৫ হাজার হেক্টর জমিতে রবি ফসল আবাদে অনিশ্চয়তা পাবনায় সোঁতি জালের বাঁধে ২০ বিলে জলাবদ্ধতা

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পাবনা সেচ ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের ডি-২ কাকেশ্বরী নিষ্কাশন ক্যানেলের প্রায় ৩০ কিলোমিটার এলাকার ১০টি স্থানে এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা মাছ ধরার জন্য সোঁতি জালের বাঁধ দিয়েছে। ক্যানেলে সোঁতি জালের বাঁধ দেয়ার কারণে পানি নিষ্কাশন বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় প্রকল্প অভ্যন্তরের ২০টি বিলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এতে আসন্ন রবি মৌসুমে বিলগুলোয় প্রায় পাঁচ হাজার হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরি, পেঁয়াজ, মরিচ, রসুন, সরিষাসহ শাকসবজি আবাদ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বলে ভুক্তভোগী কৃষকরা জানিয়েছেন।
অভিযোগে জানা যায়, পাবনা সেচ ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের বেড়া কৈটোলা পাম্প হাউজ থেকে মুক্তরধর বিল পর্যন্ত পানি নিষ্কাশনের প্রায় ৩০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ডি-২ কাকেশ্বরী নদী নিষ্কাশন ক্যানেল রয়েছে। এ ক্যানেল দিয়ে বর্ষা শেষে সাঁথিয়া ও বেড়া উপজেলার প্রায় ২০টি বিলের পানি কৈটোলা স্লুইস গেট দিয়ে যমুনা নদীতে নিষ্কাশন হয়। বিলগুলো থেকে নদীতে নেমে আসা লাখ লাখ টাকার মাছ শিকারের জন্য কাকেশ্বরী নিষ্কাশন ক্যানেলের ১০টি স্থানে বাঁশ গেড়ে ঘন সোঁতি জালের বাঁধ পাতা হয়েছে। ফলে সাঁথিয়া বেড়া উপজেলার পাবনা সেচ প্রকল্পের কমান্ড এরিয়ার মুক্তরধর, সোনাই বিল, ঘুঘুদহ বিল, জামাইদহ, বড়গ্রাম বিল, খোলসাখালি বিল, কাটিয়াদহ বিল, গাঙ ভাঙার বিল, টেংড়াগাড়ীর বিল, পাশের বেড়া উপজেলার কাজলকুড়া বিল, শিকর বিল, ইটেকাটার বিল, ধলপুরা বিলসহ প্রায় ২০টি বিলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। বিলগুলোর পানি নিষ্কাশন না হওয়ায় প্রায় পাঁচ হাজার হেক্টর জমির পাকা, আধা পাকা আমন ধান পানিতে পচে নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট কৃষকরা।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, বর্ষা মৌসুমে বিলগুলো মাছের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। বর্ষা শেষে বিলের পানির সাথে লাখ লাখ টাকার বিভিন্ন প্রজাতির দেশী মাছ কাকেশ্বরী নদীতে নেমে আসে; কিন্তু এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এই মাছ শিকারের জন্য কাকেশ্বরী নদীতে সোঁতি জালের বাঁধ দেয়ায় পানি নিষ্কাশন বাধাপ্রাপ্ত হয়ে বিলগুলোতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। গাঙভাঙা বিলপাড়ের আফড়া গ্রামের কৃষক মজিবর রহমান জানান, সোঁতি জালের বেড়ার কারণে বিল থেকে পানি নামতে অনেক দেরি হচ্ছে। ফলে বীজতলা তৈরি, পেঁয়াজ, মরিচ, রসুন, সরিষাসহ শাকসবজি আবাদ পিছিয়ে পড়বে। আর বীজতলা তৈরি, পেঁয়াজ, মরিচ, রসুন, সরিষাসহ শাকসবজি আবাদ পেছালে বোরো ধানের আবাদ পেছাবে। এতে ফলন অনেক কম হবে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, ডি-২ নিষ্কাশন ক্যানেল দিয়ে পানি নিষ্কাশন হয়ে বিলগুলোর হাজার হাজার হেক্টর সমতল ভূমি জেগে ওঠে। স্থানীয় কৃষকরা জেগে ওঠা জমিতে বীজতলা তৈরি, পেঁয়াজ, মরিচ, রসুন, সরিষা, শাকসবজিসহ বিভিন্ন ফসল আবাদ করে থাকেন। নিষ্কাশন ক্যানেলে সোঁতি জালের বাঁধ দেয়ায় সৃষ্ট জলাবদ্ধ সমস্যা দ্রুত নিরসন না হলে আসন্ন রবি মৌসুমে প্রায় পাঁচ হেক্টর জমিতে ফসল আবাদ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। এতে স্থানীয় কৃষকরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে তারা জানিয়েছেন। এ দিকে জমিতে আমন ধান পাকতে শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে অনেক ক্ষেতের ধান পেকে গেছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে কৃষকরা পুরোদমে আমন ধান কাটতে শুরু করবেন। জমিতে পানি থাকার কারণে পাকা ধান জমিতেই নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করেছেন তারা।
সাঁথিয়ার আফড়া গ্রামের কৃষক রইজ উদ্দিন খাঁ জানান, আমার ক্ষেতের ধান পেকে গেছে। ক্ষেতে পানি থাকার কারণে ধান কাটতে পারছি না। কবে বীজতলা তৈরি করব আর কবেই বা জমিতে বপন করব। ওই এলাকার কৃষক আলতাফ ও ইউসুফ আলী জানান, আমরা এক দিকে যেমন পাকা ধান কাটতে পারছি না অন্য দিকে বীজতলা দেয়ার জন্য সংগৃহীত ছাই স্তূপ করে সড়কের পাশে রাখা হয়েছে। সময়মতো ওই ছাই জমিতে প্রযোগ করতে না পারলে রোদে শুকিয়ে ছাইয়ের গুণগতমান কমে যাবে।
ডি-২ কাকেশ্বরী নদী নিষ্কাশন ক্যানেল সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, শামুকজানী বাজারের দক্ষিণে, দত্তপাড়া গ্রামের পশ্চিমে, বড়গ্রাম, তালপট্টি নামক স্থানে ব্রিজের পূর্বে ও পশ্চিমে, সাতানীরচর ব্রিজের উজান ও ভাটিসহ প্রায় ১০টি স্থানে মৎস্য শিকারিরা সোঁতি জালের বাঁধ দিয়েছে। বাঁশ গেড়ে তালাই ও পলিথিন বিছিয়ে সোঁতি জালের বাঁধ দেয়ার ফলে কচুরিপানা আটকে পানিপ্রবাহে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। এ দিকে নিষ্কাশন ক্যানেলে যারা সোঁতি জালের বাঁধ দিয়েছেন তারা বলছেন, আমরা পানি উন্নয়ন বিভাগ ও উপজেলা মৎস্য অধিদফতর থেকে জলাশয় লিজ নিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ম্যানেজ করে মাছ শিকার করছি।
বেড়া পানি উন্নয়ন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল হামিদ বলেন, পানি নিষ্কাশনে বাধা সৃষ্টি করে সোঁতি জালের বাঁধ দিয়ে মাছ শিকারের জন্য ক্যানেল কাউকে লিজ দেয়া হয়নি। এ বিষয়ে এলাকায় মাইকিং করে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। কৃষকের ক্ষতি হবে এমনটা আমরা মেনে নেব না। সরেজমিন পরিদর্শন করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
এ ব্যাপারে সাঁথিয়া উপজেলা কৃষি অফিসার সঞ্জিব কুমার গোস্বামী বলেন, গত ৩০ অক্টোবর উপজেলা উন্নয়ন সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। গত সপ্তাহে কৃষক প্রতিনিধিরা সাঁথিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে মৌখিক অভিযোগ দিয়েছেন। তিনি তাৎক্ষণিক সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানদের স্থানীয়ভাবে সোঁতি জালের বাঁধ অপসারণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এতে যদি কাজ না হয় তবে তিনি সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে জানিয়েছেন।
সাঁথিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার এস এম জামাল আহম্মদের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, মৌখিক অভিযোগ পাওয়ার পর স্ব স্ব ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে সোঁতি জালের বাঁধ অপসারণের নির্দেশ দিয়েছি। যদি সোঁতি জাল অপসারণ করা না হয় তা হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।