০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`


চলে গেলেন সত্তর দশকের কবি শেখ তোফাজ্জল হোসেন

-

খুব নীরবে নিভৃতে না-ফেরার দেশে চলে গেলেন সত্তর দশকের অন্যতম প্রধান কবি শেখ তোফাজ্জল হোসেন। গত রোববার ২ ফেব্রুয়ারি আমিন বাজারের নিজ বাসভবনে তিসি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তোফাজ্জল হোসেন ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। কবি, ছড়াকার, সাহিত্য সংগঠক, সাহিত্য সম্পাদক, কলামিস্ট, চিত্রশিল্পী, কার্টুনিস্ট, উপস্থাপক, রেডিওর খবর পাঠক, ঘোষক প্রভৃতি অনেক। শিল্পী হিসেবে তিনি অসংখ্য বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন, ইলাশট্রেশন করেছেন। ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধাও।
তবে তার সবচেয়ে বড় পরিচয় ছিল তিনি একজন কবি এবং আমার জানা মতে, কবি হিসেবে পরিচিতি লাভের দিকেই তার ঝোঁক ছিল বেশি। কিন্তু তিনি ছিলেন খুবই প্রচারবিমুখ।
একবার দৈনিক বাংলার সাহিত্য পাতায় আহসান হাবীবের সম্পাদনায় তার একটি কবিতা খুব গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়েছিল। তিনি খুবই খুশি হন এতে। এত খুশি হতে আমি তাঁকে আর কোনোদিন দেখিনি। কবিতাটি ছিল দেশপ্রেমমূলক। শিরোনাম ছিল সম্ভবত বোধের উৎস তুমি।
তার সাগরেদদের মধ্যে অনেকে অনেক পুরস্কার লাভ করলেও তাকে কখনো পদ ও পদকের পেছনে ছুটতে দেখা যায়নি। বরং যারা পদ-পদবির পেছনে ছোটেন, তিনি তাদের নিয়ে অনেক সময়ই অনেক ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করেছেন। হয়তো এ জন্যই তার কপালে জাতীয় কোনো পুরস্কার বা পদক জোটেনি। জনগণের মাঝে তার নামও প্রচারিত হয়নি।
অথচ তিনি সেই পাকিস্তান আমল থেকেই বিখ্যাত একজন মানুষ। পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে কার্টুন এঁকে জেল খেটেছেন বছরখানেক জাতীয় নেতাদের সাথে। সেখানে অনেক জাতীয় নেতার সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে, যেমনÑ শেখ মুজিবুর রহমান, মনি সিং।
সত্তর-আশির দশকে ঢাকা শহরে নামকরা যে কটি সাহিত্য সংগঠন ছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল অনুশীলন সঙ্ঘ। এই সঙ্ঘের উদ্যোগে প্রতি সপ্তাহে সাহিত্য আসর বসত। যেহেতু তোফাজ্জল ভাই ইসলামিক ফাউন্ডেশনে চাকরি করতেন সেহেতু সাহিত্য আসরটি বসত ইসলামিক ফাউন্ডেশনে তার কক্ষে সাপ্তাহিক বন্ধের দিন। তখন সাপ্তাহিক বন্ধ ছিল রোববার। সেই আসরে ডান-বাম, মধ্যপন্থী-চরমপন্থী সব ঘরানার সাহিত্যমোদির আনাগোনা ছিল।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রকাশনা বিভাগের সাথে জড়িত থাকার কারণে দেশের খ্যাতনামা আলেম ও ইসলামিক স্কলারদের সাথেও ছিল তাঁর ঘনিষ্ঠতা। তার কক্ষে দেখা যেত দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, নাট্যকার আশকার ইবনে শাইখ, মাওলানা আবদুুর রহীম, মাওলানা রেজাউল করীম ইসলামাবাদীর মতো নামী-দামি লোকদের। তখন ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে এসব লেখকদের বই প্রকাশিত হতো নিয়মিত। তার কক্ষ সবসময় সরগরম থাকত নানান শিল্পী, লেখদের আগমনে।
তিনি ছিলেন একেবারেই উদার আর মুক্তমনা। কোনো রকম কুসংস্কার তার মধ্যে দেখা যায়নি। তিনি মূলত আল্লামা আবুল হাশিম ও মাওলানা ভাসানীর উদারমনা ইসলামিক চিন্তা-চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন। একসময় তিনি আবুল হাশিমের সেক্রেটারি হিসেবেও কাজ করেছেন। আবুল হাশিমের সংস্কারমুক্ত মনোভাব আর নিরালম্ব জীবন যাপনের গল্প করতেন আমাদের কাছে। একবার মনে আছে, মওলানা ভাসানী সম্পর্কে আমি একটি বিরূপ মন্তব্য করলে তিনি খুব ব্যথিত হন। বলেন, ‘তোমরা হুজুর সম্পর্কে জানো না বলেই এমন সব উল্টাপাল্টা মন্তব্য করো।’
আমার ভুল সংশোধনের জন্য খন্দকার ইলিয়াস লিখিত ‘ভাসানী যখন ইউরোপে’ নামক বইটি আমাকে পড়তে দেন। বইটি পড়ে সত্যি সত্যি আমার ভুল ভেঙেছিল।
আজকে প্রতিষ্ঠিত অনেক কবি-সাহিত্যিকের লেখালেখিতে হাতেখড়ি হয় তার মাধ্যমে। তিনি ছিলেন অনেকটা মানুষ গড়ার কারিগর। তিনি নিজে যেমন সবসময় সৃজনশীল কাজে ব্যস্ত থাকতেন, তেমনি অন্যদেরও সৃজনশীল কাজে সবসময় উৎসাহিত করতেন। তার পড়াশোনাও ছিল ব্যাপক। সাহিত্যের প্রায় সব শাখায়ই তার আনাগোনা ছিল। ফলে এসব ক্ষেত্রে নিত্যনতুন যেসব বিষয়ের উদ্ভব ঘটছে, সেসব ব্যাপারে তাকে খোঁজখবর রাখতে হতো। শিল্প সাহিত্যের ব্যাপারে নতুন কোনো বই প্রকাশিত হলেই তিনি কিনে আনতেন।
অনুশীলন সঙ্ঘের সাহিত্য আসরে নিয়মিত যাতায়াত ছিল যাদের তাদের মধ্যে রয়েছেনÑ আলী ইমাম, আবু হাসান শাহরিয়ার, সৈয়দ আল ফারুক, লুৎফর রহমান রিটন, আমীরুল ইসলাম, আহমদ মাযহার, আহমদ উল্লাহ, টিপু কিবরিয়া, সিকদার নাজমুল হক, সাইমুম তারেক, নাইমুল ইসলাম খান, নাসির আহমেদ প্রমুখ।
তোফাজ্জল ভাইয়ের কবিতার বইয়ের নাম জলে শরীরে। রফিকউল্লা খান সম্পাদিত তিন দশকের কবিতা সঙ্কলনে তোফাজ্জল ভাইয়ের কবিতা দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। সেখানে তার তিনটি কবিতা স্থান পেয়েছে।
জলে শরীরে শিরোনামের কবিতাটির প্রথম পঙ্ক্তি এ রকমÑ
নিরবধি জলের শরীরে স্রোত ঢেউ খেলা করে/জলে শরীরে শব্দ ঢেউ হয়ে ওঠে/জলের আদরে পদ্ম সৌম্য হয়ে ফোটে/কাহিনী আকাশ থেকে ধ্রুব হয়ে ঝরে।
আকাশ থেকে ঝরে পড়া কাহিনী ধরায়ই তিনি সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতেন। আর সে সব কাহিনী বলা যায় তার কলম ও তুলিতে পদ্ম হয়ে ফুটত।
তোফাজ্জল ভাই জন্মেছিলেন ফরিদপুরে। ১৯৫০ সালে। তবে তার শৈশব কেটেছে ভারতের আসামে। তার বাবার কর্মসূত্রে তার পরিবার আসামে থাকত। তিনি প্রায় সময় আসামে তার শৈশব স্মৃতি নিয়ে গল্প করতেন। এ নিয়ে তিনি একটি স্মৃতিকথাও লিখেছিলেন। তবে সেটা কোথাও প্রকাশিত হয়েছে কি না জানি না। তার বাবার সাথেও আমার একবার তার বাসায় দেখা হয়েছিল।
আমার সাথে তার পরিচয় ঘটে অনুশীলন সঙ্ঘের সেই সাহিত্য আসরে যোগদান সূত্রে। সেটা সম্ভবত ১৯৭৯ সাল। আমার অগ্রজ কথাসাহিত্যিক জিয়া হাসান একদিন আমাকে একটি চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘এনার সাথে যোগাযোগ করবি সেখানে একটি সাহিত্য সভা হয় প্রতি সপ্তাহে। সেখানে গেলে অনেক কিছু শিখতে পারবি ’ দেখি চিরকুটে লেখা নাম শেখ তোফাজ্জল হোসেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন।
একসময় তিনি আমার ও আমার অগ্রজ জিয়া হাসানের বড় ভাইয়ের মতো হয়ে যান। পুরানা পল্টনে তার বাসায় থাকা-খাওয়া ছিল আমাদের প্রায় নিয়মিত। তিনি আমাদের চাকরি বাকরির জন্যও অনেক চেষ্টা তদবির করেছেন। চেয়েছেন আমরা যাতে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হই। তার বাসায় সকাল, দুপুর হুটহাট উপস্থিত হয়ে খেতে বসে যেতাম। ভাবীও ছিলেন আন্তরিক ও আমাদের খুবই আপন। ভাবীর বাবার বাড়ি ছিল মুন্সিগঞ্জে। খুবই অভিজাত পরিবারের মেয়ে। কোনোদিন রাগতে দেখিনি। আজকাল এরকম আন্তরিক লোক একেবারেই বিরল। ভাবীও চলে গেলেন এই কিছুদিন আগে না ফেরার দেশে। খুব কষ্ট পেয়েছি খবরটি শুনে। তখন তার ছোট দুই মেয়ে ছিল শম্পা ও শাখী। তারা এখন অনেক বড় হয়েছে। শুনেছি একজন ডাক্তার ও আরেকজন সাংবাদিক। শেষের দিকে তোফাজ্জল ভাইয়ের সাথে তেমন যোগাযোগ ছিল না। ২০১০ সালের দিকে একবার তার আমিন বাজারের বাসায় গিয়ে দেখে এসেছিলাম। মাঝে মধ্যে ফেসবুকে তার পোস্ট দেখতাম। তার মাধ্যমেই যা খবরাখবর পেতাম। তার মৃত্যুর সংবাদও পেয়েছি ফেসবুকের মাধ্যমে। দোয়া করি তাঁরা দুজন ভালো থাকুন পরপারে।

 


আরো সংবাদ



premium cement
রেকর্ড গড়ে সাদিক খান আবারো লন্ডনের মেয়র আগামী ২ মাসের মধ্যে ভাঙ্গা-খুলনা-যশোর পর্যন্ত ট্রেন চালু হবে : জিল্লুল হাকিম ফতুল্লায় ব্যবসায়ী অপহরণ, গ্রেফতার ৭ তাপদাহের কারণে গোসল করতে গিয়ে কলেজছাত্রের মৃত্যু সুন্দরবনে আগুন নেভেনি, রাতে আরো ছড়িয়ে পড়তে পারে রামুতে ৬০ লাখ টাকার ইয়াবাসহ ২ কারবারী আটক ৪০ ডিগ্রির নিচে নামল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা তিন দিন ৩ ঘণ্টা করে শাহজালালে বন্ধ থাকবে ফ্লাইট ওঠানামা ‘২০৩০ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয় করবে পোশাক শিল্প’ প্যারিসে গুলিতে একজন নিহত, বেশ ক’জন আহত ভৌগোলিক কারণে সিঙ্গাপুরের জন্য চট্টগ্রাম খুবই গুরুত্বপূর্ণ : হাই কমিশনার

সকল