২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আমাদের চেতনায় অমর একুশে

-

মানুষের আবেগ-অনুভূতি ব্যক্ত হয় ভাষায়। তা সাবলীল হয় মাতৃভাষায়। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেও এ ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের স্বাধীন দেশ আছে, আছে সমৃদ্ধ একটি ভাষা। তবে এ ভাষার জন্য অনেক রক্ত ঝরাতে হয়েছে। অমর একুশের চেতনা বাংলাদেশীদের কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই ভাষার মান রক্ষায় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে রক্ত দিয়েছেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ নাম না জানা আরো অনেকে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আজ বাংলা ভাষা স্বীকৃত। আমাদের ভাষা দিবস বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হয়।
১৯৮৭ সালে দেশে আইন করা হয়, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহার ও প্রয়োগ করা হবে। কিন্তু এ আইনের বাস্তবায়নে আমরা মনোযোগী নই। অনেক ক্ষেত্রেই ইংরেজির ব্যবহার বাংলা ভাষার মর্যাদা নষ্ট করছে। বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে তা সুখকর নয়। এখনো দেশের বিশিষ্টজনদের অনেকেই সভা-সমিতিতে ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এর মাধ্যমে আমাদের চেতনায় এখনো ঔপনিবেশিক মানসিকতার ছাপ স্পষ্ট পরিলক্ষিত হয়। বছরের একটি দিনে আমরা বাংলা ভাষার মর্যাদা, ভাষাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা নিয়ে কথার ফুলঝুরি ফোটাই। সারা বছর ভাষার জন্য নিজেদের দায়িত্বজ্ঞান যাই বেমালুম ভুলে।
তবে আশার কথা, কোনো কোনো মহলের নিষ্ক্রিয়তা সত্ত্বেও সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের তাগিদ ক্রমেই উচ্চকিত হচ্ছে। উচ্চ আদালতেও বাংলায় রায় লেখা এবং অন্যান্য কাজ সম্পাদনের প্রাসঙ্গিকতা সবার বিবেচনায় আসছে। আমাদের বিশ্বাস, আদালতের তাৎপর্যপূর্ণ এ নির্দেশ উচ্চ আদালতে বাংলা প্রচলনের ক্ষেত্রেও উৎসাহ সৃষ্টি করবে। এ ক্ষেত্রে যেসব সীমাবদ্ধতা রয়েছে; তা কাটিয়ে ওঠার প্রয়াস শুরু হবে।
হাইকোর্ট বিভাগ থেকে দেয়া নির্দেশ, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর ক্ষেত্রে সর্বশেষ তাগিদ বলে বিবেচিত হবে। বস্তুত, যে মাতৃভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা আদায়ে এ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ছয় দশক পরও সেই ভাষা সর্বস্তরে চালু না হওয়া সত্যিই বড় বেদনার।
বাংলা ভাষার ভিত্তিতে যে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সূচিত হয়েছিল, সেই রাষ্ট্রে বাংলা ভাষার অধিষ্ঠান নৈতিক দায়িত্ব তো বটেই; আমরা দেখি, সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদেও এ বিষয়ে জোর দেয়া হয়েছে। সেখানেই শেষ নয়; ১৯৮৭ সালের মার্চ মাসে প্রণীত ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’ স্পষ্ট করে দিয়েছে, ‘সর্বত্র তথা সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের (বিদেশের সাথে যোগাযোগ ছাড়া) সব ক্ষেত্রে এবং চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে।’ তারপরও বাংলা ভাষার প্রচলন সর্বস্তরে সম্ভব না হওয়া দুর্ভাগ্যজনক।
আমরা জানি, দেশের প্রায় সবাই বাংলাতেই কথা বলেন। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবেও বাংলা সুপ্রতিষ্ঠিত। কিন্তু দাফতরিক যোগাযোগ এবং বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানের লেখালেখিতে ইংরেজিরই প্রাধান্য। এর একটি কারণ সম্ভবত ঔপনিবেশিক আমলের ভিত্তিমূলে গড়ে ওঠা আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মানসিকতা। আমরা দেখি, চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, জার্মানির মতো প্রভাবশালী দেশ তো বটেই, বুলগেরিয়া, তুরস্কের মতো অপেক্ষাকৃত কম প্রভাবশালী দেশেও নেহায়েত প্রয়োজন ছাড়া ইংরেজি ব্যবহার নেই।
ভাষার জন্য জীবন দেয়া এবং বিদেশী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে তা সম্ভব হবে না কেন? বাংলা ভাষার গৌরব, বিজ্ঞানসম্মত কাঠামো এবং বিশ্বব্যাপী বিস্তৃতিও এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক।
আমরা আশা করি, বাংলা ভাষা প্রচলন আইন অনুসারে সব ক্ষেত্রে অবিলম্বে বাংলা ব্যবহারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে যে রুল আদালত দিয়েছেন, তা প্রতিপালনে বিলম্ব করবে না সরকার। উচ্চ আদালতেও বাংলার ব্যবহার সামান্য থাকার যে সমালোচনা রয়েছে, খোদ বিচার বিভাগকেও সেদিকে নজর দিতে হবে। সব পক্ষ উদ্যোগী ও আন্তরিক হলে বাংলা ভাষার মর্যাদা ও ব্যবহার বাড়ানো সম্ভব।
১৯৯৯ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পায়। অথচ আমরা নিজেদের মাতৃভাষার সঠিক প্রয়োগ করতে পারছি না। সাইনবোর্ড লেখা হয় ইংরেজিতে। বাংলা লেখা হলে বানানে থাকে ভুল। বাংলা একাডেমিও এ ব্যাপারে প্রচেষ্টা চালিয়েছে, তবে সফলতা আসেনি। তাই সরকারের প্রতি আহ্বান, বাংলা ভাষা সংরক্ষণে সরকারি পর্যায় থেকে আরো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ দেশে এখনো অনেক ভাষাসৈনিক জীবিত আছেন, যারা কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। তাদের পাশে সবাইকে দাঁড়াতে হবে। হ
লেখক : আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট


আরো সংবাদ



premium cement