০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


টাকায় মেলে এ প্লাস!

-

সম্প্রতি এ প্লাস বাণিজ্যের কী সাংঘাতিক সর্বনাশা চিত্র উঠে এসেছে ভাইরাল হওয়া বেসরকারি টেলিভিশন মাছরাঙার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে। এসব দেখে আগামী দিন নিয়ে শঙ্কা হয় না? বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের কবলে পড়ে শিক্ষার মেরুদণ্ড যখন নড়বড়ে হয়ে পড়েছিল, তখন জাতির আগামী নিয়ে শঙ্কা তীব্রতর ছিল। কয়েকটি পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস হতে দেখা যায়নি। প্রশ্নফাঁস চক্রের অল্প বিস্তর আনাগোনা এখনো দেখছি। তবে অনৈতিকতার চূড়ান্ত সীমা অতিক্রম করে অর্থের বিনিময়ে পরীক্ষার ফলাফল পরিবর্তন কিংবা এ প্লাস পাইয়ে দেয়ার দুঃসংবাদ জাতি হিসেবে এ বছরেই আমাদের শুনতে হলো। নীতি-নৈতিকতা যে নির্বাসনে গেছে তা আরেকবার মিডিয়ার মাধ্যমে প্রমাণিত হলো বোধহয়। জবাবদিহিতা সঙ্কুচিত হওয়ার কারণে বিশৃঙ্খলার ঢেউ মানুষের সামাজিক দায়বদ্ধতা, বিবেকের জবাবদিহিতা এবং পদের শপথকে লঙ্ঘন করছে।
শিক্ষা ক্ষেত্রের অনৈতিকতার সাথে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক থাকলেও দায় খুঁজে পাই না। শিক্ষার্থীদের বয়সটা শেখার। নীতি-নৈতিকতার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার পরিপক্বতা তাদের আসেনি। যা শেখানো হচ্ছে তাই তারা শিখছে এবং এর প্রতিফলন আগামীতে রাষ্ট্র দেখবে। সব দায় অভিভাবক, কিছু অসাধু শিক্ষক এবং রাষ্ট্র মনোনীত দায়িত্বহীন অসৎ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর। পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে যদি প্রশ্ন ফাঁস না হয় তবে শিক্ষার্থীদের কোন ক্ষমতা আছে, যাতে তারা ফাঁস করা প্রশ্নে পরীক্ষা দিতে পারবে? অভিভাবক যদি লাখ লাখ টাকা দিয়ে এ প্লাস না কেনেন, কোন শিক্ষার্থীর সাধ্য আছে দু’আড়াই লাখ টাকা দিয়ে এ প্লাস কিনতে যাবে? শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা যদি সৎ হন, তবে এমন কোন অভিভাবক বা শিক্ষকের সাধ্য আছে যে, বোর্ডে গিয়ে পরীক্ষার ফলাফল পরিবর্তনের কথা তুলবেন? বোর্ড কর্মকর্তাদের ওপর দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যদি ন্যায়নীতিসম্পন্ন হন তবে এ অসাধু অধঃস্তন কর্তারা কোন সাহসে অনৈতিকতার পথে পা বাড়াবেন? শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীলরা যদি নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে কঠোর থাকেন তবে রাষ্ট্রের বেতনভুক্ত কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর জাতির ভবিষ্যৎ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অনৈতিক কাজ কার সাধ্য ও সক্ষমতা একেবারেই থাকার কথা নয়। মাদক গ্রহণ করলে গ্রহীতা নিজে এবং একটা পরিবার ধ্বংস হয় কিন্তু; শিক্ষা ক্ষেত্রে লোভ ও অসততার যে মাদকতা বিরাজ করছে, তাতে গোটা জাতির ধ্বংসের দামামা বাজছে।
সম্ভাবনার কথা, আমাদের দেশে যতজন শিক্ষার্থী আছে, বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে তত জনসংখ্যাও নেই। কাজেই আমাদের শিক্ষার্থীদের যদি সম্পূর্ণরূপে নৈতিকতার ভিত্তিতে গড়ে তুলতে পারি তবে বাংলাদেশ অবশ্যই উন্নত বিশ্বে স্থান লাভ করবে। আর যদি রাষ্ট্র এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সঠিক নির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হয়, শঙ্কার উচ্চশিখরে আমরাই থাকব। সম্ভাবনার অপর পিঠেই শঙ্কা লেপ্টে থাকে। প্রশ্ন ফাঁসের মাধ্যমে ‘শিক্ষিতের হার বাড়ানো’ কিংবা অর্থের বিনিময়ে সর্বোচ্চ রেজাল্ট পাওয়া জাতিবিনাশী কর্মকাণ্ডের সূচনা করবে। একজন শিক্ষার্থী সারা বছর পরিশ্রম করে যদি ‘এ প্লাস’ পায় কিংবা এর কাছাকাছি ভালো রেজাল্ট করে, তাতে তৃপ্তি আছে বটে। সে যখন দেখবে ক্লাসের সবচেয়ে বাজে শিক্ষার্থীও যেকোনোভাবে তার চেয়ে ভালো ফলাফল অর্জন করেছে, তখন তার মধ্যে ক্ষোভ, হতাশা ও ক্রোধ আসবেই।
এ দেশে সরকারি হিসাবে প্রায় ২৬ লাখ শিক্ষিত বেকার। কাজেই রাষ্ট্রের প্রত্যেক অঙ্গ থেকে দুর্নীতিবাজ ও নীতিহীনদের বিতাড়িত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। দক্ষ-নৈতিক জনবল দিয়ে নীতিহীনদের শূন্যপদ পূরণের বিকল্প সন্তোজনকভাবেই মজুদ রয়েছে। প্রজাতন্ত্রের অধিকসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী যখন অনৈতিকতার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করতে শুরু করে দেন, তখন সেটা নোংরা প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়। আর একবার যদি অনৈতিক প্রতিযোগিতায় লোকজন মাতে, তখন সামগ্রিক শৃঙ্খলার পতন অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়।
রাষ্ট্র যদি স্বপ্ন ভুলে যায় তবে বাড়তি কিছু বলার নেই। কিন্তু যদি উন্নতির স্বপ্ন থাকে কিংবা একটি নীতিবান জাতি পাওয়ার আশা করে তবে অবশ্যই শিক্ষা খাতের দুর্নীতিকে সর্বাগ্রে সমূলে উৎপাটন করতে হবে। শতভাগ পাস, বছরের প্রথম দিনে বই তুলে দেয়া কিংবা বাজেটে শিক্ষার উন্নয়নে বিশাল বরাদ্দ দেয়ার কোনো অর্থ নেই যদি শিক্ষা সংশ্লিষ্ট প্রতিটি ব্যক্তি নীতিবান না হয়। অভিভাবকেরা সন্তানদের জন্য যে এ প্লাসের পেছনে ছুটছেন, সে এ প্লাস বোঝা হবে যদি সন্তান নৈতিক শিক্ষায় বড় না হয় এবং কার্যত অজ্ঞ থাকে। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement