২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ধূসর নীল সমুদ্রে

-

গভীর মনোযোগে পত্রিকার পৃষ্ঠায় মাথা ঝুঁকে ছিল লোকটা। এতটা মনোযোগে যে হঠাৎ সে কথা বলে উঠতে পারে তেমন বিষয় ঘুণাক্ষরেও মাথায় আসেনি। ভেবেছি, পড়া শেষে নিশ্চয়ই নিঃশব্দে বিদায় হবে সে। যদিও তাকে নিয়ে কিংবা তার এ মুহূর্তের ক্রিয়াকলাপ নিয়ে আমার এক বর্ণ ভাবার কথা নয়, তবু প্রচ্ছন্ন প্রক্রিয়া প্রয়াসে নি¤œরূপ দৃশ্যপটগুলো প্রত্যক্ষ হয়ে উঠতে থাকে :
বসে পত্রিকা পাঠ সমাপ্ত করতে পারে না সে। সম্ভবত কোনো তাড়ায় উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটার ফাঁকেই পত্রিকার পৃষ্ঠায় দৃষ্টি ধরে রাখে। আচমকা বেশ দ্রুত হাঁটতে শুরু করে সে। মোটামুটি পেশিবহুল মাঝারি আকৃতির শরীর তার। গায়ের রঙ পশ্চিমাদের মতো লালচে ফর্সা। চোখ দুটো খুদে। গরুর শিংয়ের মতো চোখা দীর্ঘ নাক। মুখমণ্ডলে দাড়ি-গোঁফ বলতে নেই। তার চুল এত সিল্কি যে হাঁটা শুরু করা মাত্রই দুরন্ত বাতাসে সেগুলো দাঁড়িয়ে তার মাথাকে সদ্য ফোটা বর্ষাকদমের মতো সুষম গোল করে তোলে। হাঁটায় ক্রমেই দ্রুত গতি সম্পন্ন হতে থাকে সে। মাথা নোয়াই আমি। ভাবি, এ দৃশ্যপটটির দ্রুত অবসান জরুরি। কারণ, অনাবশ্যক এরই মধ্যে তাকে নিয়ে যেটুকু ভাবা হয়েছে, তা যথেষ্টরও ঊর্ধ্বে। অতএব, চলে যাক সে। এ মুহূর্তে বিদায় হোক।
খানিক পর মাথা তুলে তাকাই। দেখি নেই লোকটি। আমার সম্মুখ বরাবর সীমাহীন সমুদ্র। সমুদ্রে সে থাকবে না, তা-ই স্বাভাবিক। পর্যায়ক্রমে তীর ধরে দুই দিকে দৃষ্টি ঘোরাই। নাহ, কোনো খানে নেই সে। ভাবি, ভালোই হলো। যদিও সে মৃদু ও মিতভাষী, তবুও শুরু থেকেই এখানে তার উপস্থিতি তথা অবস্থিতি একান্ত অকাম্য হয়ে উঠেছিল। গলাখাঁকারি দিয়ে আমার পাশের ছোট্ট বালুর ঢিবিটাতে গেড়ে বসা মাত্রই অস্বস্তি হচ্ছিল তাকে নিয়ে। কারণ, ঢিবিতে বসার অনুমতি চাওয়ার ভঙ্গিমা থেকে তাকে একান্তই অতিকথক গণ্য হয়েছিল। এবারে আমার আসল কাজ, সমুদ্র দর্শনে মনোযোগ দেয়া যাক। আমি এর আগে সমুদ্র দেখিনি। বিদগ্ধ মনে এবার এসেছি সেই অদেখাকে দু’চোখ ভরে দেখতে। এখানে আসার আগে বন, পাহাড়, সরোবর, গবাদি পশু, পুষ্পরাজি, পাখপাখালি কোনো কিছুই আমার মন ভালো করতে পারেনি। অবশেষে মায়ের একান্ত পরামর্শে এ উদ্দেশ্যে এখানে পদার্পণ। সমুদ্রের নাকি দুঃখ ভোলানোর ক্ষমতা অসীম। অতএব, সে গেছে মানে জঞ্জাল গেছে। ব্যস।
অস্তিত্ব জুড়ে এখন সমুদ্র, শুধুই সমুদ্র। আহা, কী অপূর্ব সুন্দর সামনের পানিরাশি! এই ভীষণ নিরালায় আমি এখন শুধু সমুদ্রের হয়ে যাবো। হে সমুদ্র, মহাসমুদ্র, তুমি খোদার আশীর্বাদ হয়ে আমাকে দয়া করো, আমার প্রাণের গহিনের দুঃখ ভোলাও। তুমি আমাকে শেখাওÑ এ পৃথিবী খুব বিচিত্র। বিচিত্র এর মানুষ, প্রাণিকুল; এ বৈচিত্র্যে বিশ্বাস রেখেই আমাদের কাল অতিক্রম করে যেতে হয়, যেতে হবে।
আমি দেখতে থাকি তামাম উপকূলটি হঠাৎ কেমন পাল্টে গেছে। নির্জনতার বুক চিরে বিচিত্র সব মানুষের সমাগম ঘটেছে : আবালবৃদ্ধবনিতা, সাদা-কালো, উঁচু-নিচু, সুবেশ-কুবেশ, রাজা-রাজন্য, ভিক্ষুক, দরবেশ, পুরোহিত, ভিক্ষু, পাদ্রি, সন্ন্যাসিনী, ঘোড়সওয়ার, তীরন্দাজ, বন্দুকধারী, সামন্ত-লাঠিয়াল, তলোয়ারবাজ কী এক গভীর মোহাবেশে নিবিষ্ট সবে! তাদের ঘোলা চোখে কেবলই সমুদ্রের প্রগাঢ় প্রতিচ্ছবি। তারা সমুদ্র দেখছে। তাদের মধ্য থেকে হঠাৎই একজন উচ্চস্বরে চিৎকার করে উঠল, অভিযোজন, অভিযোজন। আমি ভীষণ চমকে উঠি। সে আবারো বলে চলেছে, মিছে ভেবে কিছুই হবে না। বাঁচতে হলে চাই অভিযোজনÑ সময় সময় ওই দূর পারাপারে চেয়ে বিধাতার অসীমত্বের কাছে এমনতর আত্মসমর্পণ।
আমি পরম বিস্ময়ে উঠে দাঁড়াতে যাবো, তখনই পেছনে কারো স্পর্শ অনুভব করে লাফিয়ে উঠি। ভীষণ সঙ্গতিহীনভাবে কানে উঠে আসে কথাগুলো : ভাইজান, আছেন তালিপর অহনও? ভাবনা থেকে দ্রুত ফিরে আসি। মাথা নিচু বলি, হুম, আছি। এই তো বসে আছি।
ভাইজান, এই ঠায় বই আবারো তালিপর?
হুম, বসুন।
আপনে বিরক্ত হইবেন না তো?
নাহ! বসুন।
সেই কখন থেইকা বইসা কী ভাবতাছেন এত?
নাহ, কিছু ভাবছি না। দেখছি শুধু।
কী?
ওই যে নিঃসীম সমুদ্র! নীল পানিরাশি!
হুম, বুঝলাম, তা আপনার বাড়ি? বোয়ালখালীঅই, ভাইজান।
তাহলে তো আপনিও খারাপ মানুষ।
তা ঠিক না, ভাইজান।
আপনিই তো বললেন বোয়ালখালীর মানুষ জগতের সবচেয়ে খারাপ।
বলেছি, কিন্তু সব মানুষ খারাপ না, ভাইজান। কিছু মানুষ খারাপ।
তাদের দলে আপনি নেই?
না, ভাইজান।
তাহলে তো আপনি নিঃসন্দেহে ভালো মানুষ।
জি, ভাইজান। তা আপনের বাড়িটা কোনখানে?
হাতিখালী।
বড় ভালো এলাকা। খুবই ভালো, ভাইজান। আপনি এত গভীর কইরা কী ভাবতেছেন? মনও তো খুব খারাপ দেখতেছি। কী হইছে আপনের?
আমি ব্যবসায়ী মানুষ। ব্যবসায়ের খাতিরে এখানে-ওখানে ঘুরি। এই ফাঁকে ক’দিন আগে আমার বাড়ির দারোয়ানটা খুন হয়েছে। নৃশংস খুন। বড় ভালো লোক ছিল সে। ব্যাপারটা তাই সহ্য করা দায়। সেই থেকে শুধুই ভাবছি, কেন এমন হয়। মানুষ হয়ে মানুষ খুন। কী জঘন্য!
ভাইজান, খুন! আপনের এলাকায়ও খুন? কে করল এমন কাজ?
আমার সাবেক দারোয়ানটা। চাকরিচ্যুত হয়ে পুনর্বহালের চেষ্টা করছিল সে।
তার বাড়িটা?
আমার গাঁয়েই।
আর যে খুন হইল, তার বাড়ি?
বোয়ালখালী।
কন কি, ভাইজান?
এটাই সত্যি। তা আপনারও তো দেখছি মন খুব খারাপ। কী হয়েছে আপনার? তখন পত্রিকায় কী পড়ছিলেন ওভাবে?
মৃত্যু সংবাদ, ভাইজান।
কার?
আমার নিজেরই।
মানে?
হ ভাইজান, গেল হপ্তায় এইখানেই আমি খুন হইছি। যে ঢিবিটার পর আপনি গাইড়া বসছেন, ওইটার নিচেই আমি ঘুমাইয়া আছি।
বলেন কি? আপনি খুন হয়েছেন, কিন্তু কার হাতে?
খুনি আমার এক ব্যবসায়িক পার্টনার। লাভের বনিবনা নিয়া হইছে খুন।
আপনার সেই পার্টনারের বাড়ি?
একোই জাগাত ভাইজান। ওই বোয়ালখালীঅই।
হুম, বুছতে পারছি। তাহলে চলুন দু’জন মিলে সমুদ্র বরাবর হাঁটি। সমুদ্রের দুঃখ ভোলাবার ক্ষমতা অসীম। নিঃসীম সমুদ্রে হেঁটে হেঁটে আমরা অসীম দুঃখগুলো ভুলব, কী বলেন?
কিন্তু ভাইজান, আপনি জীবিত মানুষ হয়ে মৃত মানুষের লগে হাঁটবেন?
সমস্যা নেই, চলুন।
না ভাইজান, এ হয় না। হাজার হলেও আমি মৃত, আপনি জীবিত। জ্যাতায় আর মরায় কখনো একলগে হাঁটা যায় না, ভাইজান। হাঁটা ঠিকও না। আমি যাই ভাইজান, বিদায়।
শুনুন।
কী?
জীবিতে মৃতে বন্ধুত্ব না হলেও মৃতে মৃতে তো বন্ধু হওয়া চলে, নাকি?
ভাইজান, তার মানে?
আহা আমিও তো মৃত!
কী বলছেন, ভাইজান? কী বলছেন এসব? আপনি মৃত! কিন্তু ক্যামনে তা হলো?
আমিও আপনার মত খুন হয়েছি।
খুন! এ কী সাঙ্ঘাতিক কথা! আপনিও খুন? কিন্তু কে আপনাকে খুন করল? কী আচানক ব্যাপার!
ওই যে সেই পলাতক দারোয়ান। আগে থেকেই দুষ্ট প্রকৃতির ছিল। চাকরি হারাবার পর বাজে সঙ্গে পড়ে আরো বেশি দুষ্ট হয়ে ওঠে। লুকিয়ে আমার মায়ের পরামর্শটা সম্ভবত শুনে ফেলেছিল সে। খুনি হিসেবে আমরা তাকে সন্দেহ করছি, সে বিষয়টিও আঁচ করে ফেলেছিল। তাই নিজে বাঁচতে আগেভাগেই এখানে এসে ঘাপটি মেরে ছিল। সুযোগ বুঝে সরিয়ে দিয়েছে আমাকে। ওই তো, যে ঢিবিটাতে বসেছেন আপনি, তারই নিচে চিরনিদ্রায় শুইয়েছে আমাকে।
ঠিক আছে ভাইজান, আমরা এখন বন্ধু হইলাম। মৃতে মৃতে বন্ধু, আচানক!
এবার তো একসাথে হাঁটতে আপত্তি নেই আপনার?
জি না, ভাইজান। চলুন হাঁটি।
হুম, চলুন। অনন্তের পথে হাঁটব আমরা এখন। ওই গভীর নীল সমুদ্রের পথ ধরে। হাঁটতে হাঁটতে জগতের সব পাপ কালিমা ছাড়িয়ে যাবো। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement