২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


গুজরাটে নামাজ অবস্থায় হামলার শিকার বিদেশী ছাত্ররা যা জানিয়েছেন

গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ের আফগান ছাত্র (বাঁদিকে) এবং যে হামলার অভিযোগ উঠেছে তার ভিডিও থেকে নেয়া ছবি। - ছবি : বিবিসি

‘খুব ভয়ে আছি আমরা। চিন্তা করছি পড়াশোনাটুকু কিভাবে শেষ করব?,’ বিবিসি গুজরাটি বিভাগের সংবাদদাতার সাথে কথোপকথনের সময় গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিদেশী শিক্ষার্থী এভাবেই তার উদ্বেগ ব্যক্ত করলেন।

এর আগে শনিবার (১৬ মার্চ) রাতে গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেল প্রাঙ্গণে নামাজ পড়াকে কেন্দ্র করে বিদেশী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগ ওঠে। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পাসে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।

অভিযোগ, শনিবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলের এ ব্লকে আফগানিস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশের মুসলিম শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় ২৫ জনের একটি দল। এই ঘটনায় দুজন শিক্ষার্থী আহত হন।

তাদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরে ছেড়ে দেয়া হয়।

গুজরাট পুলিশের ডিসিপি (জোন-৭) তরুণ দুগ্গলের সাথে মঙ্গলবার যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা বিষয়টি তদন্ত করছি। এখন পর্যন্ত এই ঘটনায় পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’

সমাজমাধ্যমে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে যেখানে কয়েকজন বিদেশী ছাত্রের গাড়ি লক্ষ্য করে পাথর ছুড়তে দেখা যাচ্ছে কিছু ব্যক্তিকে। ধর্মীয় স্লোগানও দিতে দেখা গেছে।

এই ভিডিওটি গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশী ছাত্রদের ওপর আক্রমণের ঘটনার সাথে সম্পর্কিত বলে দাবিও করা হয়েছে।

ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর নিন্দায় সরব হয়েছেন অনেকেই। বিরোধীরাও সমালোচনা করেছে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে।

সরব হয়েছেন এআইএমআইএম নেতা আসাদউদ্দিন ওয়াইসি এবং গুজরাটের কংগ্রেস নেতা গিয়াসুদ্দিন শেখও।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছে।

‘আগেও দুর্ব্যবহার করা হয়েছে’
বিবিসি গুজরাটির সংবাদদাতা যখন হোস্টেল ব্লকে পৌঁছান তখন সেখানে সর্বত্র পুলিশ এবং বিশ্ববিদ্যালয়য়ের কর্মকর্তাদের ভিড়।

ঘটনাস্থলে পাথর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ছিল। আর ছিল ভাঙা গাড়ি যা ইঙ্গিত দেয় সেখানে পাথর ছোড়া হয়েছিল।

হোস্টেলের ছাত্ররা তখনো আতঙ্কিত ও হতাশাগ্রস্ত হয়ে ছিলেন।

আফগানিস্তান থেকে আসা শিক্ষার্থী নোমান বিবিসিকে বলেন, ‘আমাদের মতো শিক্ষার্থীদের জন্য এখন এখানে থাকাটা বড় চ্যালেঞ্জ।’

‘এই হোস্টেলটা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য। ওই লোকগুলো কিভাবে দলে দলে এখানে ঢুকে পড়ল তা নিয়ে তদন্ত হওয়া উচিত।’

তার অভিযোগ, “এই ধরনের লোকেরা প্রায়শই এখানে এসে হুমকি দেয় ‘জয় শ্রীরাম’ বল, না হলে ছুরি মারব। এর আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে। অন্য দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য এখানে বহু ঝুঁকি রয়েছে।”

এই ঘটনায় এফআইআর দায়ের করেছে আহমেদাবাদ পুলিশ। এখন পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

‘পুরনো মতপার্থক্য ছিল’
কংগ্রেস বিধায়ক ইমরান খেদাওয়ালা এবং সাবেক বিধায়ক গিয়াসুদ্দিন শেখও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং হাসপাতালে ভর্তি ছাত্রদের সাথে দেখা করেন।

ওই দুই নেতা এই ঘটনার নিন্দা করেছেন এবং গুজরাট পুলিশ ও সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

সাবেক বিধায়ক গিয়াসুদ্দিন শেখ সামাজিক মাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) লিখেছেন, ‘গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে বসুধৈব কুটুম্বকমের স্লোগান তোলা ব্যক্তিদের শাসনকালে গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশী মুসলিম শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় আমি এবং বিধায়ক ইমরান খেড়াওয়ালা ন্যায়বিচার চাই।’

গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নীরজা গুপ্তা অবশ্য গোটা বিষয়টিকে ‘দুই গোষ্ঠীর মধ্যে আগে থেকেই বিদ্যমান মতপার্থক্য’ বলে ব্যাখ্যা করেছেন।

তিনি বলেন, ‘দুই গোষ্ঠীর মধ্যে আগে থেকেই মতপার্থক্য চলছিল এবং এরপরই এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। ঠিক কেন এই ঘটনা ঘটল, সেটা তদন্তের বিষয়।’

‘এ পর্যন্ত যা জানা গেছে, তা হলো কয়েকজন ছাত্র হোস্টেলের বাইরে নামাজ পড়ছিল এবং তারপর তারা জনতার সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়ে।’

‘বিশ্ববিদ্যালয় পুরো বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখছে এবং পুলিশ সেই রাতেই এফআইআর দায়ের করেছে,’ বলেন ভিসি।

পুলিশ কী বলছে?
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, এই ঘটনায় শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করেছে রাজ্য সরকারের স্বরাষ্ট্র দফতর। তবে স্বাধীনভাবে এই খবরের সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

অভিযুক্তদের ধরতে নয়টি দল গঠন করা হয়েছিল। মোট পাঁচজন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের খোঁজ চালাচ্ছে পুলিশ।

রোববার পুরো ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর আহমেদাবাদ সিটি পুলিশ কমিশনার জি এস মালিকও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

সংবাদমাধ্যমকে তিনি জানান, ‘এই হোস্টেলে প্রায় ৭৫ জন শিক্ষার্থী থাকেন। রাতে কয়েকজন ছাত্র হোস্টেল ভবনের বাইরে মসজিদ চত্বরে নামাজ আদায় করছিলেন।’

‘সেই সময় কিছু লোক এসে শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চায় কেন তারা এখানে নামাজ পড়ছে।’

পুলিশ কমিশনারের মতে, উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল বাদানুবাদ হয়েছিল, যার পরে বিষয়টি হাতাহাতির পর্যায়ে পৌঁছায়।

পুলিশের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, রাত ১০টা ৫১ মিনিটে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে একটি বার্তা আসে, তারপরই ঘটনাস্থলে পৌঁছান কর্মকর্তারা।

পুলিশ সূত্রে খবর, এই ঘটনায় অভিযোগ জানিয়েছিলেন হোস্টেলের নিরাপত্তারক্ষী। মোট ২৫ জন ঘটনাস্থলে পাথর ছোড়ে বলে অভিযোগ।

পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘২০-২৫ জনের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হয়েছে এবং আমাদের নয়টি দল তদন্ত করছে।’

‘যারা এর সাথে জড়িত, তাদের গ্রেফতার করা হবে এবং কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে,’ জানান তিনি।

কমিশনার আরো বলেন, হাসপাতালে দুই শিক্ষার্থীকে ভর্তি করা হয়েছে, যাদের একজন শ্রীলঙ্কার এবং অন্যজন তাজিকিস্তানের।

অভিযোগ দায়ের হওয়ার সাথে সাথে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিসিপি (জোন-৭) তরুণ দুগ্গল।

প্রশ্ন আসাদউদ্দিন ওয়েইসির
ফ্যাক্ট চেকিং নিউজ ওয়েবসাইট অল্ট নিউজের প্রতিনিধি মোহামেদ জুবায়ের সমাজ মাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) এই ঘটনায় ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও পোস্ট করেছেন।

এর পরে, এআইএমআইএম দলের এমপি আসাদউদ্দিন ওয়াইসিও বিষয়টির কড়া সমালোচনা করেন।

তিনি লেখেন, ‘কী লজ্জার কথা। বিশ্বাস ও ধর্মীয় স্লোগানগুলো শুধুমাত্র তখনই প্রকাশ পায় যখন মুসলমানরা শান্তিপূর্ণভাবে তাদের ধর্ম অনুশীলন করেন। মুসলমানদের এক ঝলক দেখলেই আপনার ভীষণ রাগ হয়।’

‘এটা যদি ব্যাপক আকারের চরমপন্থা না হয়, তাহলে কী? এটা অমিত শাহ ও নরেন্দ্র মোদির নিজের রাজ্য, তারা কি হস্তক্ষেপ করে কড়া বার্তা দেবেন? আমার কোনো আশা নেই।’

এই পোস্টে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে ট্যাগ করে লেখেন, ‘ড. এস জয়শঙ্কর, ভারতের ভিতরে মুসলিম বিরোধী বিদ্বেষ ভারতের ভাবমূর্তিকে নষ্ট করছে।’

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কী বলছে?
গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক ছাত্রদের ওপর হামলার অভিযোগের ঘটনায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল একটি বিবৃতি দিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘শনিবার আহমেদাবাদের গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। অপরাধীদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিচ্ছে রাজ্য সরকার।’

‘সংঘর্ষে দুজন বিদেশী শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে একজনকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।’

তিনি বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গুজরাট সরকারের সাথে যোগাযোগ রাখছে।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement