৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


একটি অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার

শিল্পের একটি সীমা আছে, আছে সৌন্দর্য : রিজিয়া রহমান

-

বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা ঔপন্যাসিক রিজিয়া রহমান। ১৬ আগস্ট ২০১৯ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন তিনি। ষাটের দশক থেকে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, রম্যরচনা ও শিশুসাহিত্যে তার বিচরণ। তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলো হলো ‘ঘর ভাঙা ঘর’, ‘উত্তর পুরুষ’, ‘রক্তের অক্ষর’, ‘বং থেকে বাংলা’। তিনি উপন্যাসে অবদানের জন্য ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। এবার তাকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকারের দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘একুশে পদক’ সম্মাননা প্রদান করা হয়। এ পুরস্কারপ্রাপ্তির অনুভূতি ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে মুখোমুখি হন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাসান সাইদুল
মৃত্যু : ১৬ আগস্ট ২০১৯, জন্ম : ২৮ ডিসেম্বর ১৯৪৮
লেখালেখির স্বীকৃতিস্বরূপ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পেয়েছেন, কেমন লাগছে?
খুব ভালো অনুভব করছি। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে আমাকে কিছু দিন আগে মন্ত্রণালয়ের একজন সেক্রেটারি ফোন করে বললেন, ‘আপনাকে তো একুশে পদক দেয়া হচ্ছে। আপনি খুশি হয়েছেন কী? আমি বললাম, পুরস্কারপ্রাপ্তি তো সব সময়ই আনন্দের। আমার কাছে ভালো লাগছে। পুরস্কার বা স্বীকৃতি পাওয়া সত্যিই অনেক আনন্দের। এ আনন্দ উপভোগ করছি।
বয়স তো নব্বই ছুঁই ছুঁই। আপনার কী মনে হয় আরো আগে সম্মাননা পাওয়া উচিত ছিল।
আমার কাছে বয়স কোনো বিষয় নয়। এ নিয়ে আমি কিছু ভাবছি না বা কিছু মনেও করছি না। পুরস্কার পাওয়া নিয়ে আমার তেমন আগ্রহ নেই। তবে পুরস্কার একজন লেখককে লেখার প্রতি সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। আমার কাছে এমনটাই মনে হয়। তবে পুরস্কার তো পুরস্কারই। তাড়াতাড়ি আর দেরি বলতে কিছু নেই। এ পুরস্কার না দিলেও আমার কোনো কষ্ট বা অভিমান থাকত না যে, আমি পুরস্কার পেলাম না।
এ পুরস্কার কি কাউকে উৎসর্গ করতে চান?
এমন ভাবিনি। রাষ্ট্র আমাকে পুরস্কার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এতে আমি খুশি। এ পুরস্কার না দিলেও আমার কোনো আক্ষেপ থাকত না। কারণ, আমি লেখালেখি পুরস্কার পাওয়ার জন্য করিনি। আমার মন চেয়েছে, বিবেক নাড়া দিয়েছে তাই লিখেছি।
আপনি কি এখন লেখেন?
না, আমি লিখতে পারি না। পড়তেও পারি না তেমন। চোখে কম দেখি। নিজের যতœ নিতেই কষ্ট হয়। লেখার খুব আগ্রহ এখনো আছে। কিন্তু পারছি না। পড়ার জন্যও মনটা খুব কাতরায় তাও পারছি না চোখের সমস্যার কারণে।
জীবনের এই অবস্থায় এসেও জানতে চাই ‘জীবন’টা আপনার কাছে আসলে কী?
জীবন একটি আশ্চর্যের বিষয় বটে। পনেরো বছর জীবন এক রকম, সংসার আরেক রকম। নিজেকে আমার পর্যটক বলে মনে হয়। পর্যটক যেমন নানা দেশ হেঁটে যান অনেক কিছু দেখেন, আমিও যেন বহু বৈচিত্র্যে ভরা অনেক কিছুর ভেতর হেঁটে হেঁটে পার হয়েছি।
অতিরিক্ত নগরায়ণের এ ঢাকা শহর নিয়ে আপনার অভিমত কী?
দেশ ভাগের পর কিছু দিন ফরিদপুরে থাকা হয়েছে আমার। তারপর ঢাকায় আসি। ‘প্রাচীন নগরীতে যাত্রা’ নামে একটি বই লিখেছি। সেখানে আমার ঢাকার জীবন এবং ঢাকার ইতিহাস লিখেছি। দেশের তুলনায় জনসংখ্যা অবিশ্বাস্য বেশি। তারপর এত বড় বড় বিল্ডিং আমাকে অস্থির করে তোলে। আগের ঢাকাই ভালো ছিল, সবুজে ঘেরা ছিল। এমন ঘন ঘন বিল্ডিং ছিল না। ট্রাফিক জ্যাম ছিল না।
আপনার শুরুর সময় নারীদের সাহিত্যচর্চা কেমন ছিল?
মাধ্যমিকে পড়ার সময়ই ঘরে থাকা শরতের সব গল্প, উপন্যাস পড়েছিলাম। লেখালেখি শুরু করতে বা চালিয়ে যেতে আমার খুব বেশি কষ্ট করতে হয়নি। বেগম রোকেয়ার সময়ে হয়তো এমন পরিবেশ ছিল না। খুব যে অনুকূল পরিবেশ ছিল না তা নয়।
আপনার কবিতার কোনো বই বের করলেন না...
আমি ভালো লাগা থেকে লিখতাম। আমি যখন তৃতীয় শ্রেণীতে পড়তাম তখন প্রথম কবিতা লিখি। বাড়ির সবাই পড়ল, বিশ্বাসই করেনি আমি লিখেছি। পরে আরো বেশ কয়েকটা কবিতা লেখার পর বাড়ির সবার বিশ্বাস হলো, কবিতা আমি লিখতে পারি। সবাই প্রশংসা করত কিন্তু কবি হবো, কবিতার বই ছাপাব এমন কখনো ভাবিনি।
‘রক্তের অক্ষর’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ইয়াসমিন। ইয়াসমিন কি আপনার চিত্রকল্প?
ইয়াসমিন আমার কোনো কল্পনার চরিত্র নয়, যিনি আমাকে ছবি দিয়েছিলেন সে-ই আমাকে এমন একজনের তথ্য দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ওখানে এমন একজন মেয়েকে আমি দেখেছি যে শিক্ষিত, চিন্তাভাবনাগুলো অন্য রকম, একেবারে আপনাদের মতো। তার ওই রকম বর্ণনার ওপর ভিত্তি করেই আমি চরিত্রটা সৃষ্টি করেছিলাম। আমি উপন্যাসে জয়ও দেখাইনি, পরাজয়ও দেখাইনি।
আমি মানবিকতার বিষয়টি দেখাতে চেয়েছি। আমাদের বোধে একটা ধাক্কা দেয়ার চেষ্টা করেছিলাম। এ উপন্যাসটি যখন আমি লিখি তখন নারীবাদ বিষয়টি বা নারীর অধিকারগুলো ওভাবে আমাদের সাহিত্যে আসেনি। আমি তাই উপন্যাসের শেষে ব্রান ফ্রি বিট এটার মাধ্যমে তাদের বন্দিত্বের কথা বলেছি এই যে জীবন এত করুণ এবং এই বন্দিত্ব এটা কেন? মানুষ হিসেবে তাদের মুক্তির কথা বলতে চেয়েছি।
আপনি তো চা-বাগানের উপাখ্যান নিয়েও উপন্যাস লিখেছেন...
‘সূর্য সবুজ রক্ত’ হলো সেই উপন্যাস। চা আমরা সব সময়ই খাই, কিন্তু এই চায়ের পেছনে কত ইতিহাস, বঞ্চনা আর শ্রম আছে, সেটির কতটুকুইবা আমরা জানি? সেই স্তরগুলো খুব ভালোভাবে দেখে আমি এই উপন্যাস লিখেছি। চায়ের ইতিহাস নিয়ে উল্লেখযোগ্য উপন্যাস অন্তত আমাদের দেশে লেখা হয়নি। মনে হয় আমার এই উপন্যাসই প্রথম।
পরে শিশুসাহিত্যে এলেন কিভাবে?
‘আজব ঘড়ির দেশে’ শিশুদের সায়েন্স ফিকশন। নায়ক একটি স্কুলশিশু। সেখানে সৃষ্টির শুরু থেকে পৃথিবী এখন পর্যন্ত যতগুলো স্তর পার হয়েছে, সেই সময়গুলোর বর্ণনা এবং ডায়নোসর থেকে শুরু করে নানা জীবজন্তুর এই পৃথিবী কিভাবে আধুনিক পৃথিবীতে এলো, সেই গল্পটি বলেছি। ‘ঝিলিমিলি তারা’ আমার লেখা ছড়ার বই। ঐতিহ্য রাজাদের নিয়ে লেখা একটি ছড়ার বই নিয়ে রাখলেও এখনো প্রকাশ করিনি। সেখানে একটি ছড়া দিয়ে একটি গল্প বলেছি। আর ‘মতিশীলের বাড়ি ও অন্যান্য গল্প’ নামের আরেকটি শিশু-কিশোর গল্পের বই আছে।
এখন তো অনেক অস্থিরতা ও নির্মমতার ঘটনা দেখতে পাই। ধর্ষণও কম দেখছি না। এসব বিষয় নিয়ে কি যুক্তিযুক্ত লেখালেখি হচ্ছে বলে মনে করেন?
৭০ দশকে বা তার আগে সবাই সমসাময়িক প্রেক্ষাপট নিয়ে লিখত ৫০-৭০ এর দশকে সব লেখক সাহিত্যিকরা বাংলা ভাষা, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে লিখেছে। এখন বাংলাদেশের ভেতর নানা বিভাজনের ফলে সমসাময়িক লেখা তেমন একটা হচ্ছে না। তবে কিছু কিছু লেখা পাওয়া যায়।
যৌনতা সাহিত্যের অংশ বলা যায় নিঃসন্দে কিন্তু এটি কেমন হওয়া উচিত?
কোনো কোনো তরকারিতে আমরা পাঁচফোড়ন দেই। সব তরকারিতে প্রয়োজন হয় না। সব সময় যৌনতার কোনো প্রয়োজন নেই। শিল্পের একটা সীমা আছে। শিল্পের একটা সৌন্দর্যও আছে, সেখানে তার সীমারেখা যতটুকু, ততটুকুই যৌনতার প্রকাশ ঘটাতে হবে।
অনেকে মনে করছেন বর্তমানে আগের মতো ভালো গল্প হচ্ছে না, আপনার কী মনে হয়?
পরীক্ষার মানেই দুর্বোধ্যতা নয়। আধুনিক গল্প মানেই তো দুর্বোধ্য শব্দ দিয়ে পৃষ্ঠা ভরে দেয়া হয়। আঙ্গিক পরিবর্তন করতে পারেন। কিন্তু আঙ্গিক পরিবর্তনের সাথে আমি যা বলতে যাচ্ছি তা বলতে হবে। উদ্দেশ্যহীন কিছু শব্দ দিয়ে শব্দ জাল তৈরি করার মধ্যে কোনো আধুনিকতা আছে বলে আমার মনে হয় না। ভালো গল্প যে হচ্ছে না তা নয় কিন্তু তবে খারাপের চেয়ে ভালোই কম বর্তমানে।
কখন প্রেমে পড়েছিলেন?
জীবন মানে প্রেমময়। শুধু নারী-পুরুষের প্রেমই কি প্রেম। প্রেমের ব্যাখ্যাটা অনেক অনেক বড়। পৃথিবীতে অনেক প্রেম আছে। আবেগের প্রেম। আমার কাছে মনে হয় স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির যে প্রেম সেটাই সবচেয়ে গভীর। আমার প্রেম করার সময় হয়ে ওঠেনি তার আগেই আমার বিয়ে হয়ে যায়। বলতে গেলে স্বামীই আমার প্রেমিক।
কাদের গল্প পড়তেন?
শিবরাম চক্রবর্তী, আরো ছোটবেলা ঠাকুরমার ঝুলি ছোটবেলায় পড়তাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সব গল্প আমার পড়া। অসাধারণ গল্পকার তিনি! মানিক-শরতের কিছু কিছু গল্প ভালো লেগেছে। তারাশঙ্করের গল্প ভালো। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পের চেয়ে উপন্যাস আমাকে টেনেছে বেশি। সতীনাথ ভাদুড়ী, প্রমথ চৌধুরী ও বনফুলও আমার প্রিয় গল্পকার। প্রেমেন্দ্র, অচিন্ত্য, মতি নন্দী, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এদের অনেক ভালো গল্প আছে। বুদ্ধদেব ও সুনীলের একটি দুটি গল্প খুব ভালো লেগেছে। বাংলাদেশ পর্যায়ে হাসান আজিজুল হকের সব গল্পই আমার ভালো লাগে। সৈয়দ শামসুল হকের নাম তো করতেই হয়। এরপর শওকত আলী, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সেলিনা হোসেন, রাবেয়া খাতুনÑ এদের কিছু কিছু গল্প আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। বাইরের গল্পের ভেতর আমি খুব পছন্দ করতাম রাশিয়ান আর ফরাসি ছোটগল্প। বিশ্বসাহিত্যে পুশকিন, তলস্তয়, গোগল, মপাসাঁÑ এদের অধিকাংশ গল্পই সাংঘাতিক ভালো লাগে। আমি এখনো পড়ি।
কেমন বাংলাদেশ দেখে যেতে চান?
সুন্দর একটি বাংলাদেশ। সোনালি বাংলাদেশ। যেখানে মানুষে মানুষে হানাহানি থাকবে না। শত্রুতা থাকবে না। সবাই মিলে জনসেবায় ব্রত হবে এমন একটি পরিবেশ দেখে যেতে চাই। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement