২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

হালদা তীরে রুইজাতীয় মাছের রেণু উৎসব

-

রুইজাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহের উপযোগী অন্যতম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা তীরে রেণু (চার দিন বয়সী পোনা) উৎসব শুরু হয়েছে। রেণু বিক্রিকে কেন্দ্র করে হালদা তীরের মানুষের চোখে মুখে এখন হাসির ঝিলিক।
প্রায় চার দশক হালদা নদীর প্রাণবৈচিত্র্য এবং নদীর গতিপ্রকৃতি নিয়ে গবেষণারত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলী আজাদী নয়া দিগন্তকে বলেন, ২০১২ সালে হালদা থেকে সংগৃহীত ডিমের রেণু উৎপাদন হয়েছিল ১৫৫৯ কেজি। ২০১৩ সালে ৬১২ কেজি, ২০১৪ সালে ৫০৮ কেজি, ২০১৫ সালে ১০৬ কেজি, ২০১৬ সালে ১৬৭ কেজি, ২০১৭ সালে ২৮ কেজি এবং ২০১৮ সালে ৩৭৮ কেজি রেণু উৎপাদন হয়। যদিও ২০১৫, ২০১৬ এবং ২০১৮ সালে রেণু উৎপাদনের পরিমাণ সরকারি হিসাবের চেয়ে অনেক কম বলে এই গবেষকের দাবি। এ বছর সংগৃহীত নিষিক্ত ডিমে ১০০ থেকে ১২০ কেজির মতো রেণু উৎপাদন হতে পারে বলে তিনি জানান।
হালদা তীরের ডিম সংগ্রহকারীরা দুই শতাধিক নৌকা নিয়ে রুইজাতীয় মাছের (রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশ) প্রায় ছয় হাজার কেজি নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করেন। গত শুক্রবার সন্ধ্যা এবং শেষ রাতে লাগাতার বজ্রসহ মুষলধারে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হওয়ায় হালদায় পানির ঢল নেমে পানির গুণগত মান পরিবর্তন হওয়ায় গত শনিবার সকাল থেকে হালদায় রুই-কাতলা নমুনা ডিম ছাড়া শুরু করে। দীর্ঘ প্রতীক্ষায় থাকা জেলেরা শনিবার সকাল থেকে নৌকাপ্রতি ১০০-১৫০ গ্রাম নমুনা ডিম সংগ্রহ করেন। পরে রাতে মা মাছেরা আবার ডিম ছাড়ে এবং আমতুয়া থেকে ছায়ার-চর পর্যন্ত প্রায় আড়াই শ’ নৌকা রাত ৮টা থেকে মধ্যরাত ২টা পর্যন্ত প্রায় এক থেকে আড়াই কেজি ডিম প্রতিবারে সংগ্রহ করা সম্ভব হয়।
সংগৃহীত নিষিক্ত ডিমগুলো প্রথমে নৌকায় স্থাপিত অস্থায়ী কুয়ায় রাখা হয়। পরে তা স্থানান্তর করা হয় নদী তীরবর্তী স্থানে আগে থেকে প্রস্তুত করে রাখা কুয়ায়। এসব কুয়ায় আগেভাগেই জোয়ারের সময় হালদা নদীর পানি ঢুকিয়ে মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়। পরে সেখানে মশারি নেট পানিতে ডুবিয়ে নৌকার কুয়া থেকে ডিমগুলো ছিটিয়ে দেয়া হয়। ১৪-১৫ ঘণ্টা পরেই ডিমের খোলস ফেটে পোনা বেরিয়ে আসে এবং মশারি নেটের ছিদ্র দিয়ে সেগুলো কুয়ার পানিতে নেমে যায়। এরপর এক দিন অন্তর পানি বদল এবং অক্সিজেনের সরবরাহ বজায় থাকা নিশ্চিত করে নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে রেণুতে পরিণত করা হয়। চার দিনের এই কর্মযজ্ঞে ডিম সংগ্রহকারীদের কাটাতে হয় নির্ঘুম রাত।
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত বিশেষত চট্টগ্রাম অঞ্চলের নানা স্থান থেকে রেণু ক্রেতারা এখন ভিড় করছেন হালদা তীরে। হালদা তীরের ছয়টি সরকারি হ্যাচারিসহ বিভিন্ন কুয়ায় সনাতনী পদ্ধতিতে প্রস্তুতকৃত হ্যাচারিতে তৈরি প্রতি কেজি রেণু থেকে তিন-চার লাখ পর্যন্ত ফিংগার লিং (যা গ্রামাঞ্চলে বাইশ হিসেবে পরিচিত) বা পোনা হয় বলে ড. আজাদী নয়া দিগন্তকে জানান। অক্সিজেন-সমৃদ্ধ প্লাস্টিক ব্যাগে করে হ্যাচারি থেকে ক্রয়কৃত রেণু দ্রুততম সময়ের মধ্যে লালন পুকুরে ছাড়ার ব্যবস্থা করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, অক্সিজেন দিয়ে ১০-১২ ঘণ্টা পর্যন্ত রেণু বাঁচিয়ে রাখা যায়।
ড. আজাদীর মতে হালদার নিষিক্ত ডিমগুলো অর্থনীতিতে তিন স্তরে অবদান রাখে। প্রথম ধাপে ডিম সংগ্রহকারীরা রেণু হিসেবে বিক্রি করে একদফায় দাম পান। এর পরের ধাপে ফিংগার লিং বা বাইশ হিসেবে রেণুগুলোকে অঙ্গুলি সাইজের পোনা হিসেবে বিক্রি করেন এবং সর্বশেষ ধাপে ফিংগারলিং ক্রেতারা সেগুলোকে পরিণত মাছ হিসেবে বিক্রি করেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন হ্যাচারি মালিকেরা ব্র“ড (মা) মাছ তৈরিতেও হালদার পোনাকে ব্যবহার করে থাকেন। হালদার পোনার সাথে ভিন্ন নদীর পোনার ক্রস করিয়ে ব্র“ড তৈরি করা হলে বা হালদার পোনার সাথে জেনারেশন গ্যাপে ক্রস করিয়ে ব্র“ড তৈরি করা হলে সেসব পোনামাছের বৃদ্ধি ভালো হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
প্রসঙ্গত, দেশের রুইজাতীয় মাছের ডিম সংগ্রহের অন্যতম প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র হালদা মানবসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক কারণে বিপন্ন প্রায়। এসবের মধ্যেও গতবার তুলনামূলক বেশি ডিম আহরণ হওয়ার পর এবার ডিম আহরণ অপেক্ষাকৃত কম। কারণ সম্পর্কে এই প্রাণিবিজ্ঞানী বলেন, ডিম পরিপূর্ণতার সাইকেল হিসেবে যথাসময়ে এপ্রিল এবং মে মাসে লাগাতার পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ার ফলে পানির তাপমাত্রা কমেনি (২৭-২৯ ডিগ্রি সে.সি)। তা ছাড়া স্রোতের দ্রুত-গতি সৃষ্টি হয়নি এবং পানির অন্যান্য ভৌত-রাসায়নিক গুণাগুণেরও পরিবর্তন না হওয়ায় মা-মাছ এবার পর্যাপ্ত ডিম ছাড়েনি। মূলত এবার প্রচণ্ড গরম, মাঝে মাঝে কিছুক্ষণের জন্য বৃষ্টিÑ অর্থাৎ আবহাওয়াজনিত বা ক্লাইমেট চেঞ্জই ব্যাপকহারে ডিম না ছাড়ার মূল কারণ বলে তিনি মন্তব্য করেন।


আরো সংবাদ



premium cement