২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অভাব অনটন আর ক্ষুধার যন্ত্রণায়ও চর ছাড়ে না স্থানীয়রা

নদীতে নাব্যতা না থাকায় অলস পড়ে থাকা যমুনা চরের মাঝিদের নৌকা :নয়া দিগন্ত -

বর্ষ পরিক্রমায় ঋতু পরিবর্তন হয়। ঋতু পরিবর্তনের সাথে নদ-নদীরও গতিপথ বদলে যায়। যমুনা ও ইছামতি আর আগের মতো নেই। নদী দেখে মনে হয় না, এখানে একদিন প্রবল স্রোতস্বিনী উত্তাল নদী ছিল। হারিয়ে গেছে এই দু’টি নদী। এই নদীর পাড় আর নদীর চরে বাস করেন এক লাখের বেশি মানুষ। এক লাখ মানুষ প্রতিনিয়ত নদীর সাথে লড়াই করছেন। লড়াই করছেন নদীর নিষ্ঠুর ভাঙনের সাথে, অভাবের সাথে। বিশাল যমুনা ও ইছামতির চরসহ নদীপাড়ে বসত করা এসব মানুষ নদীর গতি-প্রকৃতির সাথে পাল্লা দিয়ে বেঁচে থাকতে চান। অভাব-অনটন, ক্ষুধার যন্ত্রণা থাকলেও চরের মানুষ চর ছাড়তে নারাজ। নদীর টানেই চরের মানুষ আশায় বুক বেঁধে পড়ে থাকেন ভাঙা, জীর্ণ কাশের ঘরে। বুক ভরা আশা, যে নদী দিনের পর দিন তাদের সর্বস্ব গ্রাস করেছে সে নদীই একদিন ফিরিয়ে দেবে বাপ-দাদার জমিজিরাত। এই আশা নিয়ে মওসুমে মওসুমে নদী আর প্রকৃতির সাথে লড়াই করছেন চরের মানুষ। শত দুঃখ-যন্ত্রণা নিয়ে, অভাব-অনটন নিয়ে চরের মাটিকেই আঁকড়ে ধরে আছেন তারা। তাদের মনে বদ্ধমূল ধারণা, ভাঙা-গড়াই নদীর খেলা।
নদীপাড়ের চরবাসী মনে করেন, জোতজমি গেছে, গেছে ঘরবাড়ি ভিটেমাটি তাতে দুঃখ নেই। রাক্ষুসী নদী সব কেড়ে নিয়েছে। নদীর সাথে তারা যুদ্ধ করছেন। নদীতেই তারা মরন চান। তাদের প্রত্যাশা তবুও নদী বেঁচে থাক।
যমুনা, ইছামতি নদীপাড়ের সিরাজগঞ্জ কাজিপুরে ছোট-বড় অর্ধশতাধিক চরে প্রায় এক লাখেরও বেশি মানুষের বাস। ঋতু বদলের সাথে নদীর রূপও বদলে যায়। সেই সাথে বদলে যায় চরের মানুষের পেশা। তারা কখনো কৃষক, কখনো জেলে, কখনো নৌকার মাঝি, কখনো ঘাটের কুলি। বর্ষাকালে উত্তাল নদীতে নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। অনেকে শুধু মাছ ধরেন। আবার একদিন ছিল যে দিন ঘাটের কুলি-মজুরের কাজ করে জীবন কাটিয়েছেন। বিশাল যমুনা, ইছামতি নদী একসময় স্রোতধারা হারিয়ে যায়। চরে এসে মানুষ বসতি গড়ে তোলেন। জেগে ওঠা এসব চরের বিভিন্ন নামকরণ করা হয়। চরের নাম বান কি মুন, খেতাচর, হাড্ডি চর ইত্যাদি।
সিরাজগঞ্জের কাজিপুর, মাইজবাড়ী, গান্ধাইল, শুভগাছা, খাসরাজবাড়ী, নাটুয়ারপাড়া, তেকানী, নিশ্চিন্তপুর, মনসুরনগর ও চরগিরিশ ইউনিয়ন প্রায় সবটাই চর হিসাবে গণ্য। এসব দুর্গম চরের মানুষ ঋতু পরিবর্তনের সাথে পেশা পরিবর্তন করে জীবিকা নির্বাহ করেন। নদী যখন প্রবল, পানির গতি ছিল তখনই নদীর পাড়ে একদিন গড়ে উঠেছিল ছোট-বড় চারটি নদীবন্দর। কালের বিবর্তনে নদীর গতিপথ হারিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা বন্দরও হারিয়ে গেছে। এসব নদীবন্দরে একদিন ছিল শত শত কুলি-মজুরের হাঁকডাক। কর্মমুখর এসব নদীবন্দর এখন প্রবীণদের কাছে স্বপ্নের মতো মনে হয়। কত জাহাজ, বার্জ আর বিশাল পালতোলা মহাজনি নৌকা বন্দরে নোঙর করেছে। মালামাল ওঠানামা করেছে। বিখ্যাত সেই নদীবন্দরের মধ্যে কাজিপুর, সোনামুখী ও নাটুয়ারপাড়া, চরগিরিশ নদীবন্দরের এখন আর অস্তিত্ব নেই। নদীর অপ্রতিরোধ ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। এসব নদীবন্দরে এখন আর জাহাজ ভিড়ে না। ভিড়ে না মহাজনি নৌকা। পাল তোলা নৌকায় স্থান করে নিয়েছে ইঞ্জিন-চালিত নৌকা।
চরের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ কাজ পেলে পেট ভরে খেতে পান। কাজ না থাকলে খাবার জোটে না। বর্ষাকালে নৌকা চালিয়ে আর নদীতে মাছ ধরে জীবন চালান। শুষ্ক মওসুমে জেগে ওঠা নদীর বালির চরে মরিচ, ধান, পাট, চিনা, কাউন, বাদাম, তিল, তিশি চাষ করেন। চরের মানুষ জেগে ওঠা চরের জমির অধিকার পান না। চরবাসী দস্যুরা তাদের লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে জেগে ওঠা চর দখলে নেয়। চরের মানুষ সে জমি বর্গা চাষ করে।
লাঠিয়াল বাহিনী তাদের চাষ করা জমির সব ফসল কেটে নিয়ে য়ায়। কাজিপুর উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক বকুল সরকার ও চরের মনসুরনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক ওরফে রাজমহর জানান, শুষ্ক মওসুমে চর থেকে চরে যাতায়াতের মাধ্যম হেঁটে, বাইসাইকেল এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে চরের বালিতে চলছে ঘোড়ার গাড়ি ও ভ্যান। চরের মানুষ মরিচ, সবজি, পাট ও ধানচাষ করেন।


আরো সংবাদ



premium cement