২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`
শ্রুতি ও স্মৃতির সোনালি শিখা

যেমন দেখেছি তাঁকে

-

পঁচিশ.

কত সাহিত্য আড্ডা আসরের সাক্ষী এই মহানগরী। কত সন্ধ্যার সম্বন্ধ জড়িয়ে আছে স্মৃতির সান্নিধ্যে। এভাবে স্মৃতি মানুষের জীবনকে অভিজ্ঞ করে তোলে। একই সাথে করে স্মৃতিকাতর। কত মুখ ভেসে ওঠে মনের আর্শিতে, যারা একদা দাবড়িয়ে বেড়িয়েছে আমাদের এই ব্যস্ত মহানগরী। যাদের পদচারণায় মুখর হয়েছে কত প্রাঙ্গণ। কত অঙ্গন। কত প্রাসাদের কক্ষ। এমন মুখরতার আয়োজক থাকেন কেউ কেউ। এখন যেমন আছেন। ছিলেন অতীতেও। অতীত মানেই তো হারানোর হাহাকার। মহাকালে মিশে যাওয়ার বেদনা। এ বেদনা বহন করেন তারা পৃথিবীর বাতাসে যাদের চাঞ্চল্য এখনো দুলছে।
ঘটনাচক্র কিংবা প্রবাহ যাই বলি, কালের ঘূর্ণিতে মিটে যাওয়া আয়োজনের ছবি মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। মনে পড়ছে কবি আবিদ আজাদের মুখ। সত্তর দশকের শীর্ষ কবিদের একজন তিনি। তার প্রথম বই ‘ঘাসের ঘটনা’। ঘাসের ঘটনা ঘটিয়ে তিনি বাংলা কবিতাঙ্গনে নিজের শক্তির পরিচয় খুলে দিলেন। শিল্পতরু ছিল তার প্রতিষ্ঠান। তিনিই এর প্রতিষ্ঠাতা। এর সূচনা হয়েছিল নবাবগঞ্জে। তারপর পলাশী এবং সবশেষে কাঁঠালবাগান। শুরুতে কবি নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। তারপর প্রকাশ করলেন শিল্পতরু। শিল্পতরু নামে একটি প্রকাশনাও করলেন। এখনো আছে প্রকাশনাটি। অবশ্য সেই জৌলুস নেই প্রকাশনাটির। আবিদ আজাদ মারা যাওয়ার পর এর জৌলুস শীর্ণ হয়ে যায়।
মহানগরীতে যত সাহিত্য আড্ডা হতো তার উল্লেখযোগ্য একটি হতো কবি আবিদ আজাদের এই শিল্পতরুতে। এ আড্ডায় নিয়মিত যোগ দিতেন কবি আল মাহমুদ। আড্ডার অনেকটা মধ্যমণি ছিলেন তিনি। তাঁর নতুন কবিতা শোনার লোভ ছিল প্রায় সব কবির। ছিল কবিতাসংক্রান্ত সর্বশেষ ভাবনা জানার প্রবল আগ্রহ। এই আগ্রহ থেকে কবিরা ছুটে আসতেন দূরপ্রান্ত থেকে। এ আড্ডায় একদম নিয়মিত ছিলেন আবদুল মান্নান সৈয়দ। মান্নান সৈয়দ এ দেশের সাহিত্য সমালোচকদের শীর্ষস্থানীয় একজন। তার পরে তার মতো দ্বিতীয় কারো প্রকাশ এখনো ঘটেনি। কবি হিসেবেও তিনি অসাধারণ। উত্তরাধুনিক কবিতার তিনি অগ্রগণ্য একজন। ঔপন্যাসিক এবং ছোট গল্পকার হিসেবেও তার অবস্থান বেশ পোক্ত। তিনি এ আড্ডায় নিয়মিত বসতেন। আসতেন পঞ্চাশ দশকের কবি কায়সুল হক।
আল মাহমুদ এবং আবদুল মান্নান সৈয়দ দু’জনের আলোচনা-সমালোচনা নতুন কবিদের যেমন পথ দেখাত, প্রতিষ্ঠিতদেরও আগ্রহ জাগিয়ে দিত। আড্ডাটিও ছিল তেমনি জমজমাট। নিয়মিত যারা এ আড্ডায় যোগ দিতেন তাদের অন্যতম ছিলেন কবি মাহবুব হাসান, কবি শাহাবুদ্দীন নাগরী, কবি আতাহার খান, কবি জাহাঙ্গীর ফিরোজ, কবি শিহাব সরকার, কবি মজিবুল হক কবীর, কথাশিল্পী সিরাজুল ইসলাম মনির, কবি শামসেত তাবরীজী, কবি কাজল শাহনেওয়াজ, কবি রেজা ফারুক, কবি বুলান্দ জাভীর, কবি রিফাত চৌধুরী, কবি পুলক হাসান, কবি মোস্তফা আনোয়ার, কবি আইউব সৈয়দ, কবি অরুণ চৌধুরী, কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন, চিত্রশিল্পী বেনজীর আহমেদ, চিত্রশিল্পী আবদুর রউফ প্রমুখ। এসব কবি কথাশিল্পী ও শিল্পাঙ্গনের মানুষগুলোর উপস্থিতি একেকটি সন্ধ্যাকে করে তুলত আলোকিত। এ সন্ধ্যাগুলো উসকে দিত একেকজন কবির মন। স্বপ্ন দীর্ঘ করে তুলত। স্বপ্নের সাথে স্বপ্নের জোড়া পেয়ে স্বপ্ন হয়ে যেত দীর্ঘতর। একটি আড্ডা শেষ হলে পরবর্তী আড্ডার তৃষ্ণা জেগে উঠত বুকের ভেতর। এসব আড্ডায় আল মাহমুদ এমনি চমকপ্রদ ছিলেনÑ প্রতিটি আড্ডায় যেন ছিলেন নতুন। যেমন নতুন কবিতা। তেমনি নতুন বক্তব্য। সাহিত্য আড্ডায়ও নিত্যনতুন মুখ এসে হাজির হতো। দূরের কাছের অনেক নতুন লেখিয়ে তরুণ কবির সমাবেশ ঘটত। এ সব নতুন কবির চোখে আল মাহমুদ ছিলেন কল্পনার কবি। স্বপ্নের কবি। এদের ভক্তিশ্রদ্ধা এতটাই লীলায়িত হতো মাঝে মধ্যে বিরক্ত হয়ে পড়তেন মাহমুদ ভাই। নিজেকে আবার সামলিয়ে নিতেন। কাছে টেনে বলতেনÑ মিয়া লিখতে আসছ, তো কিছু লেখাপড়া শেখো। ছন্দটা জানো। মাত্রা ঠিক করো। অন্ত্যমিলের কায়দা কানুন রপ্ত করো। শুধু আমি কবি আমি কবিতা লিখি এমন বললে তো হবে না। কবিতা লেখার কৌশলটা তো আয়ত্ত করতে হবে।
আল মাহমুদের এসব কথা ছিল তরুণদের কাছে অলঙ্ঘনীয়। ছিল বিনা বাক্য ব্যয়ে শিরোধার্য। এসব কথাই আবার চালাচালি হতো নিজেদের কথোপকথনে। তরুণদের ভালোবাসা বাঁধভাঙা। দাবি দাওয়াও অন্যরকম। এক আড্ডায় এক তরুণ এলো। এলো চাঁদপুর থেকে। হাতেলেখা এক মস্ত পাণ্ডুলিপি তার হাতে। কবিতার। যতক্ষণ আড্ডা চলছিল এক কোনায় বসেছিল চুপচাপ। আড্ডার কর্মকাণ্ডে তার চোখে কখনো বিস্ময় কখনো কৌতূহল। একেবারে শেষের দিকে যখন আড্ডা-সঞ্চালক আবিদ আজাদ তরুণটিকে বললেনÑ আপনি কবিতা পড়তে চান?
তরুণটি মাথা নেড়ে খুব শরমের সাথে জানাল পড়তে চান।
আবিদ আজাদ বললেনÑ পড়–ন
মস্ত পাণ্ডুলিপি ঘেঁটে একটি কবিতা চিহ্নিত করল তরুণটি। তারপর পড়ার পালা। কিন্তু তার পাণ্ডুলিপি এতটাই কাঁপছিল, যেন সে লাইন হারিয়ে ফেলছে। পাণ্ডুলিপি কাঁপার কারণ তো সবাই বুঝলেন। ভয় তার সারা শরীরে কাঁপন তুলে দিয়েছে। এমনকি তার ঠোঁট জোড়াও কাঁপছিল। তার কাঁপুনিতে সবাই এতটা চুপ করে রইল, এর আগে আড্ডা এমন করে নীরব হয়নি। এলোমেলো উচ্চারণে শেষ করল কবিতাটি। সবার এক ধরনের করুণা হলো তরুণটির প্রতি। চাঁদপুর থেকে ছুটে এলো আড্ডায়। কবিতা প্রেমের ঘূর্ণিতে তার জীবন ঢুকে পড়েছে কল্পনার অশান্ত জায়গায়। আসল ঘটনাটি তখনো বাকি।
আড্ডা শেষ। যে যার মতো পছন্দের কবিদের সাথে ভাগ ভাগ হয়ে গেছে। আড্ডা ভাগ হয়েছে অনেক খণ্ডে। মাহমুদ ভাইকে ঘিরে এক জটলা। আবদুল মান্নান সৈয়দ ঘিরে আরেক জটলা। আরেকটি জটলা আবিদ আজাদ ঘিরে। এ ছাড়াও ছোট ছোট জটলায় নানা রকম কথা বিনিময়। দূরের পথিক যারা তাদের অনেকে বিদায় নিলেন। যাওয়ার জন্য উঠলেন আল মাহমুদ। আবিদ আজাদকে ডেকে বললেনÑ আজ আসি আবিদ। জটলা ছেড়ে আবিদ আজাদ ছুটে এলেন। হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেখ করে বললেনÑ ঠিক আছে মাহমুদ ভাই, আবার দেখা হবে। হাত ছেড়ে দিয়ে মাহমুদ ভাই বললেনÑ আজ রিকশা ভাড়া তো দাওনি আবিদ।
ওহ সরি মাহমুদ ভাই, বলেই পকেট থেকে একটি ছোট্ট খাম বের করে মাহমুদ ভাইয়ের হাতে দিলেন। মাহমুদ ভাই বেশ খুশি হয়ে খামটি পুরে নিলেন পকেটে। যাওয়ার জন্য উদ্যত হলেন। ঠিক তখনই ঘটল ঘটনাটি। চাঁদপুর থেকে আসা তরুণটি আল মাহমুদের দু’পা জড়িয়ে ধরে লেপটে থাকল মাটির সাথে। মাহমুদ ভাই বেশ অপ্রস্তত হয়ে থতমতো খেয়ে একরকম চিৎকার দিয়ে উঠলেন। বললেন, কী ব্যাপার! পা ধরে আছো কেন? ততক্ষণে সবাই আল মাহমুদের চারপাশে জড়ো হয়ে গেল। আবিদ আজাদ দ্রুত ছেলেটির হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু এমন করে ধরে আছে ছেলেটি, মাহমুদ ভাইয়ের পা ছেলেটির বুকের নিচে। আর দুটি পা বেশ মজবুত করে ধরা। বিষয়টি এমন যে, হাঁটতে চাইলে আল মাহমুদ পড়েই যাবেন। আবিদ আজাদ এবং আমি মিলে একরকম জোর করে টেনে তুললাম ছেলেটিকে। কেউ কেউ চড়াও হচ্ছিল ছেলেটির ওপর। মাহমুদ ভাই বললেনÑ বিষয়টি কি আগে জানো তো। কী চায় ছেলেটি।
আবিদ আজাদ বললেনÑ কী ব্যাপার, সমস্যা কী তোমার? কী চাও?
বেশ ঋজুভঙ্গিতে ছেলেটি বললÑ আমার কবিতার এই পাণ্ডুলিপিটি আল মাহমুদ স্যারকে সম্পাদনা করে দিতে হবে। প্রায় এক সাথে হো হো করে হেসে দিলো সবাই। এর জন্য এই কাণ্ড করলে তুমি বললেনÑআবিদ আজাদ। এছাড়া আমার কী করার আছে বলুন। লাজুক ছেলেটির এখন আর কোনো লাজ নেই। মনে হচ্ছে সে খুব দক্ষ কেউ এবং এসবে অভ্যস্ত। তার দৃঢ় দাবি এটি আল মাহমুদকেই সম্পাদনা করতে হবে। এ দাবির পেছনে একটি রহস্যের কথাও বলল। বলল, আমি স্বপ্নে দেখেছি আমার পাণ্ডুলিপি আল মাহমুদ স্যার সম্পাদনা করে দিয়েছেন। স্বপ্নটি কাল রাতেই দেখেছি। আমি আর দেরি করিনি। আজই এসে গেছি চাঁদপুর থেকে। আমি আল মাহমুদ স্যারের অফিসে গেছি। অফিস থেকে বলল, স্যার এখানে আছেন।
তরুণের এ ভয়াবহ আবেগ তাকে একরকম পাগলামির ঘূর্ণিতে নিক্ষেপ করল। কিন্তু সেই তরুণের কাছে এটি মোটেই পাগলামি নয়। এটিই তার স্বপ্নের মোটা দাগ। একে সে স্পর্শ করতে চায়। ছুঁতে চায়। কিংবা এর সীমা পেরিয়ে নতুন রেখা দৃশ্যমান করার তীব্র আকাক্সক্ষা চায়। এ চাওয়া থেকেই উপুড় হয়ে বুকে জড়িয়ে নিলো আল মাহমুদের দু’টি পা। ঘটনার আকস্মিকতায় চমৎকৃত আল মাহমুদও। একটি শিক্ষিত তরুণ তার কবিতার অধিকার থেকে আরেকজন কবির পায়ে লুটিয়ে পড়ার দৃশ্যটি চমকপ্রদ হবে এটিই ধরে নেয়া যায়। আল মাহমুদ আবিদ আজাদকে বললেনÑ পাণ্ডুলিপিটি রেখে দাও। দেখব আমি। পাণ্ডুলিপি রেখে দিলেন আবিদ আজাদ। তরুণটি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন মান্নান সৈয়দ। বললেনÑ মনে হয় কবিতার প্রতি তোমার প্রেমই তোমাকে কবি করে তুলবে। আবেগে ছেলেটির চোখ দু’টি ভিজে উঠলÑ হাতের কব্জি দিয়ে মুছে নিলো দু’টি চোখ।
ছেলেটির মুখের দিকে চোখ পড়ল সবার। মুখ দেখে এবং পোশাকে-আশাকে বেশ দশাসই মনে হলো। কথিত ময়লাযুক্ত বেহিসেবি কবিযশ প্রার্থীদের মতো নয়। তার অবয়বে একটি পরিশীলিত উচ্ছ্বাস ফুটে আছে। খানিকটা স্নেহের সুরে আল মাহমুদ বললেনÑ কী করো তুমি?
পার্টটাইম একটি এনজিওতে সময় দেই। তবে আমার এবার বিসিএস হয়ে গেছে। শুনে নতুন করে দেখতে হলোÑ তরুণটিকে।
তার উচ্চারণে কোনো ফাঁক কিংবা দ্বিধা নেই। এতক্ষণ আমরা প্রায় সবাই তরুণটিকে পাগল কিংবা আধপাগল ভাবছিলাম। ছেলেটির চেহারা এবং অকপট উচ্চারণ আমাদের ধারণায় পানি ঢেলে দিলো। পরিবর্তে নতুন ভাবনা যোগ হলোÑ তবে কবিতাকে এমন করেও ভালোবাসা যায়! একজন কবিকে এমন করে নির্ভর করা যায়। হয়তো যায় বলেই কবিতার জন্য এমন অনেক মুখ আছেন যারা জগতের সব কিছু তাচ্ছিল্য করেন। সবকিছুর ঊর্ধ্বে কবিতার ঊর্ধ্বতা স্থাপন করেন। জীবনকে যেমন করে ভালোবাসেন তেমন করেই ভালোবাসেন কবিতা। কবিতা আর হৃদয়ের মধ্যখানে কোনো দেয়ালই রাখেন না তারা। এমন কবিরা নতুন ভাষা নির্মাণ করেন। নতুন বাণী দেন মানুষের জন্য। দেন স্বপ্নের নতুন দৃষ্টি।
আল মাহমুদের কাছে হয়তো তেমন কিছু পেয়েছিল তরুণটি। হয়তো পেয়েছিল তার স্বপ্নে নির্মিত প্রাসাদের সত্যি কারিগর। যার স্পর্শে তার সৌধ হবে শিল্পীত। যার জন্য আল মাহমুদ এই তরুণের কাছে ছিল স্বপ্নের পুরুষ। [চলবে]

 


আরো সংবাদ



premium cement