২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বিবিসির দৃষ্টিতে নিজামীর আসনের রাজনীতির হালচাল

মতিউর রহমান নিজামী - ছবি: সংগৃহীত

বেলা ১১টা। পাবনার বেড়া উপজেলা। হাটের দিন। তাই লোক সমাগম প্রচুর। তবে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা তাদের মধ্যে খুব একটা যে আছে তেমনটা না। চায়ের দোকান, কাপড়ের দোকান, অটোরিকশাচালক- রাস্তাঘাটের সাধারণ মানুষ কারো মধ্যে প্রকাশ্যে এই নির্বাচন নিয়ে তেমন একটা আলোচনা নেই।

মুদি দোকানদার রহমত আলীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম এবারের নির্বাচনে কোন বিষয়গুলো তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ? কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে বলছিলেন, ‘যে প্রার্থী আসুক তার কাছে আমাদের চাওয়া বেড়া বাজারটার যাতে উন্নতি করে। কারণ আমাদের ব্যবসা বাণিজ্যের অবস্থা খুব খারাপ।’

এখানকার একজন গৃহিণী আবেদা খাতুন বলছিলেন, ‘ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিস্থিতি ভালো না। আর রাস্তাঘাটের অবস্থা খুব খারাপ। সেটা উন্নয়ন করতে হবে।’

এই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের শামসুল হক টুকু। তিনি বেড়ার অধিবাসী। বেড়া বাজারে একাধিক মানুষের সাথে কথা বলার চেষ্টা আমি করেছি।

কিন্তু কেন জানি তার মুখ ফুটে কিছু বলতে চাচ্ছিলেন না। এর কারণ কী? নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক মানুষ আমাকে জানিয়েছেন, তারা কী চান এটা এখন আর প্রকাশ্যে বলার মতো অবস্থা তাদের নেই।

কারণ সেটা বললেই হয়তোবা কোনো হামলার শিকার হতে পারে। কিন্তু শঙ্কাটা কিসের? বেড়ার মানুষ বলছেন, যে ভোটে দাঁড়াবে তার মধ্যে থেকে ভালো প্রার্থীকেই তারা ভোট দেবেন।

অনেকে আবার একটু সাহস দেখিয়ে বলেছেন, তারা নতুন প্রার্থী চান এবং তাকেই তারা ভোট দেবেন। পুরাতন প্রার্থীদের আর তারা চাচ্ছেন না।

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বের এই শহর পাবনা-১ নম্বর আসনটি (বেড়া-সাঁথিয়া) নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ।

এই আসনটি রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বর্তমানে এর সমীকরণ মেলানো জটিল।

বাংলাদেশের নিবন্ধন বাতিলকৃত জামায়াতে ইসলামির আমীর মতিউর রহমান নিজামী এই আসনটিতে ১৯৯১ জয়ী হন।

২০০১ সালে আবারো তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এই আসনের সাঁথিয়া উপজেলা তার জন্মস্থান। অর্থাৎ আপাতদৃষ্টিতে এই আসনটি জামায়াত সমর্থিত একটা আসন বললে বেশি বলা হবে না।

তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করছেন এলাকার অবস্থা আগের চেয়ে পরিবর্তন হয়েছে।

মো: আব্দুল কাদের বেড়া উপজেলার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং বেড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। তিনি বলছিলেন, সাংগঠনিকভাবে বহু আগে থেকে তারা দলীয় কর্মসূচি পালন করে আসছেন।

এই মতিউর রহমান নিজামীর ২০১৬ সালে যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসি কার্যকর করা হয়। দশকের পর দশক ধরে যে এলাকার মানুষ জামায়াতে ইসলাম এবং তার আমীরের অনুসারী হয়ে নির্বাচনের সময় ভোটব্যাংকে নিজেদের সমর্থন জানিয়েছেন সেই দল বা ব্যক্তির এখন অস্তিত্ব নেই।

তাহলে এবারের নির্বাচনে এখানকার ভোটাররা কোন বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছেন? তাদের কাছে কী স্থানীয় উন্নয়ন নাকি স্থানীয়, জাতীয় রাজনীতি বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে?

বিকাল চারটা। সাঁথিয়া উপজেলা। বাজারের মধ্যে একটা চায়ের দোকান।

এখানে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে কথা বলতেই অনেকেই নিজ আগ্রহেই মত প্রকাশ করতে চাইলেন। যেটা বেড়া উপজেলার থেকে একেবারে ভিন্ন চিত্র।

কৃষির পাশাপাশি তাঁতশিল্প এখানকার মানুষের মূল জীবিকা।

পাবনা-১ আসন, সাঁথিয়া এবং বেড়ার আংশিক নিয়ে এই আসন গঠিত। এখনকার মানুষের মূল পেশা কৃষি।

তারপরেই রয়েছে তাঁতশিল্প। দুই উপজেলায় ১৭ হাজার তাঁতশিল্পে মোট ৩৭ হাজারের মতো শ্রমিক কাজ করছে। এছাড়া ব্যবসা বলতে যেটা রয়েছে সেটা ছোট-মুদি দোকানের ব্যবসা। বড়-ছোট কোনো শিল্পকারখানা এখানে নেই।

মো: আব্দুল কাদের (বেড়া উপজেলার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং বেড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান) বলছিলেন, ‘এক এক নেতার কিছু ফলোয়ার থাকে। কিন্তু এখন পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। আওয়ামী গত দশ বছরে এখানে যা উন্নয়ন করেছে তাতে করে আমার মনে হয় মানুষ আর ভুল করবে না, আর এই উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রেখেই আওয়ামী লীগ ভোটে লড়াই এর জন্য প্রস্তুত।’

আমি দুই উপজেলার অসংখ্য মানুষের সাথে কথা বলেছি জানার চেষ্টা করেছি, যে এবারের নির্বাচনে তাদের কাছে মূল ইস্যু কী?

অবাক হওয়ার বিষয় হল তারা স্থানীয় উন্নয়ন/ ইস্যুর চেয়ে রাজনীতিকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। এবং সেখানে অবধারিত ভাবে চলে আসছে জামায়াতে ইসলাম এবং মতিউর রহমান নিজামীর নাম। তবে ব্যবসা বাণিজ্যের মন্দার কথা তারা উল্লেখ করেছেন। বলছিলেন গত বছর ৫/৭ ধরে তাদের ব্যবসার মন্দা।

এই ব্যবসা বলতে মূলত তাদের তাঁতকেন্দ্রিক যে কাপড়ের ব্যবসা সেটা এবং অন্যান্য ছোটখাট ব্যবসার কথা বলতে চেয়েছেন। এটাও তারা বলছেন, এই ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতির জন্য একজন ভালো জনপ্রতিনিধি তাদের দরকার।

সাঁথিয়ার রাজনীতি এখনো আবর্তিত হচ্ছে যতটা না জামায়াত ইসলাম নিয়ে তারচেয়ে অনেক বেশি ব্যক্তি মতিউর রহমান নিজামী নিয়ে।

এই ব্যক্তির ফাঁসি কার্যকর হয়েছে দুই বছরের বেশি সময় আগে, পরিবারের প্রত্যেক সদস্য থাকেন বাংলাদেশের বাইরে। কিন্তু মৃত মি. নিজামী এবং তার পরিবারকেন্দ্রিক মানুষের সহানুভূতি এবং সমর্থন যে এখনো আছে সেটা আমি অনেক মানুষের সাথে কথা বলে বোঝার চেষ্টা করেছি।

সালাউদ্দিন ইকবাল এই আসনের বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলছিলেন, ঐক্যফ্রন্ট এবং ২০ দলীয় জোট সব এখন ঐক্যবদ্ধ।

তিনি বলছিলেন, ‘২০ দলের মধ্যে জামায়াতে ইসলাম রয়েছে। বেড়া, সাঁথিয়াতে বিএনপি এবং জামায়াত এখানে ঐক্যবদ্ধ।’

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে এই আসনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে আবু সাইয়িদ দাঁড়িয়েছেন, তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের তথ্য প্রতিমন্ত্রী ছিলেন একসময়।

দলবদল করে এখন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়েছেন। এলাকায় মতিউর রহমানের সমর্থকদের একটা তির্যক মনোভাব রয়েছে মি. সাইয়িদের প্রতি। তারা মনে করেন মি. নিজামীর ফাঁসি হওয়ার পিছনে তার ভূমিকা ছিল প্রত্যক্ষ।

সালাউদ্দিন ইকবাল বলছিলেন, ‘এখানে প্রতীকই প্রধান বিষয়। এই প্রতীক দিয়ে আমরা একটা প্রতিযোগিতা পূর্ণ নির্বাচনে যেতে পারবো।’

জামায়াতে ইসলাম একসময় বিএনপি জোটের বড় একটা ভোট ব্যাংক ছিল।

দলটির অধিকাংশ নেতা যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত হয় এবং বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধন বাতিল করে।

এখন দলটির আইন অনুযায়ী কোনো অস্তিত্ব নেই। কিন্তু বিএনপির হয়ে যে কেউ এই নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন।

মো: শাহজাহান আলী। স্থানীয়ভাবে তিনি নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি বলছিলেন, ‘এখানে মতিউর রহমানের নিজামীর প্রতি একটা সিমপ্যাথি ভোট আছে এটা ঠিক। আবার সাইয়িদ সাহেব দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেছেন এখন ধানের শীষে ভোট করছেন সেটা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে।’

তিনি বলছিলেন, ‘অতীতের নির্বাচনগুলো দেখে মনে হয়েছে এবারে প্রতিটা মানুষ একটা সুষ্ঠু ভোটের কথা বলছে। তাদের মনে কী আছে সেটা পরিষ্কার করে বলে না। মানুষ মুখ খোলে না। তারা চাই নিরপেক্ষ ব্যবস্থাপনায় সুষ্ঠু নির্বাচন।’

এই আসনের অপর প্রার্থীরা হলেন:

প্রার্থী - দল - প্রতীক

নাজিবুর রহমান - স্বতন্ত্র - আপেল

সরদার শাহজাহান - জাতীয় পার্টি - লাঙ্গল

আব্দুল মতিন- ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ - হাতপাখা

শাখা্ওয়াত হোসেন - এনপিটি - আম

শরিফুল ইসলাম - তরিকত ফেডারেশন - ফুলের মালা

মো: জুলহাস নাইন - বাংলাদেশ ওয়াকার্স পার্টি - কোদাল


আরো সংবাদ



premium cement