২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নতুন উচ্চতায় চীন-রাশিয়ার সম্পর্ক

-

চীন ও রাশিয়ার মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মাত্রা বর্তমান সময়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে দেশ দুটির শীর্ষ নেতারা ঘোষণা করেছেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সাম্প্রতিক চীন সফরকালে এই ঘোষণাটি আসে। গত শুক্রবার বেইজিংয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের সাথে বৈঠক করেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। এ সময় শি জিন পিং চীন-রাশিয়ার মধুর সম্পর্কের কথা উল্লেখের পাশাপাশি পুতিনকে তার ‘সর্বোত্তম ও অন্তরঙ্গ বন্ধু’ হিসেবেও উল্লেখ করেন।
পুতিনের এই সফরকালে দুই দেশের মধ্যে পরমাণু সহযোগিতার ক্ষেত্রে ৩ বিলিয়ন ডলারের এবং শিল্প বিনিয়োগ তহবিল গঠনের এক বিলিয়ন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। বৈঠককালে দুই নেতা কোরীয় উপদ্বীপে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং ইরানের সাথে স্বাক্ষরিত আন্তর্জাতিক পরমাণু চুক্তি যেকোনো মূল্যে বহাল রাখারও ঘোষণা দেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের সাথে স্বাক্ষরিত পরমাণু চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর এবং উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সাথে বৈঠকে বসার পূর্ব মুহূর্তে চীন ও রাশিয়ার শীর্ষ নেতারা এই ঘোষণা দেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বিভিন্ন বিষয়ে চীন ও রাশিয়ার এই দুই নেতা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিন্ন কৌশল গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন। ইউরোপের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের নানা বিষয়ে যখন দ্বন্দ্ব চলছে তখন চীন ও রাশিয়ার যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী অভিন্ন অবস্থান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যথেষ্ট চাপের মুখে ফেলবে।

বৈরিতা থেকে বন্ধুত্ব
বিশ্বের দুই বৃহৎ কমিউনিস্ট রাষ্ট্র চীন ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে বৈরিতার বা বিরোধের মূল কারণ ছিলÑ বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্ট আন্দোলনের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব বিস্তার নিয়ে। বিষয়টি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে ১৯৫০-এর দশকের শেষের দিকে বৈরিতা চরম পর্যায়ে পৌঁছে। এর পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে বিরোধ ও সম্পর্কের অবনতির অন্যতম কারণ ছিল। সীমান্ত বিরোধ ১৯৬০-এর দশকের শুরুর দিকে বড় ধরনের যুদ্ধের আশঙ্কাও তৈরি করেছিল। এমনকি ১৯৬৯ সালে সংক্ষিপ্ত আকারে যুদ্ধে জড়িয়েও পড়েছিল চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। দুই দেশের মধ্যে বৈরিতার এই সময়টিতে চীন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলে সোভিয়েত ইউনিয়নের মোকাবেলায়। তবে ১৯৭৬ সালে চীনা নেতা মাও সেতুংয়ের মৃত্যুর পর চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে বৈরিতার সম্পর্ক কমতে থাকে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর গড়ে উঠে রাশিয়ান ফেডারেশন। অবসান ঘটে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে গড়ে উঠা মৈত্রীর সম্পর্কের। ১৯৯২ সাল থেকেই চীন ও রুশ ফেডারেশনের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি ঘটতে থাকে। ওই বছরের ২৩ ডিসেম্বর রুশ প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন প্রথম সরকারি সফরে চীন যান। ওই সময় দুই দেশের যৌথ ঘোষণায় বলা হয়, তারা ‘গঠনমূলক অশীদারিত্বের সম্পর্ক’ গড়ে তুলবেন। ১৯৯৬ সালে চীন ও রাশিয়ার মধ্যে ‘কৌশলগত অংশীদারিত্ব’ এবং ২০০১ সালে দুই দেশের মধ্যে ‘বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। তখন থেকেই দুই দেশ এই দৃষ্টিভঙ্গিতে একমত হয় যে, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক দৃশ্যপটে যুক্তরাষ্ট্রই তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ। বর্তমানে চীন ও রাশিয়ার মধ্যে সামরিক, অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার সম্পর্ক বিরাজ করছে এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয়ে তারা পরস্পরকে সহযোগিতা করে থাকে।
চীন ও রাশিয়ার মধ্যে পরমাণু ক্ষেত্রে সহযোগিতার যে চুক্তি হয়েছে তা থেকে চীন যথেষ্ট লাভবান হবে। রাশিয়ায় সরকারি প্রতিষ্ঠান রোসাটম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরমাণু জ্বালানিবিষয়ক বৃহৎ প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুপরিচিত। এই প্রতিষ্ঠানটি চীনের তিনটি বড় পরমাণু জ্বালানি প্রকল্পে সহযোগিতা করবে। এর ফলে পশ্চিমা পরমাণু কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর চীনের নির্ভরশীলতা অনেকটাই কমে যাবে। একই সঙ্গে রাশিয়ার সহযোগিতায় এ ক্ষেত্রে চীনা প্রকৌশলীদের দক্ষতা আরো বাড়বে।
পুতিন ও শি জিন পিংয়ের মধ্যে শীর্ষ বৈঠকের পর চীনা প্রেসিডেন্ট সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট পুতিন এবং আমি মনে করি যে, চীন-রাশিয়ার ব্যাপকভিত্তিক কৌশলগত অংশীদারিত্ব পরিপক্ব সুদৃঢ় ও স্থিতিশীল। বিশ্বের দু’টি বৃহৎ দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ের এই সম্পর্ক কৌশলগতভাবে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।’ চীনা নেতা আরো বলেছেন, ‘আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে যে পরিবর্তনই আসুক না কেন, চীন ও রাশিয়া তাদের পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষায় একে অপরকে সমর্থন দিয়ে যাবে।’ শি জিন পিং চীনের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত এক অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ‘চীনা জনগণের ভালো ও পুরনো বন্ধু’ হিসেবে উল্লেখ করেন এবং তাকে চীনের প্রথম ‘ফ্রেন্ডশিপ মেডেল’ পরিয়ে দেন। এ সময় চীনা প্রেসিডেন্ট বলেন, প্রেসিডেন্ট পুতিন একটি বৃহৎ ও মহান দেশের নেতা এবং বিশ্বে খুবই প্রভাবশালী একজন রাষ্ট্রনায়ক। তিনি আমার সবচেয়ে উত্তম ও অন্তরঙ্গ বন্ধু।
যৌথ সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট পুতিন অবশ্য খুব বেশি কথা বলেননি। তিনি বলেছেন, চীন ও রাশিয়া কোরীয় উপদ্বীপে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী। এ সময় পুতিন ও শি জিন পিং ইরানের পরামণু কর্মসূচি নিয়ে ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত আন্তর্জাতিক চুক্তি বহাল রাখার ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের সাথে স্বাক্ষরিত এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর চুক্তিটি হুমকির মুখে পড়ার পরিপ্রেক্ষিতে রুশ ও চীনা প্রেসিডেন্ট চুক্তি বহাল রাখার ব্যাপারে তাদের এই অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন আঞ্চলিক নিরাপত্তা গ্রুপ সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও)-এর শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের জন্য প্রেসিডেন্ট পুতিন চীন সফরে যান। চীনের উপকূলীয় নগরী কিংদাওয়ে এই শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানিও এই সম্মেলনে যোগদান করেন। সম্মেলনের সাইড লাইনে রুহানির সাথে পুতিন বৈঠকও করেছেন। ইরান বর্তমানে এসসিও’র পর্যবেক্ষক দেশ। প্রেসিডেন্ট পুতিন ইরনাকে সংগঠনটির পূর্ণ সদস্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

একঘরে যুক্তরাষ্ট্র, প্রভাব বাড়াচ্ছে চীন-রাশিয়া
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে যুক্তরাষ্ট্র যখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একঘরে হয়ে পড়ছে তখন বিভিন্ন দেশের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলছে রাশিয়া ও চীন। এসসিও সম্মেলনে চীন, রাশিয়া ও মঙ্গোলিয়ার মধ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে তিন দেশের অর্থনৈতিক করিডোর যা হবে নতুন শিল্প রোডের গুরুত্বপূর্ণ অংশ সেটির কাজ জোরদার করার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। নতুন এই সিল্ক রোড বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) নামে পরিচিত। চীনে রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট পয়েন্ট হয়ে উঠেছে মঙ্গোলিয়া। অন্য দিকে, আর্কটিক সাগরে নতুন নৌরুট গড়ে তোলার দিকেও নজর দিয়েছেন পুতিন ও শি জিন পিং। নর্দান সি-রুট নামে পরিচিত এই নৌরুটে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পাশাপাশি অন্য ধরনের অবকাঠামো নির্মাণেও পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ঠিক এর বিপরীত পথেই বলছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সাথে পরিকল্পিত বৈঠক হঠাৎ করে বাতিল করে দিয়ে পরদিনই আবার মত পরিবর্তন করে বৈঠক করার কথা বলেন। বৈঠকের আগেই ট্রাম্প বলে দিয়েছেন, তিনি কিমকে হোয়াইট হাউজে আমন্ত্রণ জানাবেন না। আবার কানাডায় শিল্পোন্নত দেশগুলোর গ্রুপ জি-৭ এর বৈঠকে গিয়ে তিনি সবক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের কথা বলেন। অথচ এর আগেই তিনি ইউরোপ ও কানাডার অ্যালুমিনিয়াম ও স্টিলের আমদানির ওপর শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন। আবার হুট করেই তিনি জি-৭ এর বৈঠক ত্যাগ করেছেন। তার এই আচরণে বিরক্ত ইউরোপের নেতারা।
পরিশেষে এ কথা বলা যায় যে, অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে বেইজিং ও ওয়াশিংটনের মধ্যে উত্তেজনা যত বাড়ছে বেইজিং ও মস্কোর মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা ততই বাড়ছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুবই উদ্বেগের বিষয়। যদিও যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়াকে চাপে রাখার জন্য দেশটির সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন কোম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। কিন্তু তাতে দমে যায়নি রাশিয়া। চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলে যুক্তরাষ্ট্রকে পাল্টা চাপের মুখে ফেলে দিয়েছে রাশিয়া। ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের প্রায় সব ক্ষেত্রেই এখন যুক্তরাষ্ট্র কোণঠাসা। আর সুবিধাজনক অবস্থানে রাশিয়া ও চীন। হ


আরো সংবাদ



premium cement