২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার

-

পুরো দেশ এখন নির্বাচনী জ্বরে আক্রান্ত। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকার বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পালাবদলের স্বীকৃত পদ্ধতি হচ্ছে নির্বাচন। এটি সপ্তদশ শতাব্দী থেকে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে বেশির ভাগ দেশেই বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু আমাদের দেশে নির্বাচনী ব্যবস্থা একটি অভিশাপে পরিণত হয়েছে! আমাদের নির্বাচন যেন একটি অভিশাপ। তা বুঝতে হলে বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনগুলোতে হানাহানির একটি পরিসংখ্যান দেখা যেতে পারে।
গণমাধ্যমের জরিপ, পত্রপত্রিকার তথ্য, মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী প্রত্যেক সরকারের শাসনামলে কমবেশি সহিংসতা ঘটেছে। ১৯৯১ সালকে গণতন্ত্রে উত্তরণের বছর বলা হয়। সে জন্য আমি এ লেখায় ১৯৯১-এর আগের পরিসংখ্যান না এনে পরেরগুলো তুলে ধরলাম।
১৯৯১-৯৬ সালের বিএনপির শাসনামলে রাজনৈতিক সহিংসতায় মারা গেছে ১৭৪ জন। ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারিতে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়েই ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সংসদ স্থায়ী হয়েছিল মাত্র ১২ দিন। প্রথম অধিবেশন শুরু হয়েছিল ১৯ মার্চ ১৯৯৬ সালে এবং অধিবেশন স্থায়ী ছিল চার কার্যদিবস ২৫ মার্চ ১৯৯৬ পর্যন্ত। ৩০ মার্চ ১৯৯৬ সালে সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। এর পরপরই সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই এক বছরে রাজনৈতিক সহিংসতায় মারা যান ৪৯ জন। এর মধ্যে তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতায় মারা গেছে মোট ৪১ জন। ১৯৯৬-২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণ গেছে ৭৬৭ জনের। ২০০১ সালের নির্বাচন ঘিরে নিহত হয়েছিল ৩৮ জন। ২০০১-০৬ এই পাঁচ বছরে বিএনপির সরকারের শাসনামলে রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণ গেছে ৮৭২ জনের।
২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো ধরনের সহিংসতাই হয়নি। কোনো প্রাণহানির খবরও পাওয়া যায়নি। এই নির্বাচনটি সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যে দেশে স্কুল ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনে সহিংসতা হয় এবং মানুষ মারা যায়, সে দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো সহিংসতা হলো না! আমি মনে করি, এখানে আমাদের জন্য সুস্পষ্ট কিছু বার্তা রয়েছে। প্রকৃত সমাজ গবেষকেরা ভবিষ্যতে এ ঘটনাটি নিয়ে হয়তো গবেষণা করে ভালো কিছু বের করতে পারবেন।
২০০৯-১২ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে মারা গেছে ৫৬৪ জন মানুষ। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল সবচেয়ে আলোচিত। ১৫৩টি আসনে সরকারদলীয় প্রার্থী ছাড়া অন্য কোনো প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নেয়নি। গড়ে ২০ শতাংশ বা তার কম ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে এই নির্বাচনে, যেখানে পূর্ববর্তী জাতীয় নির্বাচনে ৮৭ শতাংশের ওপর ভোট পড়েছিল। ভোটের দিনে সহিংসতায় মৃত্যু হয়েছে ২২ জন। সারা বছরে ৫০৭ জন মারা গেছে। আর আহত হয়েছে ২২ হাজার ৪০৭ জন। নির্বাচনপূর্ব সহিংসতার দিক থেকেও এই নির্বাচন অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। ২০১৩ থেকে ২০১৮-এর এ পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় মারা গেছে ৪৯৮ জন।
ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ বা এনকাউন্টার, গুমের পরিসংখ্যান এখানে আনিনি। তা ছাড়া আহত, পঙ্গুত্বের পরিসংখ্যানও এর বাইরে। জাতীয় নির্বাচন ছাড়াও সিটি করপোরেশন, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, ইউপি নির্বাচন সহিংসতা পিছিয়ে নেই! প্রত্যেক নির্বাচনেই মানুষ মারা যাচ্ছে, যা আমাদের দেশের জন্য মোটেও সুখকর নয়। এর জন্য কি শুধু সরকারি দল দায়ী? অথবা শুধু বিরোধী দল দায়ী? আমি মনে করি, আমাদের গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থাই এর জন্য দায়ী।
আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেন সহিংসতা আর সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পুনরাবৃত্তি না ঘটে, এ বিষয়ে সরকারসহ রাজনৈতিক দলগুলোকে সচেতন ও সজাগ থাকতে হবে। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বাজে। একদল মানুষ হ্যাঁ করে তাকিয়ে থাকে কখন ক্ষমতায় যাবে, আর লুটপাট করে নিজেদের পেট ভর্তি করবে। নির্বাচনে জয়লাভের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপগুলো যা ইচ্ছা তাই করে। নিয়ম-নীতি অনুসরণের কোনো বালাই নেই। আইন আর নীতিকথা সব বই আর বক্তৃতার মঞ্চেই আবদ্ধ থাকে। নির্বাচনে যারা পরাজিত হয়, তাদের পরিণতি হয় খুবই করুণ।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নির্বাচন ব্যবস্থা উন্নয়নে আমার কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরছিÑ
ক. রাজনৈতিক দলগুলোকে পরিবার ও ব্যক্তিতন্ত্র মুক্ত করার লক্ষ্যে দলীয় প্রধানের পদ সর্বোচ্চ ১০ বছর করা হোক। এক ব্যক্তি এর বেশি দলের প্রধান থাকতে পারবেন না। এ বিষয়ে আরপিও সংশোধন করে কঠিন ধারা যুক্ত করা হোক এবং তার সুষ্ঠু প্রয়োগ করা হোক। দলের প্রধান না থেকেও মানবতার সেবা করা যায়, বিশ্বের অনেক দেশে এর নজির আছে।
খ. প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীসহ জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সব পদে এক ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি না থাকার বিধান করুন। প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী আপনকেই আজীবন থাকতে হবে? কেন? এগুলো থেকে অবসর নিয়ে জাতির সেবা করা যায় না? বড় বড় বক্তৃতার দরকার নেই। আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, দলের প্রধানের পদ চাই না, হেন চাই না, তেন চাই না, এসব অহেতুক প্রলাপ না দিয়ে সরে দাঁড়ান। নতুনদের এগিয়ে আসতে সহায়তা করুন।
গ. নির্বাচনে সঠিক বায়োমেট্রিক পদ্ধতি চালু করা হোক। আমার আঙ্গুলের ছাপ ছাড়া আমার ভোট দেয়া যাবে না, সে ব্যস্থা করুন। ঘরে বসেই ভোট দেয়ার প্রযুক্তি চালু করুন। সিদ্ধান্ত নিলে এটা করা সম্ভব।
ঘ. টেন্ডারবাজি বন্ধ ঘোষণা করে বিকল্প পদ্ধতি বের করুন। সেই সাথে বাজার-ঘাট, স্ট্যান্ড দখল বন্ধ করতে হবে। দেখবেন বেশির ভাগ রাজনৈতিক হাঙ্গামা বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব? সেই প্রশ্নের উত্তর রাজনীতিবিদেরাই বলতে পারবেন ভালো। বর্তমান সময়ে হানাহানি আর রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের অন্যতম কারণ এই টেন্ডারবাজি। বিরোধী দল নয়, ক্ষমতাসীন দলের মধ্যেই এই টেন্ডারবাজি নিয়ে বেশি সহিংসতা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ক্যম্পাসগুলো অস্থিতিশীল হয় টেন্ডারবাজির কারণে।
ঙ. ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার কথা বললে সব মহল হইহই করে তেড়ে আসবেন। সে জন্য ছাত্র রাজনীতি বন্ধের কথা বলব না। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট বাউন্ডারিতে তথা ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ করা হোক। ছাত্ররা রাজনৈতিক তৎপরতা চালাক রাজপথে, মাঠে-ঘাটে। যত্ত বেশি পারুক লেজুড়বৃত্তি করে বেড়াক পার্টি অফিসগুলোতে। ক্যাম্পাসে থাকবে অরাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন ও অরাজনৈতিক ছাত্রসংসদ। যারা ছাত্র নেতৃত্ব তৈরির বড় বড় যুক্তি আর তত্ত্ব দেবেন তাদের বলব, লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করুন। হ
লেখক : প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ফেনী ভিক্টোরিয়া কলেজ


আরো সংবাদ



premium cement