০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`


কাল তুমি ঝরাপাতা

-

পৃথিবী নামক এ গ্রহের মানুষ আজ কতটা বিপন্ন, তার সাহসী উচ্চারণ করেছেন সম্প্রতি প্রয়াত বিশিষ্ট বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, মানবজাতির আধুনিক সব প্রযুক্তি মানুষকেই ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে পারে। তার আশঙ্কা, পারমাণবিক অস্ত্র এবং জলবায়ু পরিবর্তনকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় তা জানার আগেই এসব প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়ে ডেকে আনতে পারে ভয়াবহ কোনো বিপর্যয়। পারমাণবিক সঙ্ঘাত তো এক মহা হুমকি! মানুষের আবেগকে আহত করা হচ্ছে ভেবে হকিং পুনরায় বললেন, তবে এমনটা ঘটবে না বলে তিনি আশাবাদী।
সত্য যে সব সময় আমাদের পক্ষে প্রীতিপদ হয় না, তার যে একটা কঠিন রূপও আছে এবং কঠিনরূপে দেখা দিলে তাকে বরণ করে নিতে হয়Ñ এটা ছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের শেষ বয়সের উপলব্ধি। কিন্তু নিঃস্বার্থ জ্ঞান অনুসন্ধানের বিজ্ঞানী হকিংয়ের শেষ জীবনের উক্তি আর শেষ জীবনের উপলব্ধি এক হওয়ার আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না।
বস্তুত, পরিবেশ দূষণ আজ এমন পর্যায়ে রয়েছেÑ যা বলার অপেক্ষা রাখে না। মাঝে মাঝেই নানা সমীক্ষার মাধ্যমে পরিবেশ-বিজ্ঞানীরা অদূর ভবিষ্যতের যে ভয়াল চিত্র তুলে ধরেন তা যদি যথাযথ গুরুত্ব সহকারে বিচার করে দ্রুত সঠিক ব্যবস্থা না নেয়া হয়, তবে চরম বিপদ থেকে রেহাই মিলবে না।
পৃথিবীর এই দুর্দশার জন্য অবশ্য মানুষেরাই দায়ী।
মানুষ, তুমি নাকি বিদ্যায়-জ্ঞানে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠজীব? জীব ও উদ্ভিদ-জগৎকে নির্বিচারে ধ্বংস করছ। সারাক্ষণ নিজেদের কবর নিজেরাই খুঁড়ছ, এই নাকি শ্রেষ্ঠত্বের নিদর্শন। এতই যদি শ্রেষ্ঠ, তবে দুনিয়ার সব প্রাণীই কেন আজ তোমাদের ভয় পায়, ঘৃণা করে। সারাক্ষণ তোমাদের ধ্বংস কামনা করে। এমন শ্রেষ্ঠ হয়েই বা কী লাভ? আজকের আত্মসর্বস্ব দুনিয়ায় তুমি হলে অসাম্যের দানব! জগৎময় চৈতালী ঘূর্ণি। চারদিকে নীলকণ্ঠ আগুন।
বস্তুত, প্রকৃতির রিমডেলিংয়ের যুগে মানুষ তার নিজস্ব বুদ্ধি-জ্ঞান আর ছেনি, হাতুড়ি, মাটি ও পাথর কুঁদে আপন প্রয়োজনে সৃষ্টি করেছিল মাথা গোঁজার ঠাঁই। আবহমানকাল টিকে থাকার এটা ছিল জান্তব সংগ্রাম। সীমিত খাদ্য ও বাসস্থানের বাধা অতিক্রম করে যে অপত্য সৃষ্টি, ভবিষ্যতে বেঁচে থাকার জন্য প্রকৃতি তাকেই নির্দিষ্ট বা নির্বাচন করে থাকে।
বলাবাহুল্য, মানুষের জীবনের পেছনে রয়েছে অনন্ত বিস্ময়। প্রতিকূল পরিবেশের সাথে সংগ্রাম করতে গিয়ে এই জটিল জগতে নিতান্ত সাধারণ মানুষের মধ্যেও এমন সব গুণ বিকশিত হয়ে ওঠে যা স্মরণে রাখলে পরবর্তীকালের সংগ্রামী পথিকরা অবিশ্বাস্য সাহস ও অনুপ্রেরণা লাভ করতে পারে।
আসলে মানুষের শক্তি কত ক্ষুদ্র কত সীমিত তা প্রমাণ হয়ে যায় যখন ভূমিকম্পে খান খান হয়ে যায় পুরো একটা শহর তথা দেশ। অধুনা অতীতে প্রতিবছরই পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে কমপক্ষে ৫০টির মতো ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশও ভূমিকম্প এবং সুনামির ঝুঁকিতে অবস্থান করছে। ভূমিকম্প এবং সুনামি যে কারণে ঘটে থাকে তার জন্য মানুষও দায়ী। কেননা, সমুদ্রের নিচে চালানো হয় পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ।
এ ছাড়া নির্বিচারে বৃক্ষনিধন কত বড় অপরাধ! একটি বড় বিশাল গাছ, যাকে আকাশ কাছে টেনে নেয় পরম মমতায়। সূর্যের স্নেহে ধন্য গাছ। মানুষের নাগালের বাইরে গাছের সাথে আকাশের সেতু হয় তৈরি। প্রাণী ও বৃক্ষপুষ্প সমন্বয়ে প্রকৃতি বাস্তবে এক অখণ্ড সূত্রে নিবদ্ধ। প্রকৃতি তথা আকাশ-বাতাস, গাছপালা, নদীনালা ও পশুপাখি আমাদের চির আত্মীয়। সেখানে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে মানবজীবন ও জীবনযাপনের নানা অনুষঙ্গ।
আমাদের আরো আশঙ্কার কারণÑ নিয়ম-নীতি তোয়াক্কা না করেই ক্রমাগতভাবে আকাশছোঁয়া ভবন নির্মিত হচ্ছে। অথচ ভূমিকম্প প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা তেমন নেই। দুর্যোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনার অসহায়তা ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না।
অপর দিকে, পৃথিবীর প্রায় সবকটা জিনিসেই দূষণ বেড়ে যাচ্ছে। এরপরও মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসের প্রক্রিয়া যে স্বাভাবিক চলছে, এর চেয়ে বুঝি বড় আনন্দ আর কিছুই হয় না। আদতে, জীবনটাই কেমন তালকানা হয়ে গেছে।
বলাবাহুল্য, পৃথিবীর আলো-হাওয়া গাছ-প্রাণী আর যা কিছু সম্পদ, যা আমাদের জীবন ধারণের কাজে লাগে, সব কিছুর কাছেই আমরা চিরদিন ঋণী। সমুদ্র জঙ্গল পশু ও প্রকৃতিকে ঘিরে যে জীবনদর্শন গড়ে ওঠে, এ সব কিছুকে দেখতে হয় ভালোবাসার চোখ দিয়ে।
বৃষ্টিবিহ্বল প্রকৃতির অভ্যন্তরে মাটির শরীর থেকে জল শুষে নিয়ে গাছ বেঁচে থাকে। তেমনি সবুজেভরা মাঠ পুকুর জঙ্গলপথ আগুন, পানি, মাটি, পাথর, হাওয়া ও আকাশ সবকিছু অবিচ্ছিন্ন এক আনন্দস্রোতে আমাদের কোথাও হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা।
কিন্তু আজ দেউলিয়া স্বপ্ন সব! কাল তুমি ঝরাপাতা। সুদূর যেন স্তব্ধ! আত্মপ্রত্যয়ের খোলস ছেড়ে শুনতে হয় নিয়তির অট্টহাসি- ‘অসীম জগৎ-চরাচর, অবশেষে শ্রান্ত কলেবর, নিদ্রা আসে নয়নে তাহার, আকর্ষণ হতেছে শিথিল, উত্তাপ হতেছে একাকার’।

 


আরো সংবাদ



premium cement