২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

খুলনা-১ আসনের ফলাফল ঘোষণার সময় আসলে কী হয়েছিল?

-

খুলনা-১ আসনে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণায় ‘গরমিল'-এর খবরের কারণে দু'জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে মামলা হয়েছে। একজনকে তিনদিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। কেন রিমান্ডে নেয়া হলো সাংবাদিককে? আসলে কী হয়েছিল সেদিন?

খুলনা-১ আসনটি বটিয়াঘাটা ও দাকোপ উপজেলা নিয়ে গঠিত। এই আসনে নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের পঞ্চানন বিশ্বাস। নির্বাচনের দিন ৩০ ডিসেম্বর রাতেই ফলফল ঘোষণা করা হয়। ফল ঘোষণা করেন খুলনার জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং অফিসার হেলাল হোসেন। খুলনায় জাতীয় সংসদের মোট আসন ৬টি। এর মধ্যে খুলনা-২ আসনে ইভিএম-এ নির্বাচন হয়েছে।

৩০ ডিসেম্বর রাতে ফলাফল ঘোষণার সময় খুলনা জেলা রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে যে সাংবাদিকরা উপাস্থিত ছিলেন, তাদের একজন একাত্তর টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি পারভেজ রেজা। তিনি ঢাকা থেকে গিয়েছিলেন খুলনার নির্বাচনের খবর সংগ্রহ করতে।

তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘রাত ৯টার কিছু সময় পরে রিটার্নিং কর্মকর্তা হেলাল হোসেন খুলনা-১ আসনের চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করেন। তিনি তখন নৌকা প্রতীকে ভোটের সংখ্যা বলেন দুই লাখ ৫৩ হাজার সামথিং। আর ধানের শীষ প্রতীকে ২৮ হাজার। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে একজন স্থানীয় সাংবাদিক, আমি নাম বলতে পারব না, তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, আপনি যে ফলাফল ঘোষণা করলেন, সেই ফলাফলে দেখা যায় মোট ভোটারের চেয়ে ২২ হাজারেরও বেশি ভোট কাস্ট হয়েছে। তিনি এটা শুনে একটু অপ্রস্তুত হয়ে যান। এরপর আমাদের সামনেই তিনি কারো সাথে ফোনে কথা বলেন। ফল ঘোষণার মাইক্রোফোন অন ছিল। যার সঙ্গে কথা বলেন, তার সঙ্গে তিনি রাগতস্বরেই কথা বলছিলেন।''

পারভেজ রেজা বলেন, ‘‘এরপর তিনি আমাদের কিছু বললেন না। অন্য আসনের ফল ঘোষণা করতে থাকলেন। রাত ১০টার দিকে তিনি নতুন করে আবার খুলনা-১ আসনের ফলাফল ঘোষণা করেন। তখন তিনি এক লক্ষ ৭২ হাজারে কিছু বেশি ভোট নৌকা প্রতীক পেয়েছে বলে ঘোষণা করেন, আর ধানের শীষ আগের মতোই ২৮ হাজারের কিছু বেশি।''

শুরুর ভুল নিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা তখন কোনো ব্যাখ্যা দিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে পারভেজ রেজা বলেন, ‘‘না, তিনি কোনো ব্যাখ্যা দেননি। আগের ঘোষণা করা ফলাফল নিয়ে তিনি কোনো ধরনের কথাই বলেননি।''

সাংবাদিকরা কোনো ব্যাখ্যা চেয়ে প্রশ্ন করেছিলেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘না, আমরা কোনো প্রশ্ন করিনি। কোনো ব্যাখ্যাও চাইনি। আমরা তো দেখছিলাম। আর সাংবাদিকরাই তো বিষয়টি তাঁর নজরে এনেছিলেন।''

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘প্রথমে রাত ৯টার পরে খুলনা-১ আসনের যে ফল ঘোষণা করা হয়েছিল, তাৎক্ষণিকভাবে আমরা সাংবাদিকরা সবাই যার যার অফিসে সেই ফলই পাঠিয়ে দেই। এক ঘণ্টা পরে আবার যখন নতুন করে সেই ফল ঘোষণা করে, সেটাই আমরা আবার পাঠিয়ে দিই।''


প্রসঙ্গত, খুলনা-১ আসনের মোট ভোটার ২লাখ ৫৯ হাজার ৪২০ জন এবং কেন্দ্র ১০৭টি।

ফল ঘোষণার সময় খুলনায় কর্মরত বাংলাভিশনের সাংবাদিক আতিয়ার পারভেজও সেখানে ছিলেন। তিনিও পারভেজ রেজার বক্তব্য সমর্থন করেই ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘প্রথমে খুলনা-১ আসনের ফল যখন রিটার্নিং অফিসার ঘোষণা করেন, তখন দেখা গেল মোট কাস্টিং ভোট মোট ভোটারের চেয়েও ২২ হাজার বেশি। এটা সাংবাদিকরাই তাকে জানান। তিনি তখন এটা সংশোধন করবেন বলে জানান এবং পরে এটা সংশোধন করে ফল ঘোষণা করেন। তিনি আসলে দু'বারই সহকারী রিটার্নিং অফিসারের পাঠানো ফলাফলই ঘোষণা করেন। প্রথমবার ২২ হাজার ভোট বেশি হওয়ায় রিটার্নিং কর্মকর্তা ফোনে সম্ভবত সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাকে ধমকও দেন। আমার মনে হয়েছে, এটা তথ্যগত ভুল এবং পরে আসলে তথ্যগত ভুল ঠিক করা হয়েছে।''

আতিয়ার পারভেজও জানান, ‘‘প্রথমে যে ফল ঘোষনা করা হয়, তা কোনো কোনো সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। আর পরে যে ফল আবার ঘোষণা করা হয়, তার কোনো ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি বা সাংবাদিকরা তখন এ নিয়ে কোনো প্রশ্নও করেননি।''


এর কোনো রেকর্ড বা ভিডিও ফুটেজ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘কারো কাছে আছে কিনা আমি জানি না। তবে ফল ঘোষণা করা হয় দীর্ঘ সময় ধরে৷ সাধারণত আমরা, টিভি সাংবাদিকরা দীর্ঘ ভিডিও করি না। আর আমার মূল আগ্রহ ছিল খুলনা-২ আসন। কারণ, সেখানে হেভিওয়েট প্রার্থী ছিলেন। আর আমি নিশ্চিত করেই বলছি, খুলনা-১ আসনের ফল দু'বার ঘোষণা করা হয়।''

দু'জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে খুলনার বটিয়াঘাটা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৩১ ডিসেম্বর মামলা করেছেন বটিয়াঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার দেবাশীষ চৌধুরী। ১ জানুয়ারি বাংলা ট্রিবিউন ও ঢাকা ট্রিবিউনের সাংবাদিক হেদায়েৎ হোসেনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। বুধবার তাকে ৩ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে।

আর দৈনিক মানবজমিনের খুলনা প্রতিনিধি রাশিদুল ইসলাম আত্মগোপনে আছেন। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়েছে, ‘‘ঢাকা ট্রিবিউন-এর বাংলা অনলাইনে এবং মানবজমিনে ‘খুলনা-১, মোট ভোটারের চেয়ে ২২,৪১৯ ভোট বেশি পড়েছে' শিরোনামে খবর প্রকাশ হয়, যা মিথ্যা এবং অসত্য। তারা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ এবং বিতর্কিত করার জন্য এই খবর পরিবেশন করেছেন, যা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অপরাধ।''

খুলনা-১ আসনে দু'বার ফল ঘেষণার বিষয়ে জানতে চাইলে বটিয়াঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার দেবাশীষ চৌধুরী টেলিফোনে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দু'বার ফল ঘোষণার বিষয়টি আমার জানা নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রিটার্নিং অফিসারের সঙ্গে কথা বলুন। আমি নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে মামলা করেছি।''


আর রিটার্নিং কর্মকর্তা ও খুলনার জেলা প্রশাসক হেলাল হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমিই ফল ঘোষণা করেছিলাম। তবে খুলনা-১ আসনে দু'বার ফল ঘোষণা বা ভুল সংশোধনের কোনো বিষয় আমার নলেজে নেই। আমার যেটা জানা আছে, তা হলো, ২০টি সেন্টারের রেজাল্ট আমরা একসঙ্গে দিচ্ছিলাম। আবার আপডেট দিচ্ছিলাম। সেক্ষেত্রে দাকোপ-এর একটি রেজাল্টে আমি নাকি প্রথমে ধানের শীষের ভোট বলেছি ২৯ হাজার, পরে নাকি বলেছি ২৮ হাজার প্লাস। এটা হলো ওদের (সাংবাদিকদের) কথা। ৭-৮ শ' ভোটের একটা গরমিল। তাদের হিসেবে ৭-৮শ' ভোট প্লাস-মাইনাস বলছিল তারা। এটা হয়েছে যখন আমি আপডেট দিচ্ছিলাম।

তিনি বলেন, ‘‘আরেকটি আসনে ভোটারের চেয়ে ২২ হাজার বেশি ভোটের ঘোষণা আমি কখনোই দেইনি। এটা নিয়ে আমার সহকর্মীদের সঙ্গেও কথা বলেছি। এটা নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো কথা হয়নি। আর এটা কোনোভাবেই হওয়া সম্ভব নয়। নির্বাচন কমিশন কি এত ব্যালট পেপার দেয় নাকি? এটা আমাদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের (সাংবাকিদের) শিওর হওয়া দরকার ছিল।''

নির্বাচন কমিশন (ইসি)-র নির্দেশে দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এটা স্থানীয় বিষয়। এই মামলা হয়েছে স্থানীয়ভাবে। স্থানীয় প্রশাসন মামলা করেছে। ভোটের রেজাল্টকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য তারা একটি মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করেছে। পুরো ইলেকশনটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছে।''


খুলনা-১ আসনে ফলাফলের ভুল সংশোধন করে দ্বিতীয়বার আবার ঘোষণা করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আমি ঠিক জানি না। ওখানের বিষয়গুলো আমি জানি না।''

জাতীয় পার্টির আসন নিয়ে ইসি সচিবের ভুল তথ্য!

৩১ ডিসেম্বর ভোরে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনের চূড়ান্ত ফল ঘোষণায় ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ জাতীয় পার্টি (জাপা) সব মিলিয়ে ২০টি আসন পেয়েছে বলে জানান। আসলে জাতীয় পার্টি পেয়েছে ২২টি আসন৷এই তথ্য সংশোধন করে ইসি সচিবালয় থেকে কোনো বিবতিও দেয়া হয়নি।

তবে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাওয়ায় একটি জাতীয় দৈনিককে ইসি সচিবালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব সাইদুর রহমান বলেন, ‘‘স্যার বিষয়টি নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। সেদিন তাড়াহুড়ো করে কাজ করতে গিয়ে এই ভুল হয়েছে। আসলে জাতীয় পার্টির আসনসংখ্যা হবে ২২।''


আরো সংবাদ



premium cement