বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়ে যারা ভাবেন, তারা জানেন, সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল। খুব দ্রুতই ঘুরছিল ঘড়ির কাঁটা। গ্যাসের যে মওজুদ, তা পুরোপুরি শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ২০৩০ সাল নাগাদ।
"গ্যাসের রিজার্ভ তো আর এভাবে হঠাৎ শেষ হয়ে যায় না। একটা স্টেজে এসে ড্রপ করতে থাকে। যে হারে গ্যাসের রিজার্ভ কমছে তাতে ২০২০ বা ২০২১ সাল থেকে দ্রুত কমে যাবে। আর ২০৩০ সাল নাগাদ একেবারেই ফুরিয়ে যাবে যদি না নতুন গ্যাস রিজার্ভ খুঁজে পাওয়া যায়", বলছিলেন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী খন্দকার আবদুস সালেক, যিনি কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন।
যে দেশে বড় বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সার কারখানা থেকে শুরু করে ছোট-বড় শিল্প এমনকি গৃহস্থালী পর্যন্ত গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল, সেখানে ভবিষ্যতের এই সংকটের চেহারাটা কী হবে, তার ইঙ্গিত বাংলাদেশিরা ইতোমধ্যেই পেতে শুরু করেছে।
চট্টগ্রাম অঞ্চলের গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর খায়েজ আহমেদ মজুমদারের ভাষায়, "চট্টগ্রাম হচ্ছে বাংলাদেশের গ্যাস গ্রিড লাইনের শেষ প্রান্তে। এখানে আবাসিক , বাণিজ্যিক বা শিল্প, সব ধরণের গ্রাহকরাই গ্যাসের সংকটে ভুগছিলেন। এতদিন আমরা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস দিলে সার কারখানায় গ্যাস দিতে পারতাম না। সার কারখানাকে দিলে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে দিতে পারতাম না। অবস্থা ছিল গুরুতর।"
তবে গত ১৮ আগষ্ট, দুপুর আড়াইটা নাগাদ বাংলাদেশ হয়তো এই ঘড়ির কাঁটাকে কিছুটা পিছিয়ে দিতে পেরেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথমবারের মতো সেদিন গ্যাস গ্রিড লাইনে যুক্ত হয়েছে আমদানি করা এলএনজি বা 'লিকুইডিফায়েড ন্যাচারাল গ্যাস'।
মহেশখালির কাছে বঙ্গোপসাগরে বিশাল যে জাহাজটি ভেসে আছে সেটির আক্ষরিক নাম হচ্ছে 'ফ্লোটিং স্টোরেজ এন্ড রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট'(এফএসআরইউ)।
বিশাল এই জাহাজ-কাম-টার্মিনালটি কাতার থেকে নিয়ে এসেছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি। সেই তরল জ্বালানিকে আবার গ্যাসে রূপান্তরিত করে এটি ৯০ কিলোমিটার পাইপ লাইন দিয়ে তা পাঠাচ্ছে চট্টগ্রামে। সেখান থেকে এটি যুক্ত হচ্ছে চট্টগ্রামের 'রিং মেইনে' বা প্রধান গ্যাস পাইপ লাইনে। কিছুদিন পরে কর্ণফুলীর নিচ দিয়ে এই গ্যাস যুক্ত হবে জাতীয় গ্যাস গ্রিডে।
এই ভাসমান টার্মিনালটি মহেশখালিতে এসে পৌঁছায় গত এপ্রিলে। এটি চালু হওয়ার কথা ছিল গত মে মাসে। কিন্তু নানা কারিগরি অসুবিধার কারণে বার বার কাজ শুরুর তারিখ পিছিয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত ১৮ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে এটি চালু করা গেছে।
জ্বালানির জন্য গ্যাসের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা প্রায় ৭০ শতাংশ। "এখন থেকে বাংলাদেশকে গ্যাসের চাহিদা মেটাতে আরও বেশি করে এই এলএনজির ওপরই নির্ভর করতে হবে", বলছেন বাংলাদেশ গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানির সাবেক পরিচালক খন্দকার আবদুস সালেক।
মিস্টার সালেক এখন অস্ট্রেলিয়ায় জ্বালানি খাতের একজন পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন। বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত 'এনার্জি এন্ড পাওয়ার' ম্যাগাজিনের কনট্রিবিউটিং এডিটর তিনি।
"বাংলাদেশে এখন প্রতিদিন এক হাজার মিলিয়ন কিউবিক ফুট গ্যাসের ঘাটতি আছে। সামনে এটা আরো বাড়বে। সরকারের পরিকল্পনা হচ্ছে ২০২৫ সাল নাগাদ সাড়ে তিন হাজার মিলিয়ন কিউবিক ফুট গ্যাসের চাহিদা এলএনজি আমদানির মাধ্যমে মেটানো।"
সেই লক্ষ্যে প্রথম যে 'ফ্লোটিং স্টোরেজ এন্ড রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট' মহেশখালিতে চালু হয়েছে সেটির ক্ষমতা ৫ শ' মিলিয়ন কিউবিক ফুট।
সেখানেই বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের সামিট গ্রুপের উদ্যোগে তৈরি হচ্ছে একই ধরণের আরেকটি টার্মিনাল। সামিট গ্রুপের টার্মিনালটি চালু হওয়ার কথা ২০১৯ সালে।
এর বাইরে ভারতে ওএনজিসি এবং একটি চীনা কোম্পানি আরও দুটি টার্মিনালের কাজ করছে।
সব মিলিয়ে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে আমদানি করা এলএনজি হতে চলেছে বাংলাদেশে গ্যাসের অন্যতম উৎস।
এলএনজি কতটা নির্ভরযোগ্য
কিন্তু আমদানি করা এলএনজি দিয়ে কি বাংলাদেশের মতো একটি দেশের জ্বালানি চাহিদা মেটানো সম্ভব?
খন্দকার আবদুস সালেক মনে করেন, এশিয়ার আরো অনেক দেশের মতো বাংলাদেশকেও এই পথে যেতে হবে।
"জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান সহ এশিয়ার অনেক দেশই কিন্তু জ্বালানি চাহিদা মেটাতে এলএনজির ওপর নির্ভর করে। ৬০ শতাংশ, ৭০ শতাংশ পর্যন্ত তারা এলএনজি থেকে মেটাচ্ছে। বাংলাদেশকেও তাই করতে হবে।"
কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর খায়েজ আহমেদ মজুমদারও সেটাই মনে করেন।
"নতুন গ্যাস অনুসন্ধান করে পাওয়া যাবে কি যাবে না, সেটা তো নিশ্চিত নয়। আর আমাদের চাহিদা বাড়ছে দিনে দিনে। কাজেই ভবিষ্যতে আরও বেশি করে এলএনজি আনতে হবে বলেই আমার মনে হয়।"
এলএনজি মূলত তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস। মাইনাস ১৬০ ডিগ্রিতে এটি ঠান্ডা করে কমপ্রেস করা হয়। এরপর এটিকে বড় বড় জাহাজে করে বহন করে এনে আবার গ্যাসে রূপান্তরিত করা হয়।
কিন্তু বাংলাদেশের সমূদ্র উপকূলের নাব্যতা যেহেতু কম, তাই বড় বড় জাহাজে করে এই এলএনজি সরাসরি বন্দরে নামানো যায় না। সেজন্যেই দরকার হচ্ছে গভীর সমুদ্রে ভাসমান ফ্লোটিং টার্মিনাল।
খন্দকার আবদুস সালেক বলেন, বাংলাদেশে গ্যাসের যে তীব্র সঙ্কট, সেখানে এলএনজি টার্মিনালগুলো ঘাটতি পূরণে অনেক সহায়ক হবে।
"চট্টগ্রামেই প্রায় পাঁচ শ' মিলিয়ন কিউবিক ফুট গ্যাস দরকার। সেখানে ঘাটতিই ছিল প্রায় তিন শ' মিলিয়ন কিউবিক ফুট। আগামী কয়েক মাসেই এই ঘাটতির বেশিরভাগ পূরণ করা যাবে এলএনজি থেকে আসা সরবরাহ দিয়ে।"
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা