১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ জিলকদ ১৪৪৫
`


সোনারগাঁওয়ে রেলওয়ের ২০০ কোটি টাকার সম্পত্তি বেদখল

সোনারগাঁওয়ে রেলওয়ের জমিতে গড়ে ওঠা রেস্টুরেন্ট ও স’মিল হনয়া দিগন্ত -

মদনগঞ্জ-নরসিংদী রেলপথে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে রেলওয়ের প্রায় ২০০ কোটি টাকার সম্পত্তি বেদখল হয়ে আছে। মদনপুর থেকে প্রভাকরদী পর্যন্ত প্রায় সাত কিলোমিটার এলাকায় জমিগুলো স্থানীয় প্রভাবশালী, শিল্প মালিক ও সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা দলের প্রভাব খাটিয়ে দখল করে রেখেছেন। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জমিগুলো দখলমুক্ত করার কোনো উদ্যোগ না নেয়ায় সম্পত্তিগুলো বেহাত হয়ে যাচ্ছে। এতে করে সাধারণ মানুষের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজসে এসব জমি দখল হয়ে যাচ্ছে। তবে রেলওয়ে ঢাকা বিভাগের মদনগঞ্জ-নরসিংদী সড়কের কানুনগো অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, রেললাইনটি সচল না থাকার কারণে জমিগুলো বেশি বেহাত হয়ে যাচ্ছে। অচিরেই দখলদারদের উচ্ছেদের ব্যবস্থা নেয়া হবে।
রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, রেলওয়ের জমি রেললাইন থেকে দুই পাশে ১২০ ফুট চওড়া। কোথাও কোথাও ৪০০ ফুট। তবে রেলস্টেশন এলাকায় দুই হাজার ফুট এলাকাজুড়ে জমি রয়েছে। রেলওয়ে থেকে শুধু কৃষিভিত্তিক জমি লিজ দেয়া হয়। বাণিজ্যিক লিজ অনেক আগেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে কৃষিলিজও বন্ধ রয়েছে। কৃষি লিজ নিয়ে শুধু কৃষি আবাদ করা যাবে। শ্রেণী পরিবর্তন করে রাস্তা, বিপণিবিতান, পাকা স্থাপনা, মার্কেট নির্মাণ বা দেয়াল দিয়ে জমি দখলে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। এগুলো করে থাকলে সবই অবৈধ দখলদার হিসেবে গণ্য হবেন। বর্তমানে মদনগঞ্জ থেকে নরসিংদী রেলপথে সকল দখলদারই অবৈধ হিসেবে জমি দখলে রেখেছেন। তবে কোনো শিল্প মালিক জমির শ্রেণী পরিবর্তন করতে হলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে। এ সড়কে কোনো শিল্প মালিক জমির শ্রেণী পরিবর্তনের কোনো প্রকার অনুমতি নেননি। ফলে সব শিল্প মালিক অবৈধ দখলদার হয়ে রাস্তা নির্মাণ করেছেন। তাদের বিষয়ে শিগগিরই ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
জানা যায়, মদনপুর থেকে প্রভাকরদী পর্যন্ত রেলওয়ের জমির পাশে ছোট বড় মিলিয়ে অর্ধশতাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। তারা রেলওয়ের জমি লিজ না নিয়েই ওই প্রতিষ্ঠানে যাতায়াতের জন্য রাস্তা নির্মাণ করছেন। কেউ কেউ রেলওয়ের জমি দেয়াল দিয়ে দখলে নিয়ে নিয়েছেন। এ ছাড়াও রেলওয়ের জমি দখল করে কয়েকটি স্থানে গড়ে তোলা হচ্ছে আধা কাঁচা মার্কেট। শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকরা জমি লিজ নেয়ার কথা বললেও আদতে কেউ জমি লিজ নেননি। এ ছাড়াও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ লিজ দেয়া জমিগুলোর লিজ বাতিল করেছে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। ফলে এ সড়কে আর কোনো লিজকৃত জমি নেই। সব দখলদারই এখন অবৈধ দখলদার হিসেবে জমি দখলে রেখেছেন। এ ছাড়াও নয়াপুর বাজার এলাকায় রেলওয়ের প্রায় চার কোটি টাকার জমি স্থানীয় প্রভাবশালী একটি সিন্ডিকেট অবৈধভাবে দখল করে অন্যত্র বিক্রি করে দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রভাবশালীরা কাঁচা-পাকা ঘর ও প্লট নির্মাণ করে বিভিন্ন বিপণিবিতানসহ অন্যান্য স্থাপনা তৈরি করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেছেন।
জানা যায়, নয়াপুর এলাকায় অবৈধ দলখদার বাচ্চু মেম্বার ও আবু সিদ্দিক মিয়া রেলওয়ের সম্পত্তি বিক্রি করে দেয়ার পর নামধারী আওয়ামী লীগ নেতা মনির হোসেন, নয়াপুর বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান, সাদিপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন, শিমুল, শামীম, বিএনপি নেতা তাওলাদ মুন্সি, আমিনুল, যুবলীগ নেতা জসিম, আসাদুর রহমান আসাদ, সালাউদ্দিন মাসুম ও শামীম মিয়া চার দিকে টিনের বেড়া দিয়ে আড়াল করে ঘর নির্মাণ করেছেন। টিনের বেড়ার ভেতরে তাদের সিন্ডিকেটের একটি অফিস কক্ষ, আধা কাঁচা ছোট ছোট ৫০ থেকে ৬০ দোকানঘর ও কয়েকটি প্লট নির্মাণ করা হয়েছে। এসব কাজের তদারকি করছেন তারা নিজেরাই। এ সিন্ডিকেটের প্রধান হিসেবে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আবদুর রশিদ মোল্লা আড়ালে কাজ করছেন বলে বাজারের ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন। এ দিকে নামবিহীন বাজার কমিটি নামে একটি কমিটি করে ১১০ জন সদস্য নিয়ে একটি সিন্ডিকেট করে তদারকি করা হচ্ছে। হাতুরাপাড়া এলাকায় রেলওয়ের জমি দখল করে ছাত্রলীগ নেতা মাসুদ, ইকবাল ও ফারুক বালুর ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।
তালতলা এলাকায় জামপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সামসুল আলম, প্রভাবশালী তুহিনুর রহমান, আওয়ামী লীগ নেতা ফিরোজ মিয়া, জব্বর আলী, আমিন, হালিম, রহিম, বিএনপি নেতা সোনা মিয়া সুনু, জামপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান কামরুল হাসান লিটন, আলী আকবর, আব্দুল কাদির রেলওয়ের জমি দখলে নিয়েছেন। অনেকগুলো শিল্পপ্রতিষ্ঠান রেলওয়ের জমি দখল করে রাস্তা নির্মাণ করেছে। সাদিপুর ইউনিয়নের নয়াপুর এলাকার সাবেক ইউপি সদস্য বাচ্চু মিয়া ও আবু সিদ্দিক নামের দুই ব্যক্তি নয়াপুর মাছ বাজার এলাকায় রেলওয়ের প্রায় সাড়ে তিন বিঘা জমি অবৈধভাবে দখল করেছেন। দখলকৃত জমি তারা একটি সিন্ডিকেটের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ সম্পত্তির বিক্রি করা হয়েছে তিন কোটি ৯৪ লাখ টাকায়। এ জমির বর্তমান বাজারমূল্য রয়েছে প্রায় সাত কোটি টাকা।
রেলওয়ে কমলাপুর ভূসম্পত্তি বিভাগ থেকে জানা যায়, দখলদার সিদ্দিক মিয়া তথ্য গোপন করে কৃষিকাজের জন্য রেলওয়ের কাছ থেকে ১.৭ একর জমি লিজ নিয়েছিলেন। তথ্য গোপন করে লিজ নেয়ার কারণে ২০১২ সালে তার লিজ বাতিল করে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া রেলওয়ে তার কাছে জমির ক্ষতিপূরণের জন্য তার বিরুদ্ধে একটি নোটিশ জারি করে। পরে রেলওয়ে তার লিজ বাতিল করে সে বছরই ওই জমি আরেকজনের কাছে লিজ দেয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলওয়ের এক কর্মকর্তা জানান, দখলদাররা দখলকৃত সম্পত্তিতে পাকা-আধাপাকা দোকানঘর নির্মাণ ও প্লট করে জমি বিক্রি করছেন। অবৈধ দখল নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ একাধিকবার অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করলেও স্থানীয় প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। অথচ রেলওয়ে ইজারায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, রেলওয়ে থেকে লিজকৃত সম্পত্তির কোনো শ্রেণী পরিবর্তন করা যাবে না। লিজের সম্পত্তিতে কোনো আধা পাকা বা পাকা ভবন নির্মাণ করা যাবে না। শুধু কৃষিকাজে এ জমি ব্যবহার করতে হবে।
নয়াপুর বাজারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আমজাদ ও মহিউদ্দিন বলেন, ‘আমরা দখলদারদের কাছ থেকে আজীবনের জন্য পজিশন কিনে নিয়েছি। এ জন্য দখলদারদের কাছ থেকে লিখিত স্ট্যাম্পের মাধ্যমে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছি।’
অভিযুক্ত সাবেক ইউপি সদস্য বাচ্চু মিয়া বলেন, আমি আমার কেনা সম্পত্তি বিক্রি করেছি। রেলওয়ের কোনো সম্পত্তি বিক্রি করিনি। রেলওয়ের সম্পত্তি আমার বিক্রি করার অধিকার নেই।’
দখলদার সিদ্দিক মিয়া বলেন, ‘আমার নিজের লিজকৃত সম্পত্তি স্থানীয় চেয়ারম্যানের লোকজন ক্ষমতার দাপটে জোরপূর্বক দখলে নিয়ে মার্কেট নির্মাণ করে বিক্রি করে দিয়েছেন। আমি কোনো রেলওয়ের জমি বিক্রি করিনি। তা ছাড়া রেলওয়ে থেকে আমার নামে লিজকৃত সম্পত্তি বাচ্চু মেম্বার বাতেনের কাছে বিক্রি করেছেন; যার প্রমাণ আমার কাছে রয়েছে।’
সাদিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুর রশিদ মোল্লা জানান, এই সিন্ডিকেটের সাথে তার জড়িত হওয়ার বিষয়টি ভিত্তিহীন। এগুলোর সাথে তিনি জড়িত নন। তা ছাড়া অনেকে কৃষি লিজ নিয়ে দোকান ঘর তৈরি করে ব্যবসা করছেন।
রেলওয়ে ঢাকা বিভাগের কানুনগো ইকবাল মাহমুদ দখলদারদের সাথে যোগসাজশের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, মদনগঞ্জ-নরসিংদী রেলসড়কটি বন্ধ থাকার কারণে প্রভাবশালীরা জায়গাগুলো অবৈধভাবে দখল করে নিয়েছে। অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। বর্তমানে চলমান অবস্থায় রয়েছে। এখন কেউ দখল করে থাকলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার পর উচ্ছেদ করা হবে।
রেওলয়ের ঢাকা বিভাগের স্টেট অফিসার নজরুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, মদনগঞ্জ-নরসিংদী রেল সড়কটি পরিত্যাক্ত থাকায় এখানকার জমি দখলদাররা দখল করেছে। এ সড়কের সম্পত্তি সড়ক ও জনপথ বিভাগে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। তাই এ সড়কে সম্পত্তি উদ্ধারে তেমন কোনো তোড়জোর নেই। হস্তান্তর শেষে সড়ক ও জনপথ বিভাগ বেহাত জমিগুলো উদ্ধার করবে।
সোনারগাঁও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রকিবুর রহমান খান জানান, তিনি সোনারগাঁওয়ে নতুন যোগদান করেছেন। রেলওয়ের সম্পত্তি বিক্রির কথা শুনেছেন। যেহেতু এগুলো রেলওয়ের সম্পত্তি তাই তার কিছুই করার নেই। রেলওয়ে সহযোগিতা চাইলে তিনি সহযোগিতা করবেন।
সোনারগাঁও থানার ওসি মনিরুজ্জামান মনির জানান, রেলওয়ের জমি দখলের বিষয়ে মামলা গ্রহণ করা হয়েছে। এ মামলায় অভিযুক্ত দখলাদারদের বিষয়ে তদন্ত করে আদালতে চার্জশিট দেয়া হয়েছে। তবে কর্তৃপক্ষ উচ্ছেদ অভিযান করতে চাইলে পুলিশ তাদেরকে সহযোগিতা করবে।


আরো সংবাদ



premium cement
এক বছর পর দাউদকান্দিতে ড. মোশাররফ গোপালগঞ্জ বশেমুরবিপ্রবিতে সুষ্ঠুভাবে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন রাজধানীতে আ’লীগের শান্তি সমাবেশ আজ কুয়াকাটা সৈকতে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সমুদ্রস্নান সরকারি হাসপাতালে অবৈধ ক্যান্টিন ও ওষুধের দোকান বন্ধের নির্দেশ ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে আ’লীগ জনগণকে নাগরিক হিসেবে বাতিল করেছে : জোনায়েদ সাকি ইবিতে ‘সি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা টঙ্গী পর্যন্ত বর্ধিত হচ্ছে মেট্রোরেলের লাইন মালয়েশিয়ায় বিএমইটি কার্ডের নামে প্রতারণার ফাঁদ : সতর্ক করল দূতাবাস ফিলিস্তিনে হামলার প্রতিবাদে নারায়ণগঞ্জে খেলাফত মজলিসের বিক্ষোভ মিছিল আল মাহমুদপুত্র মীর তারিকের ইন্তেকাল

সকল