২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চীনা পণ্য বয়কটের ডাকে কোনো লাভ হলো না

- সংগৃহীত

আমেরিকা চাইলেও লাদাখ সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। পারলে কাশ্মির সমস্যার সমাধান আরো আগেই হতো।

উপমহাদেশের সাম্প্রতিক সংঘাতে ভারতের পাশে থাকবে আমেরিকা। চীনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এ কথা বলে গেলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও। চীনও তার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। বলেছে, ভারত-চীন সম্পর্কের ক্ষেত্রে তৃতীয় কোনো পক্ষের অবস্থান তারা মানবে না। প্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এ সব কথার আদৌ কি কোনো গুরুত্ব আছে? যদি থাকতো, তা হলে অনেক সমস্যারই সমাধান হতে পারতো অনেক সহজে, অনেক আগেই।

ইতিহাসের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে ঢুকে লাভ নেই। তথ্য সকলেরই জানা। কিন্তু ইতিহাসের ট্রেন্ডটুকু ফলো করলেই স্পষ্ট হয়, ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর থেকে কাশ্মির নিয়ে কম পানি ঘোলা হয়নি। জাতিসঙ্ঘ কম মধ্যস্থতার কথা বলেনি। কিন্তু গত ৭০ বছরে সমস্যার সমাধান তো হয়ইনি, বরং পরিস্থিতি নানা সময়ে আরো জটিল হয়েছে।

ভারত-চীন সংঘাতও নতুন কিছু নয়। ষাটের দশকে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছে। তাতে পরাজিত হয়েছে ভারত। এরপর সত্তরের দশকেও দুই দেশের মধ্যে সংঘাত চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছেছে। সাম্প্রতিক ইতিহাসে একের পর এক স্ট্যান্ডঅফের ঘটনা ঘটেছে সীমান্তে। বর্তমানে লাদাখ সীমান্তে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা অত্যন্ত জটিল কিন্তু অভূতপূর্ব বা নজিরবিহীন নয়।

বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে কী ঘটল? চীনের একাধিক অ্যাপ ভারতে নিষিদ্ধ করে দিল মোদি সরকার। রাতারাতি বদলে দেয়া হলো আইপিএলের টাইটেল স্পনসরকে। চীনের একটি মোবাইল কোম্পানির পরিবর্তে ভারতের একটি সংস্থাকে সেই জায়গা হলো। অন্য দিকে, প্রায় প্রতিদিন দুই দেশ পরস্পরকে দোষারোপ করে উচ্চকিত মন্তব্য করছে। দুই দেশের সংঘাত আন্তর্জাতিক মঞ্চে আলোচিত হচ্ছে। কিন্তু সত্যিই কি দুই দেশের সম্পর্ক সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গিয়েছে? আদৌ কি তা সম্ভব?

ভারত সরকারের তথ্য বলছে, ২০০৫ সাল থেকে দেখলে গত ১৫ বছরে এই প্রথম দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক খানিকটা হলেও হোঁচট খেয়েছে। আমদানি এবং রফতানি দুই ক্ষেত্রেই পতন হয়েছে। কিন্তু সেই পতন তিন শতাংশের বেশি নয়। কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ মনে করছেন, চলতি অর্থ বছরে আরো পতনের সম্ভাবনা আছে। কিন্তু তা কখনোই দশ শতাংশের বেশি হবে না বলে তাদের ধারণা। দশ শতাংশ কম নয়। কিন্তু ভারত এবং চীনের সার্বিক বাণিজ্যিক অংকের নিরিখে তা নেহাতই মামুলি। মনে রাখা দরকার, কেবল সংঘাত নয়, দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের পতনের ক্ষেত্রে করোনাও একটি বড় কারণ।

ভারতে এখনো ঢালাও চীনের জিনিস পাওয়া যাচ্ছে। লোকে তা যথারীতি কিনছেও। তার উপর ভারত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডাব্লিউটিও) চুক্তির বন্ধনে বাঁধা পড়ে আছে। ফলে চীনের জিনিস ভারতে আসা বন্ধ করা যাবে না। আর চীনা জিনিসের দাম কম। ফলে মানুষ এই আর্থিক টানাটানির সময়ে নিজের পকেটের কথা চিন্তা করলে তাদের দোষ দেয়া যায় কি?

চীন ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক দেশ। প্রতি বছর প্রায় ৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ব্যবসা হয় দুই দেশের মধ্যে। ভারতের বিশাল বাজার চীন কখনোই হেলায় হারাতে চায় না। চলতি সংঘাতের সময়েও দুই দেশ বার বার সে কথা স্বীকার করেছে এবং যৌথ বিবৃতি দিয়েছে।

আসলে খেলাটা রাজনৈতিক। গোটা বিশ্বেই ন্যাশনালিস্ট বা জাতীয়তাবাদী রাজনীতির জোয়ার চলছে। চীনের সঙ্গে সংঘাতকে সামনে রেখে ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকার 'আত্মনির্ভর' ভারতের জাতীয়তাবাদী রাজনীতি মানুষের মনে গেঁথে দেয়ার চেষ্টা করছে। খানিক সফলও হয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চীনা পণ্য বয়কটের ডাক দিয়ে রাজনৈতিক দল এবং সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমেছে। তাতে সার্বিক ভাবে দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক কি খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখনো পর্যন্ত তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ঠিক যেমন ষাটের দশকের যুদ্ধের পরেও হয়নি। একই কাজ করছে চীনও। সীমান্তে শক্তি প্রদর্শন করে দেশের মানুষের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

আমেরিকাও পিছিয়ে নেই। ট্রাম্প সরকার গত চার বছর ধরে এই জাতীয়তাবাদী রাজনীতির জুতো পায়ে দিয়েই দেশ চালিয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে চীনের সাথে আমেরিকার সংঘাতও তৈরি হয়েছে সেই জায়গা থেকেই। আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে সকলেই নিজের শক্তি জাহির করতে চায়। এই মুহূর্তে আমেরিকা এবং চীন ঠিক সে কাজটিই করে যাচ্ছে। ক্ষমতা প্রদর্শনের চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা চলছে। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই দুই দেশ নিজেদের ব্লক তৈরি করার চেষ্টা করছে। এবং সে কারণেই আমেরিকার পাখির চোখ এখন এশিয়া প্যাসিফিক বা এমিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল। সেখানে চীনের অবিসংবাদিত ক্ষমতা কমানোর জন্য আমেরিকা ভারতকে সঙ্গী করার খেলায় নেমেছে। তারই ফল পম্পেও-র ভারতকে সাহায্য করার উবাচ। ৩ নভেম্বর মার্কিন নির্বাচনের পরে তার আদৌ কোনো স্থায়ীত্ব থাকবে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ যথেষ্ট। দ্বিতীয়ত, ভারত এবং চীন যতই হুমকি দিক, পুরো দস্তুর যুদ্ধের এই মুহূর্তে কোনো সম্ভাবনা নেই বলেই মনে করা হচ্ছে। ফলে আমেরিকা চাইলেও লাদাখ সংকটে মধ্যস্থতা করার জায়গায় থাকবে না। ভারত চাইলেও পারবে না। যদি পারতো, তা হলে লাদাখ এবং অরুণাচল নিয়ে দুই দেশের বিতর্ক অনেক আগেই সমাধান সূত্রে পৌঁছতো।

আসলে কিছুই বদলায় না। বদলালে আন্তর্জাতিক রাজনীতি চলবে কী করে? তবু বদলের কিছু ভার্চুয়াল ছবি তৈরি করা হয় সাধারণ মানুষের চোখের সামনে। বিভিন্ন সময়ে সেই ছবি মানুষের ভাবাবেগে পরিবর্তন আনে। ভোট হয়। সরকার বদল হয়। তারপর আবার সব আগের মতোই চলতে থাকে। ওই যে কবি লিখেছিলেন না, 'রাজা বদলায়, দিন বদলায় না।' ডয়চে ভেলে


আরো সংবাদ



premium cement