২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা হ্রাস

হতাশার সাথে আশাও বিদ্যমান

-

টানা ১৪ বছর ধরে বিশ্বে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা কমছে। বিশ্বজুড়ে মার খাচ্ছে গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদ। এমন পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশও বাদ পড়েনি। এখানেও কয়েক বছর ধরে সঙ্কুচিত হচ্ছে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা। অবস্থা এমন যে, যে পাকিস্তানের অগণতান্ত্রিক আচরণের কারণে আমরা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছি, সেই দেশটির চেয়েও আমাদের অবস্থান এক পয়েন্ট নিচে নেমে গেছে। অনলাইনে মতপ্রকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিতে বাংলাদেশের সরকার বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউজের বার্ষিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। ‘গণতন্ত্রের সংগ্রাম নেতৃত্বহীন’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে গত বুধবার।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১০০ পয়েন্টের মধ্যে এবার ২ পয়েন্ট কমে বাংলাদেশের স্কোর ৩৯। অর্থাৎ, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা এখন ‘আংশিক মুক্ত’ দেশের কাতারে। ২০১৯ সালে স্কোর ছিল ৪১। ২০১৮ সালে ৪৫ এবং ২০১৭ সালে ৪৭। ওই তিন বছরও বাংলাদেশ ‘আংশিক মুক্ত’ দেশের কাতারে ছিল। ১৯৫টি দেশ ও ১৫টি অঞ্চলের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারÑ দুই বিষয় বিবেচনায় নিয়ে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার স্কোর নির্ণয় করা হয়েছে। দেশ ও অঞ্চলগুলোকে তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছেÑ মুক্ত, আংশিক মুক্ত, মুক্ত নয়। একনায়করা গণতান্ত্রিক ভিন্নমত দমন করছেন এবং নিজেদের ক্ষতিকর প্রভাব বিশ্বের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে দিচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মতো বড় গণতন্ত্রের দেশগুলোর নির্বাচিত নেতারা প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষা ভেঙে ফেলতে চাইছেন। লোকরঞ্জনবাদী কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তারা সমালোচক ও সংখ্যালঘুদের অধিকার উপেক্ষা করছেন। ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে ৬৪টি দেশে রাজনৈতিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে।
অনেক দেশে গণতন্ত্রের নামে যা চর্চা হচ্ছে, দৃশ্যত তা গণতান্ত্রিক মনে হলেও আদৌ গণতান্ত্রিক কি না, সে প্রশ্ন এখন প্রধান হয়ে উঠছে। কেননা, যখন বিভিন্ন দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসনের লক্ষণ সুস্পষ্ট, এমনকি স্বৈরাচারী শাসকরাও নিজেদের গণতন্ত্রের রক্ষাকর্তা দাবি করছেন। বিশ্বে যারা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন, তারা দক্ষিণপন্থী জনতুষ্টিবাদী রাজনীতিবিদ। এক গবেষণা মতে, যেসব দেশে গণতন্ত্রের সূচকে অবনতি ঘটেছে, তার ১৭টিতেই এ ধরনের জনতুষ্টিবাদীরা ক্ষমতায়। তাদের গাত্রবর্ণ, জেন্ডার, ধর্ম ভিন্ন হলেও শত্রু ‘তৈরি’তে তারা সিদ্ধহস্ত। কারো জন্য কথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ তৈরি করেছে যৌক্তিকতা, আর কারো ‘উন্নয়ন’ মন্ত্র। ফলে পৃথিবীর কোথাও এমন কোনো দর্শনীয় মুহূর্ত বের করা যাবে না, যখন আনুষ্ঠানিকভাবে গণতন্ত্রের অবসান হয়েছে। গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটছে গণতন্ত্রের এক অনিবার্য প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, সেই অনিবার্য প্রক্রিয়ার নাম নির্বাচন। এই ১৪ বছর ধরে অব্যাহতভাবে গণতন্ত্রের সঙ্কট চললেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার। গত চার বছরে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার এই সূচকে পতন ঘটেছে।
আর গত এক দশকে বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রবণতা মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে। ফ্রিডম হাউজের আরেক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গণতন্ত্রের পথ থেকে যেসব দেশ সরে যাচ্ছে, এগুলো সাইবার স্পেস নিয়ন্ত্রণে চীনকে অনুসরণ করছে। গণতন্ত্রের ভাঙন কেবল প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই হয় না, এর একটি সামাজিক পটভূমি থাকে। এটি চিহ্নিত হয়েছে ‘বিষাক্ত মেরুকরণ’ বলে। এ প্রবণতা ক্রমবর্ধমান। এই প্রক্রিয়ায় সমাজে সহমর্মিতা ও সহনশীলতা ক্রমাগতভাবে কমে আসে, ব্যক্তি হয়ে পড়ে বিচ্ছিন্ন, একের সাথে অন্যের ইতিবাচক সংহতির বন্ধন কমে যায়। রাজনীতির ব্যাপারে তৈরি হয় অনাগ্রহ। সমাজের মানুষের মধ্যকার পার্থক্যগুলো বড় করে তোলা হয়। এর পরও দেশে দেশে স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক সরকারগুলোর রাজনৈতিক নিপীড়ন বেড়ে যাওয়া এবং ভয়ভীতি ছড়ানো সত্ত্বেও নাগরি কেরা ন্যায়বিচারের দাবিতে এবং অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিভিন্নভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। এটি কেবল আশার বিষয় নয়, একই সাথে ইঙ্গিত দিচ্ছে, এখনো মানুষের মধ্যে গণতন্ত্রের আকাক্সক্ষা বহাল আছে। আদর্শ হিসেবে এখনো গণতন্ত্রের আপাতত কোনো বিকল্প নেই।


আরো সংবাদ



premium cement