৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসনে সোস্যাল ফাইন্যান্স

অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসনে সোস্যাল ফাইন্যান্স - নয়া দিগন্ত

অর্থনৈতিক বৈষম্যে ধনী-গরিবের মধ্যে বৃহদাকার তফাত সৃষ্টি হয়। সমাজে সম্পদের সুষম বণ্টন হয় না। এ অবস্থা মূলত পুঁজিবাদেরই ফসল। পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদরা অবশ্য বলেন, সমাজে বিরাজিত আয়ের এ বিশাল বৈষম্য মূলত প্রকৃতির নিয়ম ও অনিবার্য বিষয়। তারা দরিদ্র জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য সম্পদ ও আয়ের পুনর্বণ্টনের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। বিকল্প হিসেবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনকে গুরুত্ব দিয়েছেন। অর্থনীতিবিদ পেরিটো বলেন, ‘যদি জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে মোট আয় বৃদ্ধির হার বেশি না হয়, তবে আয়ের বৈষম্য কমানো সম্ভব নয়। ড. এম উমর চাপরা বলেন, ‘পাশ্চাত্যের উদারনৈতিক ও রক্ষণশীল শিবিরের অর্থনীতিবিদরা আয়ের সুষম বণ্টনের পরিবর্তে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর জোর দিয়েছেন।’ অর্থনীতিবিদ থুরোর মতে, ‘যদি কোনো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়, তবে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে এবং সবার জন্য অধিকতর আয়ের পথ সুগম হবে। জনগণ তাদের অধিকতর আয় অর্জনের কারণে বিত্তশীলদের অবস্থার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করেই সুখী থাকবে। সমাজ তখন আর ধন-বৈষম্য ঘোচানো নিয়ে মাথা ঘামাবে না। শেষ পর্যন্ত অব্যাহত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফলে আয়-বৈষম্যের ফারাক ক্রমেই কমে আসবে।’

বাংলাদেশের আয়-বৈষম্য ও তার প্রভাব : একটি দেশের আয়ের বৈষম্য পরিমাপ করার একটি বহুল প্রচলিত পদ্ধতি হচ্ছে গিনি সহগ (Gini coefficient)। সবার আয় সমান হলে গিনি সহগ মান হবে শূন্য, যার অর্থ হচ্ছে- চরম সাম্য অবস্থা বিরাজ করছে, অর্থাৎ অর্থনীতিতে সব সম্পদের বণ্টনে সম্পূর্ণ সমতা রয়েছে। গিনি সহগ ১০০ হলে আয়ের চরম বৈষম্য রয়েছে। পৃথিবীর কোনো দেশের গিনি সহগ যেমন শূন্য নেই, তেমনি কোনো দেশের ১০০-ও নেই। সর্বনিম্ন গিনি সহগ সমাজতান্ত্রিক দেশ যেমন পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে, তেমনি সর্বোচ্চ হলো পুঁজিবাদের দেশ যেমন- দক্ষিণ আফ্রিকা, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য।

বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালের জরিপ অনুযায়ী, দেশের গিনি সহগের মান ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৩৬ এবং দেশের সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ মানুষ ওই সময়ে দেশের মোট আয়ের ২৮ শতাংশ আয় করত। ২০১৬ সালে বিবিএসের খানা আয় ও ব্যয় জরিপের ফল অনুযায়ী, গিনি সহগ বেড়ে দাঁড়ায় শূন্য দশমিক ৪৮৩ এবং দেশের ১০ শতাংশ শীর্ষ ধনীর কাছে জমা ছিল মোট আয়ের ৩৮ শতাংশ। সর্বশেষ হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (ঐওঊঝ)-২০২২ মোতাবেক আয়বৈষম্য পরিমাপক গিনি সহগ বাংলাদেশে শূন্য দশমিক ৪৯৯-এ পৌঁছে গেছে এবং দেশের ১০ শতাংশ শীর্ষ ধনীর কাছে জমা বেড়ে হয়েছে মোট আয়ের ৪১ শতাংশ। এমনকি দেশের সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ মানুষের আয় এখন দেশের মোট আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ। গিনি সহগের মান শূন্য ৫০ পয়েন্ট পেরোলেই একটি দেশকে উচ্চ বৈষম্যের দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, সেখানে বাংলাদেশে গিনি সহগের মান শূন্য দশমিক ৪৯৯। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ এখন উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে।

গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। দেশটি প্রতি বছর ৬ থেকে ৮ শতাংশ স্থির জিডিপি বৃদ্ধির হার অর্জন করেছে। তবে এ প্রবৃদ্ধির পেছনে একটি অন্ধকার দিক হলো- ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান বেড়েই চলেছে। অর্থনীতিবিদ ড. রেহমান সোবহানের মতে, ১৫ বছর ধরে দেশ একটি ভালো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে। পদ্মা সেতুসহ অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়নে যে ব্যয় হয়েছে তাতে প্রান্তিক মানুষ কতটা ভাগীদার হয়েছে? সরকার উন্নয়ন বাজেটে কতটা দলিত, নারী, প্রবীণ সমাজের উন্নয়নের মতো বিষয়গুলো রেখেছে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। অধ্যাপক রেহমান সোবহানের মতে, বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্যতম ব্যর্থতার একটি দিক হচ্ছে ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থার অভাব।
সিপিডির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, বাংলাদেশে উন্নতি হয়েছে, কিন্তু তার ভাগীদার সবাই সমান নন। বৈষম্য বছর বছর বাড়ছে, যা শিক্ষা-স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলছে। অত্যন্ত বিত্তবানদের রাজনৈতিক ক্ষমতারও উদ্ভব ঘটছে। অর্থনৈতিক বৈষম্যের পাশাপাশি গ্রামীণ দারিদ্র্যও বেড়েছে। দেশের রাশিয়ান ওলিগার্কের মতো শ্রেণী তৈরি হয়েছে যারা সম্পদশালী ও রাজনৈতিকভাবে খুবই প্রভাবশালী। যার ফলে আয়-বৈষম্য খুবই দ্রুত বাড়ছে। সিপিডির ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমরা গড় হিসাবে অনেক ভালো করেছি, কিন্তু সমান্তরাল বাস্তবতার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সামগ্রিক থেকে ব্যক্তিপর্যায়ে অনেক ধরনের অসাম্য ও বৈষম্য বিদ্যমান। বর্তমানে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ আয় পাথর্ক্য ৮০ গুণ, যা ২০০৫ সালে ছিল ৩০ গুণ। এ ধরনের বৈষম্য বজায় রেখে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব না বলেও মন্তব্য করেন মোস্তাফিজুর রহমান।

বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান আয়-বৈষম্য সামাজিক সংহতি ও বিশ্বাসকে ক্ষুণ্ণ করে, অসন্তোষ ও সহিংসতাকে উসকে দেয়, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও জবাবদিহিকে ক্ষয় করে, দারিদ্র্য হ্র্রাস ও মানব উন্নয়নে বাধা দেয়, অর্থনৈতিক দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা হ্রাস করে এবং পরিবেশগত ভারসাম্যকে হুমকির মুখে ফেলে। গত এক দশকে জিডিপির অনুপাতে কর আদায়ের হার হ্রাস পেয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, কর-জিডিপি অনুপাত এখন প্রায় ৮ দশমিক ৫ শতাংশ, যা বিশ্বের সর্বনিম্ন একটি। সরকারের রাজস্বের এক-তৃতীয়াংশের কম আসে প্রত্যক্ষ কর থেকে। বিপরীতে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসে পরোক্ষ কর থেকে। পরোক্ষ করের ওপর এই অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর অন্যায্য চাপ সৃষ্টি করে। অন্য দিকে অভিযোগ আছে যে, বিপুলসংখ্যক সম্ভাব্য করদাতা, করজালের বাইরে থাকেন বা সামান্য পরিমাণ কর দেন। ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- দুর্নীতির প্রসার। ঋণখেলাপি, করখেলাপি, ব্যাংক কেলেঙ্কারি ও অর্থ পাচারের ঘটনার বৃদ্ধি দুর্নীতি দমনে ব্যর্থতার চিত্রকে তুলে ধরে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন গণতান্ত্রিক শাসন এবং দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপগুলো শক্তিশালী করা। কারণ এসব পদক্ষেপ অভিজাতদের দ্বারা রাষ্ট্রীয় সম্পদের দখলকে হ্রাস করে এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতা বাড়ায়।

বৈষম্য দূরীকরণে সোস্যাল ফাইন্যান্স : ইসলামী অর্থব্যবস্থায় আল্লাহ সৃষ্টজীবের কল্যাণ সম্পদের সর্বাধিক উৎপাদন, সুষ্ঠু বণ্টন, ন্যায়সঙ্গত ভোগ বিশ্লেষণ রয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও আত্মীয়স্বজনকে দান করার নির্দেশ দেন এবং অশ্লীলতা, অন্যায় কাজ ও অবাধ্যতা হতে নিষেধ করেন।’ (সূরা নাহল-৯০) ইসলামী অর্থনীতিতে সুনীতি প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি উৎখাত এবং নির্যাতিত ও বঞ্চিতদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা হয়েছে। মানুষ তার সম্পদের একচেটিয়া মালিক নয়; বরং সম্পদশালীদের সম্পদে দুস্থ-গরিব, নির্যাতিত ও বঞ্চিতদের হক রয়েছে। আল্লাহ বলেন- ‘তাদের সম্পদে সাহায্যপ্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।’ (সূরা জারিয়াত-১৯) ইসলাম সম্পদের সুষম বণ্টনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। আল্লাহ বলেন- ‘ধনৈশ্বর্য যেন কেবল তোমাদের বিত্তশালীদের মধ্যেই পুঞ্জীভূত না হয়।’ (সূরা হাশর-৭) ইসলাম জনকল্যাণের জন্য সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার চায়।

ইসলামী অর্থব্যবস্থার বাস্তব প্রয়োগ ঘটে ইসলামের দ্বিতীয় হিজরিতে মদিনায় রাসূল সা:-এর ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। জাকাত ব্যবস্থা ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম বাধ্যতামূলক বিধান। আল্লাহ বলেন- ‘তোমরা নামাজ কায়েম করো ও জাকাত আদায় করো, তোমরা নিজের জন্য আগে যে সৎকর্ম প্রেরণ করবে তা আল্লাহর কাছে পাবে।’ (সূরা বাকারা-১১০) ওশর, বায়তুলমাল, গণিমত, জিজিয়া কর, খারাজ, কর্জে হাসানাহ ইত্যাদি ব্যবস্থার প্রবর্তন এবং সব রকম অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ইসলামী শরিয়তের পূর্ণ বাস্তবায়নই হচ্ছে ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম লক্ষ্য। সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্টের উদ্যোগে ড. কবির হাসান পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ৮৮ হাজার কোটি টাকা জাকাত আদায় করা সম্ভব। অন্য এক গবেষণায় ড. মো: মিজানুর রহমান দেখিয়েছেন, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় আট হাজার কোটি টাকা ওশর আদায় করা সম্ভব। এত বিশাল অঙ্কের জাকাত এবং ওশর ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৈষম্য অনেকাংশেই লাগব করা সম্ভব।

আয়-বৈষম্যের লাগাম টেনে ধরতে চাইলে ঢালাওভাবে টিসিবি বা রুগ্ণ রাষ্ট্রায়ত্ত খাতকে সম্পৃক্ত না করে বাজার ব্যর্থতা দূরীকরণে গরিবের মানসম্মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, ব্যর্থ হয় পরিবেশদূষণের মতো নেতিবাচক বাহ্যিকতাগুলো ঠেকাতে; অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো গড়ে তোলায়, নানা রকম মনোপলি ও অলিগোপলির কারণে, ‘পাবলিক গুডস’ জোগান ইত্যাদি দিতে ব্যর্থ রাষ্ট্রের ভূমিকাকে যৌক্তিকভাবে পুনর্বিন্যাস করতে হবে। রাষ্ট্রকে বৈষম্য নিরসনকারীর ভূমিকা নিতে হবে, যেমন হয়েছে ভিয়েতনামে, গণচীনে কিংবা ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোতে। সরকারকে রাজস্ব সংগ্রহ করতে হবে প্রধানত সমাজের উচ্চমধ্যবিত্তদের আয়কর ও সম্পত্তি কর থেকে।

এক কথায়, আয়-বৈষম্য হ্র্রাসের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জনে প্রয়োজন দ্বিমুখী নীতি। এক দিকে যেমন দরকার উচ্চবিত্ত শ্রেণীর সম্পদ বৃদ্ধির লাগাম টানা, তেমনি প্রয়োজন নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি। ইসলামী সোস্যাল ফাইন্যান্স, বিশেষ করে জাকাত ও ওশর এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। পাশাপাশি জরুরি হচ্ছে বৈষম্য কমাতে টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন।

বৈষম্য বিলোপ সম্ভব হলেই মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি বা প্রবৃদ্ধির সুফল প্রান্তজনের কাছে পৌঁছাবে। শুধু প্রবৃদ্ধি নয়, সঠিক জায়গায় দায়বদ্ধতা সৃষ্টি ও স্বচ্ছতা প্রতিপালনের মাধ্যমে উন্নয়নের সুফল অধিকজনের কাছে পৌঁছাতে পারলেই নিশ্চিত হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন; কমে আসবে আয়-বৈষম্য।

লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
Mizan12bd@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement