাল ও পরকালের সব কাজকর্মই বিঘিœত হবে’ (তাফসিরে মা’আরিফুল কুরআন; অষ্টম খণ্ড; পৃষ্ঠা : ২৪-২৫)।
বাস্তবতা সাক্ষীদের কলম ব্যবহারে অক্ষম মানুষের তুলনায় কলম ব্যবহারকারী মানুষের মানমর্যাদা বেশি। বলা বাহুল্য, সৃষ্টির মানমর্যাদা বৃদ্ধির জন্য যে মাধ্যমটি অতুলনীয় প্রশংসার বা গুরুত্ব লাভের দাবিদার তাকে স্বয়ং স্রষ্টাই এ যোগ্যতা দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, এর শপথ করে বলেছেনÑ ‘শপথ কলমের এবং সেই বিষয়ের, যা তারা (ফেরেশতারা) লিপিবদ্ধ করে’ (সূরা কলম; আয়াত-১)। আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতারা যেমন মানুষের আলমনামা লিখে রাখেন, তেমনি তিনি মানুষকেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি লিখে রাখার তাগিদ দিয়ে বলেছেনÑ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা যখন একে অন্যের সাথে নির্ধারিত সময়ের জন্য ঋণের কারবার করো তখন তা লিখে রেখো। তোমাদের মধ্যে কোনো লেখক যেন ইনসাফের সাথে লিখে দেয়’ (সূরা বাকারা; আয়াত-২৮২)।
এ বাণী ঈমানদারদের ওপর গুরুত্বপূর্ণ কাজের লিখিত দলিল প্রমাণ সংরক্ষণকে অত্যাবশ্যক করে দেয়। সেই সাথে শর্ত রাখা হয়, লেখক যেন কারো পক্ষপাতিত্ব না করে ন্যায়সঙ্গতভাবে তার দায়িত্ব পালন করে। স্রষ্টার এ নির্দেশ যদি প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায় (যেমনÑ বিচারকার্য, দেশ পরিচালনা, সাংবাদিকতা, শিক্ষকতা তথা কলমকে পুঁজি করে বা কলমকে সম্বল করে যারা নিজের উপার্জন ও পরের কল্যাণে নিয়োজিত, তারা যদি কারো পক্ষপাতিত্ব বা স্বার্থ হাসিলের জন্য তা ব্যবহার না করে বরং প্রকৃত সত্য লিপিবদ্ধ করার কাজে ব্যবহার করে) তাহলে বিশৃঙ্খলা বলতে সম্ভবত কিছুই থাকত না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বেশির ভাগ কলম ব্যবহারকারীর দুর্নীতির কারণে বিশ্বে আজ ঘটে চলেছে নানা অঘটন। এক দিকে কেউ কলমের ন্যায়সঙ্গত একটি আঁচড় আটকে রেখে হাতিয়ে নিচ্ছে অবৈধ অর্থসম্পদ আর অপরকে ফেলছে বিপন্ন অবস্থায়। অপর দিকে এই কলমকে ব্যবহার করেই কোনো কোনো অকালকুষ্মাণ্ডকে রাতারাতি পৌঁছে দেয়া হচ্ছে জনপ্রিয়তার শীর্ষে, আবার প্রকৃত প্রশংসার দাবিদারকে নামিয়ে দেয়া হচ্ছে দুর্নামের অতল গহ্বরে।
‘কলম’ নামক জড়বস্তুটিকে ব্যবহারের সময় সবারই মনে রাখা উচিতÑ স্রষ্টা অন্যতম এক মহৎ উদ্দেশ্যে এ বস্তুটির অস্তিত্ব বিদ্যমান রেখেছেন। যে ব্যক্তি কলমের অতুলনীয় ক্ষমতা যথাযথ প্রয়োগে সফল, সেই সমাজে যথার্থ সম্মানিত ব্যক্তি বলে পরিচিতি পায়। কেন না কলমকে স্বয়ং স্রষ্টা স্বীয় কাজে এবং বাণীতে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। সমাজে যারা এ বস্তুটিকে অবলম্বন করে টিকে আছেনÑ তা উপার্জন বা পরিচিতি লাভ যেকোনো ক্ষেত্রেই হোক না কেন, তাদের এটি ব্যবহারে সৎ ও সচেতন থাকা একান্ত আবশ্যক। অন্যথায় কলম সৃষ্টির মহৎ উদ্দেশ্য ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে এবং লেখককে ইহকাল ও পরকালে লাঞ্ছিত-অপমানিত হতে হবে। কারণ একজনের লেখা বর্ণনা বা তথ্যের সাথে অপর অনেকের শিক্ষা বা উপকার লাভ জড়িত থাকে। সুতরাং সবার মঙ্গলের কথা চিন্তা করে লেখকের নিজের খ্যাতি অর্জনের মোহের মুখে লাগাম টানাই সমীচীন। তা না হলে অবশ্যম্ভাবী কুখ্যাতি এড়ানো দুষ্কর। অতএব, স্রষ্টা প্রদত্ত শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে ‘কলম’ ব্যবহারে ব্যবহারকারীর যথেষ্ট সতর্ক থাকা পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং ঈমানের দাবিও বটে!
লেখক : প্রবন্ধকার


আরো সংবাদ



premium cement