৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ইদানীং প্রাসঙ্গিক

ইদানীং প্রাসঙ্গিক - নয়া দিগন্ত

একটি সমৃদ্ধ এবং মানবিক দেশ গড়ার লক্ষ্যে যেখানে থাকবে ব্যক্তি সমষ্টি ও সমাজের অর্থনৈতিক মুক্তি, নিশ্চিত নিরাপত্তার বেষ্টনী; যেখানে মানুষ নির্ভয়ে তার মতপ্রকাশের অধিকার এবং স্বাধীনতা ভোগ করবে- এ প্রত্যাশা ও স্বপ্ন নিয়ে স্বাধীনতার সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিল। দেশের সব অংশের অর্থনৈতিক সমতার মধ্য দিয়ে সামগ্রিক উন্নয়ন সেখানে একটি মুখ্য বিষয় ছিল। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ছিল সমন্বিত ও উন্নত শিক্ষার স্বপ্ন। ছিল যোগ্যতা অনুসারে বিভিন্ন পেশা ও চাকরিতে নিয়োজিত হওয়ার নিশ্চয়তা। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর এ স্বপ্নগুলোর কথা ভাবলে নিরাশা, হতাশা ও বেদনায় বুক ভরে ওঠে। আমাদের তরুণরা আজ বিদেশমুখী অনিশ্চিত যাত্রায়। তাদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার বদৌলতে পুষ্ট হয় দেশের অর্থনীতি। অথচ ভিনদেশীরা এর বিশাল এক অংশ নিয়ে যায়। আর বেশির ভাগ পাচার হয়ে যায় দেশের বাইরে। আজ পর্যন্ত কোনো পাচারকারীর বিচার হয়েছে বলে শোনা যায়নি।

দেশে আইনের শাসন শুধু কথার কথা। আইন বিত্তশালীদের কব্জায়। ক্ষমতাধরদের অঙ্গুুলি হেলনে আইন তার গতিপথ বদলায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনি ব্যবস্থার প্রয়োগ অদৃশ্য ইশারায় বছরের পর বছর পিছিয়ে যায়- ন্যায়বিচারের দোহাই দিয়ে। Justice delayed Justice denied আপ্তবাক্যটি তখন মাথা কুটে মরে। লজ্জায় মাথা লুকায়। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে মুহূর্তের মধ্যে আইনের অসাধারণ ক্ষিপ্রতার প্রয়োগ দেখা যায়- তখন কিন্তু ন্যায়বিচারের প্রশ্ন ওঠে না। যারা রাজনৈতিক, শারীরিক ও আর্থিকভাবে দুর্বল তাদের জন্য আইনের সাহায্য দুরাশা মাত্র। অনেক সময় বিচারের রায়গুলো নির্দেশিত বলে গুঞ্জন শোনা যায়। দেশের সর্বোচ্চ আইন প্রয়োগের ক্ষেত্র; যেখানে সম্মানিত বিচারকমণ্ডলী রয়েছেন, রয়েছেন দেশের খ্যাতনামা আইনজ্ঞরা; বিচারের সর্বশ্রেষ্ঠ পাদপীঠে- নির্বাচনে তুঘলকি এবং তেলেসমাতি কাণ্ডের পর বিচারালয়, আইন এবং আইনজ্ঞদের প্রতি সাধারণের শ্রদ্ধাবোধ স্বভাবত প্রশ্নবিদ্ধ হয়। বলা হয়ে থাকে, বিচারালয় পবিত্র অঙ্গন। এ পবিত্র অঙ্গনের অপবিত্রতা কিন্তু সাধারণজনেরা করেননি। যারা ‘মাই লর্ড’ বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন, বিচারালয়ের পবিত্রতার কথা বলেন, তারা কাজটি করার পর কিভাবে গণতন্ত্রের উদাহরণ টানবেন? রাজনীতির মাঠ-শঠতা, প্রবঞ্চনা আর মিথ্যার দাপটে কালিমা লিপ্ত। একে অপরের চরিত্র হননের কূটকৌশলে রাজনীতির মাঠ-তমসাচ্ছন্ন।

শিক্ষাক্ষেত্রে একই অবস্থা। দেশে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা শতাধিক। একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে একেক ধরনের শিক্ষাক্রম। স্কুল-কলেজেও একই অবস্থা। অবস্থার ব্যতিক্রম নেই মাদরাসাগুলোতেও। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে যারা সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বের হন তারা না চেনেন দেশকে, না চেনেন জাতিকে। তাদের কাছে জাতির ইতিহাস সাহিত্য সংস্কৃতি সবই অবোধ্য। অপর দিকে, নৈতিকতা, মানবীয় গুণাবলিতে নিজেকে সমৃদ্ধ করার শিক্ষা এখানে অপাঙ্ক্তেয়। অনিয়ম, পেশিশক্তি প্রদর্শন, অনৈতিক কর্মকাণ্ডের আড়ালে হারিয়ে গেছে শিক্ষাঙ্গনের পবিত্রতা। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে এক শ্রেণীর আশীর্বাদপুষ্ট বোদ্ধার নিয়ন্ত্রণে দেশের শিক্ষাঙ্গন। ৯০ শতাংশ ইসলাম ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত এসব শিক্ষাঙ্গনে ইসলাম ধর্মীয় চর্চা এখন নিষিদ্ধের পর্যায়ে। যারা অথনৈতিকভাবে একটু সচ্ছল তারা ছেলেমেয়েদের বিদেশে পাঠাচ্ছেন শিক্ষার জন্য। অথচ তাদের পেছনে ব্যয়িত মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা জোগান দেয় এ দেশের সাধারণ খেটেখাওয়া জনগণ এবং বিদেশে প্রাণান্তকর পরিশ্রম করা প্রবাসীরা।

স্বাস্থ্য ক্ষেত্রেও একই চিত্র। দেশের মানুষের স্বাস্থ্য যাই হোক না কেন, নেতারা সপরিবারে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নিতে দ্বিধাবোধ করেন না। দেখাদেখি সাধারণ রোগীরাও আজ চিকিৎসার জন্য প্রতিবেশী দেশের অনুকম্পা প্রার্থী। কিন্তু সেখানেও অপমান আর লাঞ্ছনার শেষ নেই। যা প্রায়ই সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা যায়। অর্থনীতির অবস্থা আরো করুণ। গোটা সাতেক পরিবারে হাতে অর্থনীতি বন্দী। তাদের দোর্দণ্ড প্রতাপে দেশের সাধারণ জনগণের শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। ধানের মৌসুমে চালের মূল্যবৃদ্ধি, আলুর মৌসুমে আলু আমদানি, পেঁয়াজের মৌসুমে পেঁয়াজের দাম নাগালের বাইরে। সব কিছু আমদানিমুখী। নেপথ্যে সাত গোষ্ঠীর খেলা। আলু আমদানি, পেঁয়াজ আমদানি, কাঁচামরিচ, রসুন, আদা, ডিম সব আমদানির সারিতে। ইদানীং গরুর গোশত ও মাছ আমদানির কথা শোনা যাচ্ছে। কাঁচামরিচের বাজার ভিনদেশীদের দখলে। গ্রামকেন্দ্রিক কৃষি অর্থনীতি ভেঙে তছনছ। ইদানীং বিভিন্ন বড় বড় বিপণিতে বিদেশী চানাচুর, মিষ্টি এবং সেমাইয়ের আধিক্যে দেশীয় খাবার কোণঠাসা। বিদেশী প্রসাধনী, শাড়ি, পোশাক, টুথপেস্ট পর্যন্ত বিদেশীদের কব্জায়। আতঙ্কিত হই, ভীতসন্ত্রস্ত হই যখন বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার পেরিয়েছে বলে শোনা যায়।

ইদানীং স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার কথা শোনা যাচ্ছে। অথচ রাজধানী শহর ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত নগরীর তকমায় অভিষিক্ত। নদী খাল বিল শুকিয়ে এখন হয় ফসলের ক্ষেত অথবা খেলার মাঠ। প্রধান নদীগুলো বিষাক্ত বর্জ্যরে যন্ত্রণায় মৃতপ্রায়। প্রাকৃতিক পরিবেশ দূষিত, বিষাক্ত। নিরাপদ খাবার, সুপেয় পানি এখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হওয়ার পথে। সামাজিক মূল্যবোধ, সহমর্মিতা, দয়া, সহযোগিতা, চরিত্র, নৈতিকতা এখন শুধু শব্দমালা। বস্তুবাদী অনৈতিক জীবন দর্শনের নীল ছোবলে এগুলো হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে মানবিকতা। আজ পিতা পুত্রকে, পুত্র পিতাকে, স্বামী স্ত্রীকে, প্রবঞ্চনার যন্ত্রণায় সম্পর্ক ভেঙে পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। ফলে প্রায়ই বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। অথচ স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রে উল্লেখ করা হয়েছিল এক বুকভরা আশা ও স্বপ্নের কথা। বলা হয়েছিল সমতা, মানুষের মর্যাদা, আইনের শাসন ও সামাজিক মর্যাদার কথা। যা পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হিসেবে সংবিধিবদ্ধ করা হয়- বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রে। মানুষে মানুষে অর্থনৈতিক, সামাজিক-অসাম্য পৃথিবীর অন্যতম দুর্নীতিবাজ দেশ, অনিশ্চিত মানবাধিকার, আইনের শাসনের ব্যত্যয়, আংশিক সিভিল লিবার্টি ইনডেক্সের পরিপ্রেক্ষিতে আলেকজান্ডারের কথা মনে পড়ে- ‘সেলুকাস! সত্যি কি বিচিত্র এই দেশ।’

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email-shah.b.islam@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement