২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অপরূপ টাঙ্গুয়া হাওর

সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়া হাওর দেশের অন্যতম প্রাকৃতিক জলাভূমি -


সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার সীমান্তঘেরা দেশের অন্যতম কয়েকটি মাদার ফিশারিজের একটি হলো টাঙ্গুয়া হাওর। আন্তর্জাতিক রামসারভুক্ত জীববৈচিত্র্যের অনন্য জলাভূমি এ টাঙ্গুয়া হাওর। টাঙ্গুয়া হাওর ইকোট্যুরিজম ধারণা এসেছে মূলত হাওর ঘিরে বিচিত্র সৌন্দর্য সমাবেশের জন্য। এ হাওর এশিয়ার সর্ববৃহৎ জলাশয় বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার এলাকা। অতিথি পাখি-মাছ, সোয়াম ফরেস্ট বিভিন্ন জীববৈচিত্র্যের জন্য বিখ্যাত। টাঙ্গুয়া হাওরের উত্তর সীমানাজুড়ে মনোমগ্ধকর মেঘালয়ের পাহাড়, দর্শনীয় স্পট বাগলি, টেকের ঘাটের পরিত্যক্ত চুনাপাথর প্রকল্প, পাঁচ কিলোমিটার দূরে বারিক টিলা, যাদুকাটা নদী, পাহাড়ে শাহ আরেফিন রহ: মাজার, রাজারগাঁও-এর অদ্বৈত আশ্রম ও ইসকন মন্দির অবস্থিত। বিলুপ্ত লাউড় রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ এবং ঐতিহ্য খুঁজে পাওয়া যায় এখানে। টাঙ্গুয়া হাওরের চার পাশে ইকোসিস্টেম অপূর্ব সৌন্দর্যের হাতছানি। রূপের রানী যাদুকাটা নদীর অগভীর স্বচ্ছ সলিল চলন্ত প্রবহমান সুইমিং পুল দেখতে খুবই আকর্ষণীয়।
টাঙ্গুয়া হাওরে ছয় কুড়ি কান্দার নয় কুড়ি বিল, কান্দা ভর্তি সারি-সারি হিজল-করচ গাছ আর নল-খাগড়া বন। হাওরভর্তি রূপালি মাছ, জলচর পাখি, গাছ আর পাখির অভয়ারণ্য হলো টাগুয়ার হাওর। তবে এসব সোনালি অতীতে পরিণত হলেও এখনো দেশের অন্যতম সমৃদ্ধ ও সম্ভাবনাময় এ জলাভূমি। টাগুয়া হাওরের কারণে সুনামগঞ্জকে বলা হয় ‘হাওরকন্যা’। এটি আন্তর্জাতিকভাবে ঘোষিত দেশের দ্বিতীয় ‘রামসার সাইট’ এলাকা টাঙ্গুয়া হাওর আর প্রথমটি হলো সুন্দরবন। হাওরের প্রকৃতিক সম্পদ রক্ষা ও সংরক্ষণে কাজ করছে প্রশাসন। প্রশাসনের পাশাপাশি বেসরকারি কিছু উদ্যোগও রয়েছে। তবে এ উদ্যোগ কাক্সিক্ষত সুফল এখনো আসেনি। সুনামগঞ্জ জেলা শহর থেকে প্রায় ৩৮ কিলোমিটার দূরে তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলায় এ হাওরের অবস্থান। চারটি ইউনিয়নের ১৮টি মৌজাজুড়ে এর আয়তন প্রায় ১২ হাজার ৬৫৫ হেক্টর ভূমি নিয়ে। হাওরে পূর্বে ১২০টি কান্দা (পাড়) বিশিষ্ট ১৮০টি বিল ছিল। এখন ছোট-বড় মিলিয়ে বিল আছে ১০৯টি। প্রধান বিল রয়েছে ৫৪টি। এর ভেতর জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য খাল ও নালা। বর্ষায় সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তখন হাওর যেন রূপ নেয় অপরূপ সৌন্দর্যে। টাঙ্গুয়া হাওর এলাকায় ৮৮টি গ্রামের প্রায় ৬০ হাজার মানুষ হাওরের ওপর নির্ভরশীল। হাওর ঘেঁষে এর উত্তরে ভারতের মেঘালয় পাহাড়। এ পাহাড় থেকে ৩৮টি ঝরনা নেমে এসে মিশেছে টাঙ্গুয়া হাওরে।
রামসার সাইট ঘোষণা : বিশ্বব্যাপী পরিবেশ রক্ষার একটি সম্মিলিত প্রয়াসই হলো রামসার কনভেনশন। জানা যায়, ১৯৭১ সালে ইরানের রামসার নগরে প্রথম এ নিয়ে বিশ্বের পরিবেশবাদীদের একটি সম্মেলন শুরু হয়। এটিই রামসার কনভেনশন নামে পরিচিতি লাভ করে। সেখানে ‘কনভেনশন অন ওয়েটল্যান্ডস’ নামে একটি চুক্তিতে সই করেন অংশগ্রহণকারীরা। পরে ১৫৮টি দেশ এতে স্বাক্ষর করে। ১৯৯২ সালের ২০ এপ্রিল বাংলাদেশ স্বাক্ষর করে। ২০০০ সালের ২০ জানুয়ারি টাঙ্গুয়া হাওরকে রামসার সাইট ঘোষণা করা হয়।
হাওরের যত সম্পদ : টাঙ্গুয়ার হাওরকে বলা হয় দেশী মাছের আধার (খাদ্য)। এই হাওরে জলজ বন, পরিযায়ী ও দেশী পাখির নিরাপদ আবাসস্থল হয়ে উঠেছে। প্রতি বছর শীত মওসুমে দেশী ও পরিযায়ী লাখ লাখ পাখি আসে এখানে। এটি দেশী মাছের অন্যতম প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। দীর্ঘ দিন পানির নিচে টিকে থাকতে পারে এমন কিছু বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ আছে এখানে। বিলুপ্ত প্রায় হিজল-করচ গাছের পাশাপাশি এখানে রয়েছে নল-খাগড়া, সিংড়া, চাইল্যা বন, বৌল্লা, বনতুলসী, হুকল, গুজ্জারকাটা, শালুক ও শাপলা, ঝিনারি ফুলসহ বিভিন্ন জাতের উদ্ভিদ। হাওরে ১৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১৪১ প্রজাতির মাছ, ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ছয় প্রজাতির বিলুপ্ত কচ্ছপ, সাত প্রজাতির গিরগিটি, ২১ প্রজাতির সাপের দেখা পাওয়া যায়। অস্তিত্বের হুমকিতে থাকা ২৬ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর আবাস ভূমি এই টাঙ্গুয়া হাওর। বর্তমানে এখানে ৫৫ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির হুমকিতে রয়েছে বলে জানা গেছে। বর্তমানে মাছের মজুদ আছে ছয় হাজার ৭০১ টন।
হাওরের সম্পদ রক্ষা : টাঙ্গুয়া হাওরকে ১৯৯৯ সালে পরিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করে সরকার। এর পরই হাওরে দীর্ঘ ৬০ বছরের জোতদারি-জারাদারির প্রথার অবসান ঘটে। ২০০১ সালের ১২ জানুয়ারি হাওর এলাকার মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, সম্পদ সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ড সরকারের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। ২০০৩ সালের ৯ নভেম্বর জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় টাঙ্গুয়া হাওর। এই হাওরে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ২৪ জন আনসার হাওর দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি রয়েছে স্থানীয় লোকজনের সমন্বয়ে গঠিত কমিউনিটি গার্ড।
হাওর উন্নয়নে প্রকল্প : সরকারি ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) ২০০৬ সালে টাঙ্গুয়া হাওরে সমাজভিত্তিক টেকসই ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের কাজ শুরু করে। আইইউসিএন বলছে, তারা হাওর পারের ৮৮টি গ্রামে সংগঠন তৈরির মাধ্যমে মানুষকে সংগঠিত করেছে। সংগঠন করে তাদের চাঁদায় একটি সামাজিক তহবিল গড়ে তোলা হয়েছে। মানুষ সচেতন হচ্ছে।


আরো সংবাদ



premium cement