২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে যা বলছে ‘ব্রিটিশ পার্লামেন্ট’

-

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ‘হাউজ অব কমন্স লাইব্রেরি’র তৈরি করা বাংলাদেশ বিষয়ে হালনাগাদ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে এখনো সংশয় আছে, এখানকার অবস্থা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থেকে এখনো অনেক দূরে। ‘বাংলাদেশ : নভেম্বর ২০১৮ আপডেট’ শীর্ষক এ গবেষণা প্রতিবেদন বৃহস্পতিবার ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। এতে বাংলাদেশের নির্বাচন ও চলমান পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে। 

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রাজনীতি সব সময়ই উত্তেজনাকর। বছর শেষের দিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে সেই উত্তেজনার পারদ ততই তুঙ্গে উঠছে। এখানে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড এখনো সমসুবিধা সৃষ্টি হওয়া থেকে পরিবেশ অনেক দূরে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ নির্বাচনে পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক মিশন পাঠাচ্ছে না। যুক্তি দেয়া হয় যে, নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে যে সংশয় আছে এতে তারই প্রকাশ ঘটছে। এ ছাড়া কমনওয়েলথ এখনো পরিষ্কার করেনি, তারা নির্বাচনে পর্যবেক মিশন পাঠাবে কি না।

এতে বলা হয়েছে, বিএনপির দীর্ঘ দিনের দাবি বা পূর্বশর্ত হলো দলটির প্রধান খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে মুক্তি দিতে হবে, যাতে তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। এ ছাড়া আরেকটি দাবি ছিল নির্বাচন তদারকির জন্য একটি নিরপে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা। কিন্তু এসব দাবি আদায়ে সম না হলেও বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওই রিপোর্টে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের ইস্যুও তুলে ধরা হয়। বলা হয়, নভেম্বরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সরকারের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু জাতিসঙ্ঘ ও পশ্চিমাদের চাপে সেই প্রক্রিয়া থমকে আছে। বাংলাদেশ বারবার বলেছে, তারা জোর করে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাবে না। নতুন বছর না আসা পর্যন্ত নতুন করে প্রত্যাবর্তন শুরু নাও হতে পারে।

বাড়ছে রাজনৈতিক উত্তেজনা

এ পরিস্থিতিতে সমালোচকরা বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত। চিন্তার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে মিথ্যা মামলা, আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুম। সম্প্রতি কয়েক বছরের মধ্যে তুলনামূলক কম হলেও জঙ্গি হামলার ঝুঁকি যথেষ্ট রয়ে গেছে। অক্টোবরের শেষ দিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের করা আপিলের ভিত্তিতে খালেদা জিয়ার কারাদণ্ডের মেয়াদ বৃদ্ধি করে ৫ বছর থেকে ১০ বছর করার রায় দেন আদালত। কিছু দিন আগে তাকে আরো একটি দুর্নীতি মামলায় অভিযুক্ত করা হয় এবং এতে তার ৭ বছরের সাজা হয়েছে। স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণে অক্টোবরে তাকে কারাগারের বাইরে চিকিৎসা সুবিধার অনুমোদন দিলে অনেকেই আশা করেছিলেন যে, তাকে হয়তো মুক্তি দেয়া হতে পারে। কিন্তু নভেম্বরে আবার তাকে কারাগারে ফেরত পাঠালে এ আশা চূর্ণ হয়ে যায়।

গত ২৮ নভেম্বর সর্বোচ্চ আদালত রায় দেন যে, বিচারিক আদালতে কারো বিরুদ্ধে দুই বছরের বেশি সাজা বা দণ্ড হলে সেই দণ্ড বা সাজার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল বিচারাধীন থাকাবস্থায় নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না।

যতক্ষণ না আপিল বিভাগ ওই রায় বাতিল, খালাস বা দণ্ড স্থগিত করে জামিন না দেন ততক্ষণ অবস্থার পরিবর্তন হবে না। এর মাধ্যমে খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশ নেয়ার সর্বশেষ সম্ভাবনাটিও নিভে গেছে। একই সাথে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা দায়ের করা হচ্ছে। এর আগে অক্টোবরে বিএনপি জানিয়েছিল, আগামী নির্বাচনে তারা অংশ নেবে না। পরিবর্তে তারা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানায়। পর্যবেকদের অবাক করে দিয়ে অক্টোবরের শেষে এসে মতাসীন দল আওয়ামী লীগ বিরোধী দলগুলোর সাথে সংলাপে বসতে সম্মত হয়। এরপর ১১ নভেম্বর বিএনপি জানায় যে, তারা নির্বাচনে অংশ নেবে। বিএনপি নির্বাচন কমিশনের কাছে নির্বাচনের সময় এক মাস পিছিয়ে দেয়ার জন্য আবেদন জানায়। নির্বাচন কমিশন এক সপ্তাহ পিছিয়ে দিতে সম্মত হয়।

বিএনপি দাবি করেছে, নভেম্বর মাসে তাদের শত শত নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গত সপ্তাহে দলটির প্রধান কার্যালয়ের ইন্টারনেট সংযোগ কেটে দেয়া হয়। অন্য দিকে আওয়ামী লীগ সরকার আন্দোলনের সময় পুলিশের ওপর হামলার জন্য বিএনপি সমর্থকদের দায়ী করেছে।

নির্বাচনে প্রত্যাশা

২০০৮ সালের পর বিএনপি আর জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়নি। অনেকে যুক্তি দেখান যে, এবারের নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের অর্থ হলো নির্বাচন তুলনামূলক অধিক গ্রহণযোগ্য হবে। যদিও অনেক পর্যবেকই তেমনটি প্রত্যাশা করেন না। তাদের মতে, ‘প্লেয়িং ফিল্ড’ এখনো সমতা থেকে অনেক দূরে। এখনো বিরোধীরা প্রশাসনের হাতে ব্যাপকভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। আর মতাসীন আওয়ামী লীগ সব জায়গায় দায়মুক্তির সুবিধা ভোগ করছে। নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা নিয়েও দীর্ঘ দিনের উদ্বেগ রয়েছে। এবার জাতীয় নির্বাচনে প্রথমবারের মতো ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের ব্যবহার করা হচ্ছে। বিএনপি এর বিরোধিতা করেছে। এতে নির্বাচনী কার্যক্রমের ওপর দলটির আস্থা কমে গেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এ অনাস্থা নির্বাচনী প্রচারণার সময় বা ফল ঘোষণার পর সহিংসতা ও অস্থিরতা উসকে দিতে পারে।

এবারের নির্বাচনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক দল পাঠাবে না। এর পরিবর্তে তারা দুই সদস্যের ‘এক্সপার্ট মিশন’ পাঠাচ্ছে। অনেকে এ যুক্তিও দিচ্ছেন যে, নির্বাচনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক দল না পাঠানোর সিদ্ধান্তে এবারের নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সংশয় ফুটে উঠেছে। পর্যবেক পাঠানোর বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি কমনওয়েলথ।

নির্বাচনের আগে আইনজীবী ড. কামাল হোসেনের নেতত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে বিএনপি তাদের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমর্যাদা আরো উজ্জ্বল করে তুলেছে। আর আওয়ামী লীগ ১৪ দলীয় জোটের নেতৃত্বে রয়েছে। কিন্তু কট্টরভাবে ধর্মনিরপেক্ষ এ দলটি সম্প্রতি কিছু রক্ষণশীল ইসলামি দলের সাথে সম্পর্ক জোরদার করেছে। বিশেষ করে হেফাজতে ইসলামের সাথে।

প্রধান দুই দলেরই দাবি, তারা নির্বাচনী প্রচারণায় অর্থনৈতিক ইস্যুর ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে চান। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ দেশের উন্নয়ন ও সামাজিক অগ্রগতির কথা তুলে ধরবে। বিপরীতে বিএনপি যুক্তি দেখাবে যে, বেপরোয়া দুঃশাসন ও শেখ হাসিনার ছত্রছায়ায় প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি দেশকে আরো পেছনে নিয়ে গেছে। ব্রিটিশ বিশ্লেষক মুশতাক খান সতর্ক করে বলেছেন, ২০০৮ সালের পর থেকে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক আবহ তৈরি হয়েছে, এমন পরিস্থিতিতে যদি আওয়ামী লীগ আবারো জয়লাভ করে তা একদলীয় শাসনকে সুরতি করবে। একই সাথে দেশ রাজনৈতিক কর্তৃত্ববাদের দিকে এগিয়ে যাবে।
অন্যান্য পরিস্থিতি : এ বছর আওয়ামী লীগ সরকার দেশে মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়েছে। গত মে মাস থেকে পুলিশকে শ্যুট অ্যাট সাইট (সন্দেহভাজন মাদক ব্যবসায়ীদের দেখামাত্র গুলি করার অনুমতি) অর্ডার দেয়া হয়েছে। তবে সমালোচকদের দাবি, এ অভিযান মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক বিচারবহির্ভত হত্যাকে উসকে দিয়েছে।

জুনে তৎকালীন জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কমিশনার জায়েদ রা’দ আল হোসেন বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। অনেকে বাংলাদেশে মাদকবিরোধী অভিযানকে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতের্তের বিতর্কিত মাদক-যুদ্ধের সাথে তুলনা করেছেন। গত কয়েক বছরে দেশে উগ্রপন্থী জিহাদিদের হুমকি কমে গেছে। নিরাপত্তা বাহিনীর সম্মিলিত সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। তবে জঙ্গি হুমকি একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। মাঝে মধ্যে এখনো জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে।

জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ সরকার খসড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল অনুমোদন করে। সেপ্টেম্বরে তা পার্লামেন্টের অনুমোদন পেয়ে চূড়ান্তভাবে আইনে পরিণত হয়। এরই মধ্যে সরকার গুজব শনাক্ত ও প্রতিরোধ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে; যার কাজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর নজরদারি করা। মানবাধিকার সংগঠনগুলো সতর্ক করে বলেছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারাগুলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। এ ছাড়া হাউজ অব কমন্সের ব্রিফিংয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিার্থীদের আন্দোলন, শহিদুল আলমের গ্রেফতার ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনটিতে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের দেয়া বিবৃতিগুলোও তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে ব্রিটিশ সরকার বেশ কয়েকবার স্পষ্ট করে জানিয়েছে, তারা বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু ও নিরপে নির্বাচন দেখতে চায়। একই সাথে বাংলাদেশ সরকার ও বিরোধী দলগুলোর প্রতিও আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে পৌঁছানোর আহ্বান জানানো হয়েছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement