২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ভুটানও হাতছাড়া হচ্ছে ভারতের!

-

নেপাল হাতছাড়া হয়ে গেছে ভারতের, মালদ্বীপও গেছে। শ্রীলঙ্কায় কলকাঠি নেড়ে পছন্দের সরকার মতায় এনেও সুবিধা হচ্ছে না। পাকিস্তান আরো আগেই বৈরী। এবার ভুটানও মনে হচ্ছে ভারতের হাত থেকে ফসকে গেল। নিজ আঙিনাতেই ভারতের ভয়াবহ করুণ অবস্থা ফুটে উঠেছে। আর এতে যে চীন খুশি হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নির্বাচনের দিকে দুই পরাশক্তিই প্রবল নজর রেখেছিল। বিশেষ করে, গত বছরের দোকলাম সঙ্কটের পর এই নির্বাচনটি চীন ও ভারত উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
শনিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) অনুষ্ঠিত পার্লামেন্টের নি¤œক ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির (এনএ) প্রথম পর্যায়ের নির্বাচনে বড় রকমের বিপর্যয় ঘটেছে ভুটানের বিদায়ী মতাসীন দল পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (পিডিপি)। দলটি কোয়ালিফাই করতেই ব্যর্থ হয়েছে। এই ফল পর্যবেক ও রাজনীতিবিদ নির্বিশেষে সবাইকে বিস্মিত করেছে। নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণার এক ঘণ্টার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে পরাজয় মেনে নেন।
এ নির্বাচনে রেকর্ড সংখ্যক ৬৬.৩ শতাংশ ভোট পড়েছে। ২০১৩ সালে পড়েছিল ৫৫.৩ শতাংশ।
ভুটান নির্বাচন কমিশনের দেয়া তথ্যমতে, দ্রুক নিয়ামরুপ সগপা (ডিএনটি) ৩১.৫ শতাংশ ভোট পেয়ে শীর্ষস্থান লাভ করেছেন। এর পরই রয়েছে দ্রুক ফুয়েনসাম সগপা (ডিপিটি), পেয়েছে ৩০.৬ শতাংশ ভোট। চতুর্থ দল ভুটান কুয়েন-নিয়াম (বিকেপি) পেয়েছে ৯.৭ শতাংশ ভোট।
ভুটানের সাধারণ নির্বাচনের নিয়ম অনুযায়ী প্রথম রাউন্ডে সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া দুই দল চূড়ান্ত রাউন্ডে অংশ নেবে। ফলে ২৭.২ শতাংশ ভোট পাওয়া পিডিপিকে প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নিতে হচ্ছে। ১৮ অক্টোবর চূড়ান্ত রাউন্ড ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
ধারণা করা হচ্ছে, এবার সর্বোচ্চ ভোট পড়ার কারণÑ পোস্টাল ব্যালট এবং এটাই ফলাফল নির্ধারণে ভূমিকা রেখেছে।
এবার চার লাখ ৩৮ হাজার ৬৬৩ জন নিবন্ধিত ভোটারের প্রায় ৩০ শতাংশ ছিলেন পোস্টাল ভোটার। ২০১৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ১২.৭ শতাংশ। পোস্টাল ভোটারদের ৮১.১ শতাংশ ভোট দিয়েছেন।
পোস্টাল ব্যালট মূলত আমলা, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ও তাদের পরিবার, করপোরেট কর্মচারী, প্রবাসী ভুটানি ও বিশেষ প্রয়োজনসম্পন্ন ভোটারদের জন্য।
শনিবার স্থানীয় সময় বিকেল ৫টায় ভোট গ্রহণ বন্ধ হওয়ার পর প্রথম পোস্টাল ব্যালটের ফলাফল আসা শুরু করে। প্রাথমিক ফলাফলেই বোঝা যায়, ২০১৩ সালের নির্বাচনের প্রাথমিক রাউন্ডে বাদ পরা ডিএনটি বেশ ভালো করেছে। এরপর রয়েছে ডিপিটি। পরে ইভিএমের ফল আসার পরও আগের ফলাফলে তেমন কোনো হেরফের হয়নি।
ডিএনটির দলীয় প্রধান লোতে শেরিং ইউরোলজিস্ট। তিনি নির্বাচনী প্রচারণায় ধনী-গরিব বৈষম্য কমিয়ে আনা ও বেকারত্ব মোকাবেলার ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়াশোনা করেছেন বাংলাদেশে। ধারণা করা হচ্ছে, তিনিই হতে যাচ্ছেন ভুটানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী।
প্রথম রাউন্ড থেকে পিডিপি বিদায় নেবে এটা কেউ ভাবতে পারেনি। লোতে বলেন, ‘আমরাও খুব অবাক হয়েছি। পিডিপি ভালো করবেই বলে আমাদের ধারণা ছিল।’
ডিপিটির প্রেসিডেন্ট প্রেমা গিয়ামতসো একই কথা বলেন। তিনি ছিলেন বিদায়ী পার্লামেন্টের বিরোধী দলীয় নেতা। তিনি বেশ বিনয়ের সাথে বলেন যে, পিডিপির কেন এই বিপর্যয় হয়েছে সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত নন। এটা ‘এন্টি-ইনকমবেন্সি ফ্যাক্টর’ হতে পারে।
২০১৩ সালে নির্বাচনের প্রাথমিক রাউন্ডে তখনকার মতাসীন দল ডিপিটি পেয়েছিল ৪৫ শতাংশ ভোট। আর পিডিপি পেয়েছিল ৩৩ শতাংশ। কিন্তু চূড়ান্ত রাউন্ডে পিডিপি বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে।
২০০৮ সাল থেকে প্রতিটি নির্বাচনে ভুটানের জনগণ সরকার পরিবর্তন করছে।
গত এপ্রিলে উচ্চক তথা ন্যাশনাল কাউন্সিলের নির্বাচনেও এই প্রবণতা দেখা গেছে। ২৫ সদস্যের মধ্যে মাত্র পাঁচজন পুনর্নির্বাচিত হতে পেরেছিলেন।
ভারত কি ফ্যাক্টর?
২০১৩ সালে ভুটানের নির্বাচনে ভারত-ফ্যাক্টর বেশ প্রভাব ফেলেছিল। চূড়ান্ত দফা ভোট গ্রহণের আগে ভুটানে রফতানি করা জ্বালানি তেল ও রান্নার গ্যাসের ওপর ভর্তুকি প্রত্যাহার করে নেয় ভারত। ফলে বেশ দুর্ভোগে পড়তে হয় ভুটানবাসীকে। ভারত বিরোধী হিসেবে পরিচিত তৎকালীন মতাসীন দল ডিপিটিকে বিদায় করতে নয়াদিল্লি কাজটি করেছিল বলে ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয়। ডিপিটির প্রধানমন্ত্রী জিগমে থিনলে ২০১২ সালে রিও ডি জেনেইরোতে চীনের প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাও-এর সাথে সাাৎসহ আরো কিছু পদপে গ্রহণ করেছিলেন, যা ভারতের পছন্দ হয়নি। নির্বাচনের ফলাফলেও এর প্রভাব দেখা যায়। মতায় আসে পিডিপি।
তবে এবারের নির্বাচনে ভারতের সাথে ভুটানের সম্পর্কের বিষয়টি তেমন আলোচনায় ছিল না। অবশ্য নির্বাচনী প্রচারণায় ডিপিটির বিরুদ্ধে ভারতের সাথে সম্পর্কে অবনতি ঘটানোর চেষ্টার অভিযোগ করে পিডিপি। তবে ডিপিটি বলে আসছে যে, ভারতের সাথে সম্পর্ক ‘সবসময় দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখতে হবে।’
২০১৮ সালে ডিপিটির নির্বাচনী ইশতেহারের পররাষ্ট্র নীতি অংশে উল্লেখ করা হয় যে, নির্বাচিত হলে তারা ভারতের জনগণ ও সরকারের সাথে সম্পর্ক আরো জোরদারের চেষ্টা চালাবে।
ডিএনটির ইশতেহারে পররাষ্ট্র নীতি নিয়ে আলাদা কোনো অংশ নেই। কিন্তু ভারতের কথা বেশ কয়েকবার উল্লেখ করা হয়েছে, বিশেষ করে অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনার প্রসঙ্গে।
অর্থনীতি অধ্যায়ে বলা হয়, রফতানি বাস্কেট নিয়ে ডিএনটি উদ্বিগ্ন, যার বড় অংশজুড়ে আছে জলবিদ্যুৎ।
ডিএনটির মতে, ভুটানের অর্থনীতি মূলত জলবিদ্যুৎকেন্দ্রিক। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ীণ ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে, যা তরুণ প্রত্যাশীদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়েছে। ভুটানের বৈদেশিক ঋণের ৭৫ শতাংশ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মাধ্যমে বলেও ডিএনটি উল্লেখ করে।
বেসরকারি খাতে প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনতে চায় ডিএনটি।
দলটি জানায়, ভুটানের রফতানি পণ্যের ৮০ শতাংশ ভারতে যায়, যা অর্থনীতির একটি দুর্বল দিক। যেকোনো সময় এতে বিপর্যয় ঘটতে পারে।
দলটি ভারত থেকে জ্বালানি আমদানির বর্তমান নীতি পর্যালোচনারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর মাধ্যমে নির্ভরতা কমানো ও ব্যালেন্স অব পেমেন্ট পরিস্থিতি জোরদার করা হবে।
কোনো দলের নির্বাচনী ইশতেহারেই বিবিআইএন সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। পিডিপি সরকার ভারতের চিন্তা-প্রসূত এই চুক্তি পার্লামেন্টে অনুমোদন করার চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু উচ্চক চুক্তিটি অনুমোদন করতে অস্বীকৃতি জানায়। এর বিরুদ্ধে জনমত প্রবল হয়ে উঠলে পিডিপি সরকার চুক্তি থেকে ভুটানকে প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়।
নির্বাচনে যে দলই জিতুক না কেন, আগামী সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় ইস্যু হবে তাদের দুই বড় প্রতিবেশী ভারত ও চীনের সাথে সম্পর্কে ভারসাম্য রাখা।
বেইজিং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। জুলাই মাসে চীনের ভাইস পররাষ্ট্রমন্ত্রী কোং শুয়ানইউ ভুটান সফর করেন। নয়াদিল্লির অনেকেই এটা নিয়ে ভ্রƒরু কুঁচকেছে। এই সফরে চীনা নেতা চীন-ভুটান সীমান্ত বিরোধ মিটিয়ে ফেলার ব্যাপারে ভুটানকে আশ্বাস দেন। সীমান্ত ইস্যু সমাধানের জন্য চীন এ পর্যন্ত ২৪ রাউন্ড বৈঠকও করেছে ভুটানের প্রতিনিধিদের সাথে। ভারতের অনেক পর্যবেকই মনে করেন, ভুটানের সাথে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন থেকে খুব বেশি দূরে নেই চীন। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement