২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রড-সিমেন্টের মূল্যবৃদ্ধিতে নির্মাণশিল্পে বিরূপ প্রভাব

রড-সিমেন্টের মূল্যবৃদ্ধিতে নির্মাণশিল্পে বিরূপ প্রভাব - ছবি : সংগৃহীত

বাজেটের প্রভাবে রড-সিমেন্টের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। গত এক মাসে রডের দাম বেড়েছে টনপ্রতি তিন থেকে ছয় হাজার টাকা। সংশ্লিষ্ট খাতের উদ্যোক্তাদের দাবি, বাজেটের কারণে রডের দাম টনপ্রতি ১১ হাজার টাকা বাড়ার কথা। কিন্তু সামগ্রিকভাবে শিল্পের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে তারা এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। বাজেটের কারণে প্রতি ব্যাগ সিমেন্টের উৎপাদন খরচ ৪২ টাকা বেড়েছে জানিয়ে ইতোমধ্যেই ব্যাগপ্রতি দাম ৩৫ থেকে ৪৫ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছেন উদ্যোক্তারা। খুচরা বিক্রেতাদের দাবি, রড-সিমেন্টের দাম খুব শিগগির আরো বাড়বে। এতে করে সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি পুরো নির্মাণশিল্পে অস্থিরতা তৈরি হবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

গতকাল রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এবং সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এক মাস আগে ৬০ গ্রেডের যে রড ৬২ থেকে ৬৩ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছিল যে রড গতকাল বিক্রি হয় ৬৭ থেকে ৬৮ হাজার টাকায়। কোনো কোনো দোকানে ৭০ হাজার টাকা টন দরে রড বিক্রি করতে দেখা যায়। ৪০ গ্রেডের যে রড এতদিন ৫৫ থেকে ৫৬ হাজার টাকায় বিক্রি হতো সে রড গতকাল বিক্রি হয় ৫৮ থেকে ৬০ হাজার টাকা টন দরে। খুচরা বিক্রেতাদের দাবি, কোম্পানিগুলো ইচ্ছেমতো দাম নিচ্ছে। তার পরও চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করছে না। ফলে বাজারে এক ধরনের সঙ্কট বিরাজ করছে। সঙ্কটের সুবাদে যে যার মতো করে দাম আদায় করছেন বলে জানান ক্রেতা-বিক্রেতারা। একই অবস্থা সিমেন্টের ক্ষেত্রেও। খুচরা দোকানে এক মাস আগে যে সিমেন্ট ৪৩০ থেকে ৪৫০ টাকা বস্তা দরে বিক্রি হয়েছিল সে সিমেন্টই এখন বিক্রি হচ্ছে ৪৬০ থেকে ৪৮০ টাকা দরে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে রডের কাঁচামাল স্ক্র্যাপ বিক্রয়ের ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। গত অর্থবছরে এ হার ছিল নির্ধারিত ৩০০ টাকা। স্ক্র্যাপ আমদানিপর্যায়ে এবার ৫ শতাংশ হারে অগ্রিম কর আরোপ। এছাড়া বাজেটে বিলেট বিক্রয়ে প্রতি টনে ৪৫০ টাকার পরিবর্তে ২ হাজার টাকা, উৎপাদন পর্যায়ে প্রতি টন রডে ৪৫০ টাকার পরিবর্তে ২ হাজার টাকা এবং খুচরাপর্যায়ে রড বিক্রিতে প্রতি টনে ২০০ টাকার পরিবর্তে ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) হিসেব অনুযায়ী বাজেটে বিভিন্নপর্যায়ে ভ্যাটের হার বাড়ানোর কারণে রডে টনপ্রতি ৭ হাজার ৬৫০ টাকা খরচ বেড়েছে। আর তিনটি পর্যায়ে নতুন করে অগ্রিম আয়কর আরোপ করায় বেড়েছে অতিরিক্ত ৩ হাজার ২৭৫ টাকা। অর্থাৎ বাজেটের কারণে প্রতি টন রডের বিক্রয়মূল্য ১০ হাজার ৯২৫ টাকা বাড়াতে হবে।

এ প্রসঙ্গে আলাপকালে বিএসএমএর চেয়ারম্যান মানোয়ার হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, বাজেটে যে হারে শুল্ক-কর বেড়েছে তাতে প্রতি টন রডের দাম ১০ হাজার ৯২৫ টাকা বাড়াতে হয়। কিন্তু ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা এবং বাজারে চাহিদা কমে যাওয়ার কথা বিবেচনায় এনে মিলমালিকরা এখনো চূড়ান্তভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। কারণ তখন পুরো বাজারেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে। বিচ্ছিন্নভাবে যে দাম বেড়েছে সেটি বিভিন্ন কোম্পানির নিজস্ব সিদ্ধান্ত। তিনি বলেন, রডের দাম বাড়লে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সরকারের অবকাঠামো নির্মাণ খরচও বৃদ্ধি পাবে। তাতে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে যাবে।
এদিকে এবারের বাজেটে সিমেন্ট খাতের কাঁচামাল আমদানিতে ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি) আরোপ করা হয়েছে। এছাড়া গত অর্থবছরে যে ৩ শতাংশ উৎসে কর আদায় করে সমন্বয়পূর্বক পুনরায় ফেরত দেয়ার বিধান ছিল এবার তা তুলে দেয়া হয়েছে। ওই তিন শতাংশ বর্তমানে চূড়ান্ত করদায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এ কারণে এবারের বাজেট সিমেন্ট খাতের জন্য ব্যবসাবান্ধব নয় দাবি করে সংশ্লিষ্ট খাতের উদ্যোক্তারা বলেছেন, বাজেটের কারণে প্রতি ব্যাগ সিমেন্টের দাম বাড়ছে ৪২ টাকা। এ অর্থ ক্রেতাদের কাছ থেকে আদায় করতে গেলে পুরো শিল্প খাতে অস্থিরতা তৈরি হবে বলে আশঙ্কা বাংলাদেশ সিমেন্ট প্রস্তুতকারক সমিতির (বিসিএমএ)।
আলোচনা প্রসঙ্গে বিসিএমএ সভাপতি আলমগীর কবির বলেন, দেশের সিমেন্ট শিল্প বর্তমানে স্বয়ংসম্পন্ন। মোট ৪২টি কারখানা স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে সিমেন্ট রফতানিও করছে। প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে তিলে তিলে গড়ে উঠেছে সম্ভাবনাময় এ শিল্প। কর্মসংস্থান হয়েছে কয়েক লাখ মানুষের। বাজেটের কারণে সবই এখন হুমকির মুখে। স্থানীয় শিল্পের চলতি মূলধনে নেতিবাচক পভাব ফেলবে। আশঙ্কা দেখা দিয়েছে পুরো শিল্পখাত রুগ্ণ হয়ে পড়ার। অতিরিক্ত শুল্ক-করের কারণে চাপে পড়বে মধ্যবিত্ত, ব্যাহত হবে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর দাবি করে তিনি বলেন, বাজেটের কারণে বিক্রয় ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৫৫ শতাংশ মোট মুনাফা করতে হবে, যা কিছুতেই সম্ভব নয়। মূল্য নির্ধারণ বাজার সহায়ক না হলে উৎপাদন এবং বিক্রি এবং শিল্পের স্থিতিশীলতা কমে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

সরকারের পদ্মা সেতু, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ পকল্পসহ আবাসন খাতের সব প্রকল্পে দেশের উৎপাদিত রড-সিমেন্ট সরবরাহ করা হচ্ছে। রড-সিমেন্টের দাম বাড়লে এসব বড় পকল্পের ব্যয়ও বাড়বে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। তারা জানান, ভ্যাট-ট্যাক্সের কারণে টনপ্রতি রডের দাম ১১ হাজার টাকা বাড়লে কেউই বাড়ি নির্মাণে উৎসাহিত হবেন না। তখন বালু, ইট, তারকাঁটার মতো ছোট খাতগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বর্ধিত ভ্যাট-ট্যাক্সের কারণে হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে গড়ে ওঠা স্টিল মিল বন্ধ হয়ে যাবে। মালিকরা ঋণখেলাপিতে পরিণত হবেন। তাই শিল্পের স্বার্থে ভ্যাট-ট্যাক্স সহনীয়পর্যায়ে রাখা উচিত। 
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি আবাসন খাতের সংগঠন রিহ্যাবের সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন এ প্রসঙ্গে বলেন, এবারের বাজেটে সরকার আবাসন খাতের দিকে সুনজর দিয়েছে, এজন্য প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানাই। তবে আবাসন খাতের মূল উপকরণ রড, সিমেন্টের ওপর কর আরোপের কারণে ফ্ল্যাটের নির্মাণ ব্যয় বেড়ে যাবে। এ কারণে সরকার আবাসন খাতকে চাঙ্গা করতে যে সুবিধা দিয়েছে, সেটা কাজে আসবে না বলে আমাদের আশঙ্কা।


আরো সংবাদ



premium cement